আইনি প্রশ্নগুলো অমীমাংসিতই থাকল

রিটার্নিং কর্মকর্তারা নিরপেক্ষতা হারিয়েছিলেন, নির্বাচন কমিশন সেটা উদ্ধার করেছে। আমরা নিশ্চয় ইসিকে ধন্যবাদ দেব। কিন্তু যে নীতির ভিত্তিতে আপিলগুলো নিষ্পত্তি হলো, সেগুলো কেন কমিশন আগেই রিটার্নিং কর্মকর্তাদের একটি গাইডলাইন আকারে বলতে পারল না—তার একটি সদুত্তর পাওয়া জরুরি। রিটার্নিং কর্মকর্তারা ঢাকায় এসে এসব বিষয়ে করণীয় কী জানতে চেয়েছিলেন, ইসি বলতে পারেনি। আমরা দেখলাম, ৯ ডিসেম্বর ইসির আপিল পর্ব শেষ হওয়ার পর হাইকোর্ট পৌর মেয়র এবং উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানরা স্বপদে থেকেই নির্বাচন করতে পারবেন বলে একটি আদেশ দিয়েছেন। কিন্তু এতে বিভ্রান্তির কিছুই কাটল না।

পদত্যাগ করে মনোনয়নপত্র দাখিল করা উপজেলা পরিষদের যে ৩০ জন চেয়ারম্যানের মনোনয়ন শুরুতে বাতিল হয়েছিল, আপিলে তাঁরা প্রার্থিতা ফিরে পাওয়ায় মির্জা ফখরুল ইসিকে ‘ন্যায়বিচারের’ জন্য ধন্যবাদ দিয়েছিলেন। হাইকোর্টের এই আদেশের পর আমরা এখন হাসব না কাঁদব? অনেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদত্যাগ করেছেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত মনোনয়ন পাননি। তাঁদের দুই কূলই গেছে। ৯ ডিসেম্বরে যে চার মেয়র বৈধ হয়েছেন, তাঁদের দুজন বিএনপির মনোনয়ন পাননি, তাঁদের সান্ত্বনা যে তাঁদের এক কূল আছে।  

সুতরাং রিটার্নিং কর্মকর্তারা অর্বাচীনের মতো কাজ করেছিলেন আর ইসি বিজ্ঞোচিত কাণ্ড করেছে, তা বলা যাচ্ছে না। সবচেয়ে বড় কথা নির্বাচনসংক্রান্ত কোনো জনপ্রিয় আইনগত প্রশ্নেরই কোনো মীমাংসা হলো না। এর মধ্যে দণ্ডিত, ঋণখেলাপি, বিলখেলাপি কারা হবেন, মেয়র বা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানরা পদত্যাগ করে প্রার্থী হবেন কি হবেন না—এসব বিষয় উল্লেখযোগ্য।

কয়েক দশক ধরে আলোচিত এই বিষয়গুলো নিয়ে নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দলগুলো, কিংবা বিচার বিভাগ কোনো একটা সিদ্ধান্তে আসতে চেয়েছে —এমন কোনো উদ্যোগ স্মরণ করতে পারি না। এবারও আমরা অনেক ক্ষেত্রেই পলায়নপর ও দ্বৈত নীতি লক্ষ করলাম। এতে ক্ষতি যেটা হলো তা হচ্ছে, ৩০ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তারা পক্ষপাতমুক্ত হয়ে সুচিন্তিতভাবে সিদ্ধান্ত দিতে পারবেন— এমন ভরসায় একটা চিড় ধরল। রেজা কিবরিয়ার ক্রেডিট কার্ডের নবায়ন ফি না দেওয়া যে ঋণ বা বিলখেলাপির মধ্যে পড়ে না, সেটা বুঝতে না পারা যে নিতান্তই রিটার্নিং কর্মকর্তার অজ্ঞতা, এমনটি মেনে নেওয়া কঠিন। কোনো কোনো মন্ত্রী তাঁর ভূমি বা গচ্ছিত স্বর্ণের দাম ‘জানা যায় না’ লিখেও হলফনামা পূরণ করেছেন। এসব যদি ছোটখাটো ত্রুটি হতে পারে, তাহলে রাজশাহীতে আমিনুল হক তাঁর একটি মামলার বিষয়ে সত্যায়িত কপি দিলেন না বা মুরাদনগরে হলফনামার একটি পৃষ্ঠা না থাকার কারণে মনোনয়নপত্র বাতিল করার মতো বিষয়গুলো ছোটখাটো ত্রুটি গণ্যে সহজে এড়ানো যেত।

