শিশুবিবাহ নারীর ক্ষমতায়নে বাধা

‘বাংলাদেশে শিশুবিবাহ পরিস্থিতি’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা। গতকাল কারওয়ান বাজারে।  ছবি: প্রথম আলো
‘বাংলাদেশে শিশুবিবাহ পরিস্থিতি’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা। গতকাল কারওয়ান বাজারে। ছবি: প্রথম আলো

দেশে শিশুবিবাহ পরিস্থিতি গত কয়েক দশকে উন্নতি হয়েছে। তবে একেবারে কমে আসেনি। শিশুবিবাহের কারণে ভবিষ্যৎ নারীর ক্ষমতায়ন বাধাগ্রস্ত হয়। শুধু আইন প্রয়োগ বা আইনি শাস্তির মাধ্যমে শিশুবিবাহ কমবে না। এটি ঠেকাতে দেশব্যাপী সামাজিক সচেতনতা বাড়ানো এবং পারিবারিক মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন। পাশাপাশি তরুণ প্রজন্ম বা শিশুদেরও এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে।

গতকাল রোববার প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘বাংলাদেশে শিশুবিবাহ পরিস্থিতি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা এসব কথা বলেন। প্রথম আলো আয়োজিত এই বৈঠকের সহযোগিতায় ছিল জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ)। সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।

বৈঠকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান নেহাল করিম বলেন, সমাজে যে অজ্ঞতা, সংস্কার, সেটাই শিশুবিবাহে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে। অর্থনৈতিক, দারিদ্র্য, অভিভাবকদের বিচ্ছেদ, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব তো আছেই। শিশুবিবাহ বন্ধে আইনে ঘাটতি আছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, শিশুবিবাহ কমতে পারে, তবে নির্মূল হবে না। সেটা করতে হলে দেশব্যাপী প্রচারণা চালাতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিশুবিবাহ নিয়ে সচেতনতা কর্মসূচি করার পরামর্শ দেন তিনি।

উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের ডেপুটি পুলিশ কমিশনার ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, ‘আমরা মাসে পাঁচ থেকে ছয়টি শিশুবিবাহ ঠেকাই। এই কেসগুলোতে দেখি শর্ষের মধ্যেই ভূত। অভিভাবকেরা মেয়েদের বয়ঃসন্ধি পেরোলেই বোঝা মনে করেন। এই মানসিকতা বদলাতে হবে।’ তিনি বলেন, আইন-আদালত দিয়ে নয়, একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে সুনির্দিষ্ট শিশুবিবাহপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করে এগোতে হবে।

পপুলেশন কাউন্সিলের এদেশীয় পরিচালক উবায়দুর রব বলেন, কোনো উপজেলায় বা এলাকায় ৫টা, ১০টা ১০০টা শিশুবিবাহ ঠেকানো মানেই বাল্যবিবাহ ঠেকানো নয়। সুনির্দিষ্ট এলাকায় শিশুবিবাহ নিয়ে প্রচারণা চালানো দরকার। সামাজিক পরিবর্তন একদিনে হবে না। প্রয়োজনে ৩০ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের চেয়ারপারসন মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বলেন, শিশুবিবাহ হলে নারীর ক্ষমতায়ন বাধা পায়। এর কারণে জনমিতি লভ্যাংশ অর্জন (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড) হবে না। এমনকি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার আটটি লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে না। রাজনৈতিক দলগুলোকে শিশুবিবাহ বন্ধ করার বিষয়টি ইশতেহারে রাখার আহ্বান জানান তিনি।

