পুঁজিবাদী উন্নয়নের ফাঁকি ও ফ্রান্সের 'হলুদ জ্যাকেট' বিদ্রোহ

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের সময়। বিক্ষুব্ধ জনতা বাস্তিল দুর্গ আক্রমণ করেছে। এই খবর শুনে সম্রাট ষোড়শ লুই জানতে চেয়েছিলেন, ‘এটি কি একটি বিদ্রোহ?’ জবাবে তাঁকে জানানো হয়েছিল, ‘না সম্রাট, এটি একটি বিপ্লব।’ ফ্রান্সে জ্বালানি তেলের ওপর কর বাড়ানোর প্রতিবাদে শুরু হওয়া আন্দোলনকে ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁও হয়তো একটি ইস্যু নিয়ে একদল মানুষের প্রতিবাদ–বিক্ষোভ ভেবেছিলেন। কিন্তু এই আন্দোলন এখন ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। তেলের দাম কমানোর দাবি ছাপিয়ে এখন দাবি উঠছে,‘ধনীদের সরকার’ হটাও, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পাল্টাও।

জ্বালানি তেলের, বিশেষত ডিজেলের ওপর কর বাড়ানোর প্রতিবাদে গত ১৭ নভেম্বর থেকে ফ্রান্সজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়। আন্দোলনকারীরা সড়ক-মহাসড়কে অবরোধ গড়ে তোলেন। তেলের ডিপো, পেট্রলপাম্পে হামলা চালান, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। তাঁরা হামলা চালান প্যারিসের অভিজাত এলাকার দামি দামি দোকানপাটে, ব্যাংকে। পুড়িয়ে দেন দামি দামি গাড়ি।

ফ্রান্সে প্রত্যেক মোটরচালককে গাড়িতে একটি ফ্লোরসেন্ট হলুদ জ্যাকেট রাখতে হয়। বিক্ষোভকারীরা এই হলুদ জ্যাকেট পরে রাস্তায় নেমেছেন বলে তাঁদের আন্দোলনের নাম হয়েছে হয়েছে ‘জি-লে জু-ন’ (gilets jaunes) বা ‘হলুদ জ্যাকেট’ আন্দোলন। চার সপ্তাহ ধরে আন্দোলন হচ্ছে প্রতি ছুটির দিন, শনিবারে। স্বতঃস্ফূর্ত এই আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সাহায্যে। এর কোনো নেতা নেই।

ফ্রান্সের নানা অঞ্চলের নানা বয়সের, নানা পেশার শ্রমজীবী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোক এই আন্দোলনে যোগ দিচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে আছেন ফ্যাক্টরি শ্রমিক, বেকার, স্বকর্মসংস্থানকারী শিল্পী-কারিগর এবং অবসরভোগী লোকজন। তাঁরা সবাই ফ্রান্সে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে বিপর্যস্ত। শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের দাবি নিয়ে যোগ দিয়েছে হাইস্কুলের শিক্ষার্থীরাও। ফ্রান্সের অতি দক্ষিণপন্থী ও বামপন্থী দলগুলোও আন্দোলনে সমর্থন দিচ্ছে।

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর কারণে আন্দোলন শুরু হলেও এর ব্যাপকতা ও তীব্রতা বৃদ্ধির সঙ্গে বেড়েছে দাবিদাওয়া। তাই সরকার পিছু হটে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত বাতিল করলেও এখন আন্দোলন থামার কোনো লক্ষণ নেই। আন্দোলনকারীরা সরকারের নানা সংস্কার কর্মসূচির বিরুদ্ধে, অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে। আওয়াজ তুলছেন। তাঁরা শুধু মাখোঁ সরকারকে হটাতে চাইছেন না, বদলাতে চাইছেন বৈষম্যভিত্তিক পুরো অর্থনৈতিক ব্যবস্থার। যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কারণে ধনীদের সম্পদ বাড়ছে, কিন্তু কম আয়ের লোকদের আয়-সম্পদ কমছে, জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে। মাখোঁ সরকারকে তাঁরা উল্লেখ করছেন ‘ধনীদের সরকার’ বলে।