দণ্ডিত হিসেবে খালেদা জিয়া নির্বাচনে অযোগ্য হবেন, সেই ধারণা কমবেশি অনেকের কাছেই স্পষ্ট ছিল। কিন্তু রিটার্নিং কর্মকর্তা কেন আইনের ভুল ধারার আওতায় তাঁকে অযোগ্য করলেন, সেটা খুবই জরুরি প্রশ্ন। আর একই ভুল কী করে দুজন রিটার্নিং কর্মকর্তা একই সঙ্গে করলেন? কাকতালীয়? তিনটি আদেশই প্রায় অবিকল একই বাক্যে লেখা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, ফেনী ও বগুড়ার রিটার্নিং কর্মকর্তারা যদি সলাপরামর্শ করেও থাকেন, তাহলে দুজনের অজ্ঞতা বা অসাবধানতা এক হলো কী করে? আপিলের শেষ দিনের সন্ধ্যায় এ বিষয়ে যখন রায় দেওয়া হচ্ছিল, তখন সেখানে আমি উপস্থিত ছিলাম। বিএনপির আইনজীবীদের একটিই পয়েন্ট ছিল: যেহেতু ভুল ধারায় তাঁকে অযোগ্য করা হয়েছে, তাই তার সুফল তাঁরা পাবেন। দুজন রিটার্নিং কর্মকর্তাই গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ১২ঘ-এর বরাত দিয়েছেন। দুজন রিটার্নিং কর্মকর্তা কী করে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে নির্বাচন খরচ মেটানোর দুর্নীতি, ব্যালট পেপার জালিয়াতি, ভোটকেন্দ্রের ৪০০ গজের মধ্যে প্রচারণা চালানো, ভোটদানে বাধা, মনোনয়নপত্র ধ্বংস করা, ভোটকেন্দ্রে অনুপ্রবেশের দায়ে দণ্ডিত হিসেবে মনোনয়ন বাতিল করলেন? এর চেয়েও হাস্যকর হলো, ৮৩ ও ৮৪ ধারায় যথাক্রমে ভোটের গোপনীয়তা রক্ষায় ব্যর্থ ও কোনো ভোটারকে প্রলুব্ধ করলে রিটার্নিং কর্মকর্তার জন্য পাঁচ বছরের জেল আছে। খালেদা জিয়াকে অযোগ্য ঘোষণার ক্ষেত্রে বগুড়া ও ফেনীর রিটার্নিং কর্মকর্তা সেই ধারায় দণ্ডিত হিসেবে বিবেচনা করেছেন। এটা একটা লজ্জা। অবশ্য নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানমকেই শুধু উচ্চারণ করতে শুনলাম, এটি একটি অমিশন বা ভ্রান্তি। কিন্তু তাঁদের রায়ে তার উল্লেখ নেই। মাহবুব তালুকদার অবশ্য ১২ঘ যে খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, সেই বিবেচনায় খালেদা জিয়ার মনোনয়নপত্রের বৈধতার পক্ষে মত দিয়েছেন।