কেয়ার বাংলাদেশের নারীর ক্ষমতায়ন কর্মসূচির পরিচালক হুমায়রা আজিজ বলেন, নারীর ক্ষমতায়ন বাধা পায় শিশুবিবাহের কারণে। গত দুই চার বছরে শিশুবিবাহের পরিস্থিতিতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। তবে তা টেকসই নয়। সামাজিক কারণগুলো ঠিক না করলে এ সমস্যা থেকে যাবে। এ ক্ষেত্রে আইন অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাসলীমা ইয়াসমীন বলেন, সামাজিক পদক্ষেপে আরও মনোযোগ দিতে হবে। জেলা পর্যায়ে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে শিশুবিবাহ-সংক্রান্ত মামলায় মনিটরিং সেল রাখার পরামর্শ দেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের সানজীদা আখতার বলেন, অনেক সময় শিশু-কিশোরেরা নানা সম্পর্কে জড়িয়ে ভুল করে থাকে। সচেতনতার জন্য কোনো প্রকল্প নেওয়া হলে তাতে মেয়েশিশুর পাশাপাশি ছেলেশিশুদেরও যুক্ত করতে হবে।

>আইন-আদালত-শাস্তি দিয়ে নয়, শিশুবিবাহ ঠেকাতে হবে দেশব্যাপী সচেতনতার মাধ্যমে।

জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থার (ইউনিসেফ) শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ইকবাল হোসেন বলেন, বিভিন্ন গবেষণায় শুধু মেয়েশিশুদের নিয়ে কাজ করা হয়। এতে ছেলেশিশুদের যুক্ত করাও দরকার। পিছিয়ে পড়া পরিবারের মেয়েশিশুদের অল্প বয়সে বিয়ের সম্ভাবনা বেশি থাকে। প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে অবস্থা বুঝে পদক্ষেপ নিতে হবে।

মূল উপস্থাপনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ বিল্‌লাল হোসেন জানান, ২০১৪ সালের ডেমোগ্রাফিক ডেটা অনুযায়ী, শিশুবিবাহের সূচকে বৈশ্বিকভাবে চতুর্থ অবস্থানে বাংলাদেশ (৫৮ দশমিক ৬ শতাংশ)। সবচেয়ে বেশি শিশুবিবাহ হয় নাইজারে (৭৬ দশমিক ৩ শতাংশ)। ১৯৯৩-৯৪ সালে শিশুবিবাহের হার ছিল ৭৩ দশমিক ৩ শতাংশ, যা ২০১৪ সালে হয়েছে ৫৮ দশমিক ৬ শতাংশ। এটা ধারাবাহিকভাবে কমছে। ১৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের বিবাহের হার ১৯৯৫-৯৯ সালে ছিল ৩৯ দশমিক ৩ শতাংশ। কিন্তু ২০১০ সালে তা কমে এসেছে ৯ দশমিক ১ শতাংশে। তিনি বলেন, ‘শিশুবিবাহের ধারাটি কমে এসেছে। তবে সমাজের অন্য যেসব উন্নয়ন হচ্ছে ঠিক সেইভাবে শিশুবিবাহ বন্ধ হচ্ছে না।’

ইউএনএফপির জেন্ডার অ্যাডোলসেন্ট অ্যান্ড ইয়ুথের ন্যাশনাল প্রোগ্রাম অফিসার হুমায়রা ফারহানাজ বলেন, কমিউনিটি পর্যায়ে সচেতনতা বাড়াতে মনোযোগ দিতে হবে। রুম টু রিডের গার্লস এডুকেশন কর্মসূচির ব্যবস্থাপক রুকসানা সুলতানা বলেন, মেয়েদের স্বপ্ন দেখাতে হবে। তাদের পড়ালেখা চালিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখাতে পারলে শিশুবিবাহ কমে আসবে। প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের গ্লোবাল ইয়ুথ অ্যাডভাইজরি প্যানেলের সদস্য সৈয়দা কানিতা মাঈশা বলেন, শিশুবিবাহ নিয়ে বহু প্রকল্প আছে, হয়েছে। তবে সবার আগে দরকার তরুণ প্রজন্ম বা শিশুদের যুক্ত করে প্রচারণা চালানো।