আন্দোলন দমন করার জন্য সরকার সারা দেশে প্রায় ৯০ হাজার রায়ট পুলিশ নামিয়েছে। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ওপর লাঠি, গুলি (রাবার বুলেট), কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়েছে নির্বিচারে। শত শত লোককে গ্রেপ্তার করেছে। সংঘর্ষে জখম হয়েছে অগুনতি। মারা গেছেন কয়েকজন।

গত বছর নানা জনমুখী সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তরুণ উদারনৈতিক নেতা এমানুয়েল মাখোঁ ক্ষমতায় আসার পর ফ্রান্সের মানুষের মধ্যে বেশ আশার সঞ্চার হয়েছিল। ক্ষমতায় আসার পরপরই তিনি নমনীয় শ্রমবাজার নীতি গ্রহণ করেন। তাঁর শিক্ষা সংস্কারের ফলে গরিব এলাকার শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব বাড়ানো হয়। অন্যান্য ক্ষেত্রেও তাঁর উদারনৈতিক নীতি প্রশংসিত হয়। কিন্তু শিগগিরই মাখোঁ উপলব্ধি করেন, ফ্রান্সের পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এমন একপর্যায়ে পৌঁছেছে যে উদারনৈতিকতা দিয়ে তা টিঁকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টই শুধু নয়, যেকোনো পুঁজিবাদী দেশের প্রেসিডেন্টেরই ধনীদের প্রেসিডেন্ট না হয়ে টিকে থাকা সম্ভব নয়। তাই মাখোঁর সাম্প্রতিক সংস্কারগুলোয় অনিবার্যভাবে ধনীদের স্বার্থই রক্ষিত হচ্ছে। যেমন: ২০১৮-১৯ সালের বাজেটের বিশ্লেষণ থেকে দেখা যার, এই বাজেটের ফলে কম আয়ের লোকজনের আয় আরও কমেছে এবং মোট জনসংখ্যার যে ৫ শতাংশ লোক সবচেয়ে কম আর করেন, তাঁদের প্রকৃত আয় কমেছে সবচেয়ে বেশি। আর দেশের যে মাত্র ১ শতাংশ লোক গগনচুম্বী আয় করেন, তাঁদের আর বেড়েছে অনেক অনেক গুণ বেশি।

টিভি সিরিয়াল ‘বেওয়াচ’-খ্যাত পামেলা অ্যান্ডারসন যৌনাবেদনময়ী অভিনেত্রী হিসেবে পরিচিত হলেও সম্প্রতি একজন অ্যাকটিভিস্ট হিসেবে তিনি তাঁর সাহসী সদ্‌ভাষণের জন্য গুরুত্ব পাচ্ছেন। প্যারিসে বসবাসকারী পামেলা চলমান আন্দোলন সম্পর্কে বলেছেন, ‘এই বিদ্রোহ বহু বছর যাবৎ ফ্রান্সে ধূমায়িত হচ্ছিল। এটি বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের বিদ্রোহ। ফ্রান্সে ও পাশ্চাত্যের অনেক দেশে বিদ্যমান এই রাজনৈতিক ব্যবস্থা সব সময় ধনীদের পক্ষে ও সাধারণ মানুষের বিপক্ষে।’

জরিপে জানা গেছে, ফ্রান্সের ৭৫ শতাংশ মানুষ এই হলুদ জ্যাকেট আন্দোলন সমর্থন করেন। কারণ, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির বিরুদ্ধে কারণে ফ্রান্সের অধিকাংশ লোকই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

তবে ফ্রান্সের এই আন্দোলন কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ‘ওকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলন, স্পেনের ১৫এম মুভমেন্ট, অথবা পাশ্চাত্যের নানা দেশের পুঁজিবাদবিরোধী আন্দোলন এক সূত্রে গাঁথা। সব আন্দোলনই দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষের আন্দোলন।

বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থা নানা কারণে এমন এক সংকটে নিপতিত হয়েছে, যার ফলে ধনী–গরিবের ব্যবধান অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে এই বৈষম্যের মাত্রাও বাড়ছে। কারণ, প্রযুক্তির মালিকানা সমাজের অতি ধনীদের কুক্ষিগত। তাই আরও আরও মুনাফার পেছনে ছোটা এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পাগলা ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরাই এখন একটা চ্যালেঞ্জ। তেল ও অন্যান্য সম্পদ লুটপাট করা ও অস্ত্র বিক্রির জন্য বিশ্বের দেশে দেশে যুদ্ধ বাধানোর মাশুলও এখন দিতে হচ্ছে। টেররিস্টদের উত্থান ও অভিবাসীদের জনস্রোত এর উদাহরণ।

ফ্রান্সের হলুদ জ্যাকেটধারীদের শনিবারের আন্দোলন বিক্ষুব্ধ জনতার সংঘবদ্ধ শক্তি সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে জানান দিয়ে গেল। তবে নেতৃত্বহীন ও সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্যহীন, স্বতঃস্ফূর্ত এই আন্দোলন বেশি দূর এগোতে পারবে বলে মনে হয় না।

ফরাসি সরকারের জন্য এই আন্দোলন দমন করাও বিশেষ কঠিন হবে না। গত দুই শনিবার প্যারিসের বিখ্যাত সড়ক শঁজে লিজের দুপাশের ভবনগুলোর ছাদে স্নাইপারদের অবস্থান নেওয়া ও আন্দোলনকারী হাইস্কুলের শিক্ষার্থীদের প্রতি পুলিশের আচরণ থেকে বোঝা যায়, আন্দোলন দমনে তারা যেকোনো নির্মমতার আশ্রয় নিতে পিছপা হবে না।

কিন্তু এই আন্দোলন থেমে গেলেও শেষ হবে না, বারবার ফিরে আসবে। ফ্রান্সে না হলে অন্য দেশে, ভিন্ন রূপে। ইতিমধ্যে গত শনিবার ব্রাসেলসে হলুদ জ্যাকেট পরে একদল বিক্ষোভকারী ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদর দপ্তরে চড়াও হয়েছেন। নেদারল্যান্ডসেও এই আন্দোলনের আঁচ লাগছে। এমনকি সুদূর ইরাকের বসরায় বিক্ষোভকারীরা নানা দাবিতে গায়ে হলুদ কোর্তা চাপিয়ে রাস্তায় নেমেছেন।

গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অতি দক্ষিণপন্থী লু পেন ও বামপন্থী জ্যা লি-ক মিলাঁশা প্রচুর ভোট পেয়েছেন। এর অর্থ হলো বর্তমান সমস্যা সমাধানের জন্য ফ্রান্সের জনগণ অতি ডান জাতীয়তাবাদ বা বাম দিকে ঝুঁকতে পারে। প্রেসিডেন্ট মাঁখোও তা বিলক্ষণ বুঝতে পারছেন। তাই অতি জাতীয়তাবাদীদের তুষ্ট করতে তিনি সম্প্রতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসিদের দালাল ও উগ্র জাতীয়তাবাদী ফিলিপে পেতাকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বীরযোদ্ধা হিসেবে প্রশংসা করেন।

পুঁজিবাদের সাম্প্রতিক সংকট থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ভবিষ্যতে ফ্রান্সের জনগণ উগ্র জাতীয়তাবাদী কট্টর দক্ষিণ পন্থার দিকে ঝুঁকলে তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ, বামপন্থার বিকল্প হিসেবে সেটি করপোরেট প্রভুদের কাছেও অধিক গ্রহণযোগ্য হবে। কিন্তু ফ্রান্সের জনগণের জন্য সেটি হবে ‘ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুলায় ঝাঁপ দেওয়ার’ শামিল।

তাতে সমস্যা জটিল ও ভয়াবহ হয়ে কেমন একটা লেজেগোবরে অবস্থা তৈরি হবে, যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসন থাকে এর আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

সর্বশেষ গত রাতে ফরাসি প্রেসিডেন্ট মাখোঁ আন্দোলনকারীদের অনেক দাবি যৌক্তিক বলে স্বীকার করেছেন এবং নিম্নতম মজুরি বৃদ্ধি, কিছু কর বাতিলসহ বেশ কিছু নতুন ছাড় দিয়েছেন। এখন দেখা যাক আগামী শনিবার কী ঘটে।

চৌধুরী মুফাদ আহমদ, প্রাবন্ধিক
[email protected]