ভোট নিয়ে আলোচনাতেও ভয়!

‘কাকা, সিনেমাটিনেমা বাদ দ্যান। এট্টা নিউজ চ্যানেল দ্যান। খবরটবর দেহি’-ঘিওর বাজারের একটা চায়ের দোকানে পঞ্চাশোর্ধ্ব দোকানদারকে বলছিলেন এক তরুণ। দোকানের সামনে বাঁশের চটা দিয়ে বানানো দু-তিনটা বেঞ্চি। পাঁচ-ছয়জন বসা। দোকানে একটা টেলিভিশন। তামিল ছবি চলছে। গ্রামাঞ্চলে চায়ের সঙ্গে অনেক দোকানদার এই বাড়তি বিনোদনের ব্যবস্থা রেখেছেন।

তরুণের কথা শুনে দোকানদার বললেন, ‘সিনেমাই দ্যাখ। কুনো খবর টক শো-মক শো দ্যাহা লাগবে না। খবরের চ্যানেল দিলেই তোরা ইলেকশনের ফাউ আলাপ শুরু করবি। পরে পুলিশ আইসা বলব, আমার এইহানে মিটিং অয়। ঝামেলা হবে শেষ পর্যন্ত আমার।’

ঘিওরের ওই চায়ের দোকানদারের কথা শুনে অন্য দোকানগুলোর টেলিভিশনে কোন চ্যানেল চলছে সেদিকে খেয়াল রাখার আগ্রহ হলো। দেখা গেল, অন্য দোকানগুলোতেও নিউজ চ্যানেল দেখা হচ্ছে না। বেশির ভাগ দোকানেই বিদেশি চ্যানেল চলছে।

নির্বাচন সামনে রেখে খদ্দেরদের আগ্রহ নিউজ চ্যানেলের দিকে বেশি থাকে। তাঁরা চা খান আর রসিয়ে রসিয়ে রাজনীতি নিয়ে আলাপ করেন। এতে বেচাবিক্রি ভালো হয়। দোকানদারেরা এই আলাপ জমানোর জন্যই আগের দিনে বিবিসির সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার খবর চালাতেন। এখন টিভি চালান। কিন্তু সেই দোকানদারেরাই এখন এই আলাপসালাপকে বিরাট ঝামেলা মনে করছেন। চা খেয়ে দোকানে বসে কেউ আড্ডা দিক, তা এখন আর তাঁরা চাইতে পারছেন না।

মানিকগঞ্জ সদর থেকে শুরু করে প্রায় সব উপজেলার দোকানপাট, হাটবাজারে এখন রাজনীতির আলাপ চলছে সতর্কভাবে। সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পর নির্বাচন নিয়ে কথা বলতে গেলে এখানকার অনেকে মন্তব্য করতে চাননি। যাঁরা কথা বলেন, তাঁদের একটি বড় অংশই নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করলেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ভদ্রলোক বললেন, পুরো মানিকগঞ্জে বরাবরই আওয়ামী লীগের তুলনায় বিএনপির অবস্থান শক্ত। এ কারণে রাজধানীর নিকটবর্তী এই জেলায় সরকারের দিক থেকে বেশি মনোযোগ রয়েছে। নির্বাচন সামনে রেখে সরকারবিরোধীরা যাতে সংগঠিত না হতে পারেন সে জন্য আটক, গ্রেপ্তার, মামলা দিয়ে তাঁদের একধরনের চাপে রাখা হয়েছে। সভা-সমাবেশ তো দূরের কথা, এখানে যাতে কোনো উপলক্ষ সামনে রেখে ১০-১২ জন জড়ো না হতে পারে, সে জন্য চাপা আতঙ্ক তৈরি করা হয়েছে।