এটা এখন নিশ্চিত হওয়া জরুরি যে আগামী নির্বাচন (স্থানীয় সরকারসহ) বা উপনির্বাচনগুলোতে দণ্ডিত ব্যক্তিদের জন্য কী হবে? যাঁরা নিম্ন আদালতের রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ পাবেন, তাঁরাই কি নির্বাচন করতে পারবেন? এই যুক্তিতে বিএনপিসহ অনেক প্রার্থী টিকেছেন। আবার অনেকে বাদ পড়েছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী আইনজীবী নাজমুল হুদা দণ্ড থাকতেও টিকলেন। নিম্ন আদালতের দেওয়া সাত বছরের সাজা হাইকোর্ট চার বছর করেছেন। তাঁকে ৪৫ দিনের মধ্যে আত্মসমর্পণ করতে হবে। তিনি জামিনে নেই। তিনি আজ নিম্ন আদালতে গেলে তাঁকে কারাগারে যেতেই হবে। দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান নিশ্চিত করেন যে কারাগারে না গিয়ে তিনি আপিল পর্যন্ত করতে পারবেন না। সুতরাং বলা যায়, নাজমুল হুদা দণ্ডিত বৈধ প্রার্থীদের মধ্যে একটি ধ্রুপদি ব্যতিক্রম। তিনি এক অর্থে ঠান্ডা মাথায় আদালতের আদেশ অগ্রাহ্য করছেন। তাঁকে ৪৫ দিন দেওয়ার অর্থ মুক্ত থেকে নির্বাচন করা নয়। সুযোগ পাওয়ামাত্রই তাঁর আত্মসমর্পণ করার কথা। অথচ তা না করে এবং দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল করা থেকে বিরত থেকে তিনি বীরদর্পে নির্বাচন করছেন। তুলনা করলে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বরং তাঁর থেকে যোগ্যতর অবস্থায় আছেন। 

ইকবাল মাহমুদ টুকু টিকলেন না। তাঁর দণ্ড হাইকোর্ট আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত স্থগিত করেছিলেন, এবং সে কারণেই তিনি জামিনে আছেন। কিন্তু তাঁরটা বাতিল হলো। রিটার্নিং কর্মকর্তা ও ইসির রায় পড়লাম। সেখানে দেখলাম না কী কারণে তাঁরা স্থগিতাদেশ বিবেচনায় নিতে পারলেন না। এটা প্রমাণ করে, ইসির আপিল বোর্ড তিন দিনে যত রায় দিয়েছে, সেগুলো সব যথাযথ ব্যাখ্যাসংবলিত না–ও হতে পারে।

প্রশ্ন হচ্ছে, প্রতিটি আলাদা আলাদা নির্বাচনে ও ব্যক্তিভেদে আইনের প্রয়োগ ভিন্ন হতেই থাকবে? সম্প্রতি হাইকোর্টের একটি একক বেঞ্চ একজন প্রার্থীর নিম্ন আদালতের দণ্ডাদেশে স্থগিতাদেশ দিলে অ্যাটর্নি জেনারেল দৌড়ঝাঁপ করে তা বাতিল করালেন। সংবিধান গেল গেল বলে তিনি শোর তুলেছিলেন। কিন্তু বিএনপির নাসের রহমানের দণ্ডাদেশের স্থগিতাদেশ তুলতে তিনি নীরব থাকলেন? আর তাঁকে ছুটতেই–বা হবে কেন? উচ্চ আদালত কি ব্যক্তিকেই প্রতিকার দেন বা নামঞ্জুর করেন? একই নীতি বা আইন সবার জন্য প্রযোজ্য হবে, সেই নিশ্চয়তা কি দেন না? দণ্ডিতদের বিষয়ে সর্বশেষ যে সিদ্ধান্ত আপিল বিভাগ দিলেন, তার পূর্ণাঙ্গ কপি অপ্রকাশিত। তাই এই বিষয়ে আপিল বিভাগের আগের আইন কোথায় কী কারণে উল্টে গেল, নির্দিষ্টভাবে বোঝার উপায় নেই।

ঋণখেলাপির ধাঁধাও আগের মতো টিকে থাকল। ব্যাংকের ২২ হাজার কোটি টাকা নয়ছয় হওয়ার দেশে ঋণখেলাপি প্রার্থীদের অনেকেরই আইনজীবীকে বলতে শুনলাম, মাই লর্ড, আদালতের স্থগিতাদেশ আছে। তাঁরা মানে তাঁরা প্রার্থী। যাঁরা স্থগিতাদেশ পাননি তাঁরা বাদ। এখানেও কোনো সুনির্দিষ্ট নীতি নেই। সভ্য দেশে একটি নির্বাচন হয়, তার সঙ্গে নীতিরও ফয়সালা হয়। গত ১০টি নির্বাচনে অর্থাৎ গড়ে পাঁচ বছরে একটি আইনি প্রশ্নের মীমাংসা হলেও আমরা অন্তত ১০টি প্রশ্নে মীমাংসা পেতাম। কিন্তু তা হলো না।

মিজানুর রহমান খান, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
[email protected]