মানিকগঞ্জ শহরে দেবেন্দ্র কলেজের ১০-১২ জন ছাত্র আড্ডা দিচ্ছিলেন। এক বন্ধুকে নিয়ে তাঁদের কাছে গিয়ে পরিচিত হলাম। তাঁদের মধ্যে প্রায় সবাই ভোটার। সবাই স্থানীয় বাসিন্দা। সাংবাদিক পরিচয় শুনেই তাঁরা শক্ত হয়ে গেলেন। একজন সোজা বলে দিলেন, ‘ভাই, ঢাকা থেকে আসছেন। চা খান। কিন্তু মাফ চাই, রাজনীতি নিয়ে কোনো কথা বলব না।’ ওঁদের মধ্যে একজন বললেন, তাঁরা সবাই প্রথমবারের মতো ভোটার হয়েছেন। নির্বাচন নিয়ে তাঁদের আগ্রহও আছে। কিন্তু মামলা-মোকদ্দমা ছাড়াই যেভাবে লোকজনকে আটক করা হচ্ছে, তাতে নির্বাচন সম্পর্কে তাঁদের মনে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হচ্ছে। তিনি জানালেন, সন্ধ্যার পর একটি সরকারি অফিসের সামনে আলো জ্বেলে তাঁরা ব্যাডমিন্টন খেলতেন। প্রতি শীতেই তাঁরা এখানে খেলা করেন। কিন্তু তিন দিন আগে ওই অফিসের লোকজন বলে দিয়েছেন, এখানে আর খেলা যাবে না। তিনি মনে করছেন, নির্বাচন সামনে রেখে ধরপাকড় বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে তাঁদের স্বাভাবিক জীবনের গতি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে।

‘ভোট কেমন হবে বলে মনে হয়? এই আসনে কে জিততে পারে’-এই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে তাঁদের মধ্যে ফয়েজ নামের একজন বললেন, ভোট হবে, তাঁরা প্রথমবারের মতো ভোট দিতে পারবেন, এটা আনন্দের বিষয়। কিন্তু ভোট নিয়ে এলাকায় কোনো অশান্তি বাধে কি না, তা নিয়ে তাঁদের মনে যথেষ্ট উদ্বেগ আছে। তবে তাঁদের আশা, নির্বাচনের আগে সেনাবাহিনী মাঠে নামলে তখন ধরপাকড়ের আতঙ্ক কেটে যাবে।

তাঁদের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন সেখানে হাজির হলেন মনির হোসেন (ছদ্মনাম)। তাঁর বয়স ২৩-২৪ বছর। তিনি বললেন, ‘ভাই, আইজকা সন্ধ্যায় আমারে ধরছিল কয়জন। কয়, কাইলই তুই আমাগো লগে জয়েন করবি। আমি কইছি, হ করব। কাইল শিয়োর করব। এই সব ধানাইপানাই কইয়া চইল্যা আইছি। পিঠ বাঁচানুর লাইগ্যা। কিন্তু কন ভাই, ধর্ম আর দল ভিতরের ব্যাপার না? বিশ্বাসের ব্যাপার না? এইটা জোর কইরা হয়?’

সাটুরিয়ার ব্যবসায়ী জামাল বললেন, আগে সন্ধ্যার পর বাজারঘাট লোকজনে গমগম করত। কিন্তু কয়েক দিন ধরে রাত আটটার পর লোকজনের উপস্থিতি কমে যায়। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা খারাপ। জামাল হোসেন নামের এক ভদ্রলোক বললেন, এ এলাকায় হঠাৎ করে চুরি-ডাকাতি বেড়ে গেছে। প্রায়ই তাঁরা বিভিন্ন জায়গা থেকে চুরি-ডাকাতির খবর পাচ্ছেন। জামালের ব্যক্তিগত অভিমত হলো, চুরি-ডাকাতি প্রতিরোধ বা অন্যান্য অপরাধ দমনের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে প্রশাসনের লোকজন আকস্মিকভাবে রাজনৈতিক কর্মী-সমর্থকদের দিকে বেশি দৃষ্টি রাখছেন। এটিকেই অপরাধীরা সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাচ্ছে।

কোন প্রার্থীর তুলনায় কোন প্রার্থী সবল অথবা দুর্বল তা নিয়ে লোকজনের মধ্যে আগ্রহ দেখা গেল না। যেমনটা বলছিলেন মানিকগঞ্জ সদরে বসবাসকারী বাদল আহমেদ। তিনি বলছিলেন, একটি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে-এই বিশ্বাস জনগণের মধ্যে খুব একটা জোরালো অবস্থায় নেই। আর শেষ পর্যন্ত যদি নির্বাচন নিরপেক্ষ হয়, তাহলে এখানকার ভোটের হিসাবনিকাশ পাল্টে যাবে।

ঘিওরের বেসরকারি উন্নয়নকর্মী নুশরাত মনে করেন, মানিকগঞ্জে নানা কারণে ১০ বছরে বিএনপির সমর্থকদের একটি বড় অংশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছে। সরকারের নানা ধরনের উন্নয়নকাজে এলাকার মানুষও খুশি। ফলে নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগেরই পাস করার কথা।

সারফুদ্দিন আহমেদ: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
sarfuddin 2003 @gmail. com