বিধি লঙ্ঘন রুখতে হবে

নির্বাচন কমিশন
নির্বাচন কমিশন

১১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় টেলিভিশনের খবরে ঠাকুরগাঁও, বগুড়া ও অন্য আরেক জায়গায় গাড়িবহরে হামলার অভিযোগের কথা জানলাম। এক সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার বক্তব্য ছিল অনেকটা এই গোছের, লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্ত করা হবে। মনে হলো, ভাবখানা যেন তথ্যপ্রমাণ দিয়ে কেউ অভিযোগ করলে প্রাথমিক তদন্ত করা হবে, যাচাই-বাছাই করে দেখা হবে, রিপোর্ট দেওয়া হবে, তারপর পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে। ভাবলাম, এসব করতে করতে ৩০ ডিসেম্বর না পার হয়ে যায়।

মাস দুয়েক আগে বহু নাগরিকের মনে অংশীদারিমূলক নির্বাচনের ব্যাপারে প্রচণ্ড সন্দেহ ছিল।

ঐক্যফ্রন্ট গঠন, প্রধানমন্ত্রীর সংলাপ এবং তাতে দলে দলে অংশগ্রহণ, ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা হিসেবে ড. কামাল হোসেনের ভূমিকা এবং ব্যক্তিগতভাবে তাঁর নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত এবং একই সঙ্গে ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে বিএনপিসহ অন্য অনেক দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রত্যয়ে অংশীদারিমূলক নির্বাচন এখন নিশ্চিত হয়েছে। নির্বাচন হবে, জনগণ ভোট দিতেও যাবে। তবে নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও অবাধ করতে হবে।

সফল নির্বাচনের তিন বড় পক্ষ—সরকার, রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন কমিশন। এই তিন পক্ষের মধ্যে প্রথম দুই পক্ষ তাদের দায়িত্বের বেশির ভাগই ইতিমধ্যে পালন করা শুরু করে দিয়েছে। নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু হয়, এই মুহূর্ত থেকে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত তার বিরাট গুরুদায়িত্ব এখন নির্বাচন কমিশনের কাঁধে। এ সময়ে সবচেয়ে বড় বাধা আচরণবিধি লঙ্ঘন। এই বড় বাধাটা দূর করতে হবে এবং আচরণবিধি লঙ্ঘন কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। প্রথম রাতেই বিড়াল না মারলে সবকিছু ভন্ডুল হয়ে যেতে পারে।

সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা, ২০০৮-এ সভা-সমিতি-অনুষ্ঠানসংক্রান্ত; পোস্টার ও লিফলেট; যানবাহন ব্যবহার; দেয়াল লিখন; উসকানিমূলক বক্তব্য; মাইকের ব্যবহার; প্রচারণার সময়; নির্বাচনী ব্যয়সীমা ইত্যাদি সংক্রান্ত নিয়মকানুন এবং বিভিন্ন বাধানিষেধ স্পষ্টভাবে বলা আছে। সবাই এগুলো মেনে চললেই নির্বাচনটা সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে। এই বিধিমালার ১৭ ধারায় বলা আছে, এসব বাধানিষেধ লঙ্ঘন বা অমান্য করলে তা হবে নির্বাচনপূর্ব অনিয়ম। এই বিধিতেই বলা আছে যে নির্বাচন কমিশন ‘কোন তথ্যের ভিত্তিতে বা অন্য কোনভাবে কমিশনের নিকট কোন নির্বাচন-পূর্ব অনিয়ম দৃষ্টিগোচর হইলে, কমিশন...’ এসব বিধি লঙ্ঘনের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় আদেশ দিতে পারেন। স্পষ্টতই লিখিত অভিযোগের জন্য নির্বাচন কমিশনের বসে থাকলে চলবে না। দেশের বেশ কয়েকটি নিউজ চ্যানেল ও পত্রপত্রিকাসহ অন্যান্য সংবাদমাধ্যমে একই লঙ্ঘনের খবর পাওয়া গেলে নির্বাচন কমিশন তার ভিত্তিতেই ব্যবস্থা নিতে পারে।

দিন দশেক আগে, ‘আচরণবিধি বেড়াতে গেছে’ শিরোনামে প্রথম আলোয় যা লিখেছিলাম, তার কিছুটা হলেও পুনরাবৃত্তি হয়তো হবে, তবু বলব, আচরণ-বিধিমালা প্রচার করতে হবে। বিধিমালা লঙ্ঘনের জন্য নির্বাচন কমিশন ইতিমধ্যে দুজন করে বিচারকের সমন্বয়ে যে ১২২টি নির্বাচনী তদন্ত কমিটি গঠন করেছে, তার তালিকা জনগণকে জানাতে হবে। সবাই জানবে, কোন এলাকার বিধিমালা লঙ্ঘনের জন্য কার কাছে যেতে হবে।

বিধিমালার লঙ্ঘন রুখতে সবাইকে উদ্যোগী হতে হবে, লঙ্ঘনের শাস্তি ৬ মাস কারাদণ্ড অথবা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড। শাস্তিটা কত বড়, সেটা কথা নয়। এক মাসের কারাদণ্ড বা ৫ হাজার টাকা জরিমানাই হোক, শাস্তি যা-ই হোক না কেন, সেটা গৌণ। মুখ্য হলো, শাস্তির একটা ব্যবস্থা অবশ্যই করতে হবে এবং সেটা তড়িৎ গতিতে।

খোদ প্রধান নির্বাচন কমিশনার এই ১২২টি নির্বাচনী তদন্ত কমিটির নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে কয়েক দিন আগে খেদ প্রকাশ করেছিলেন। সেটাই যথেষ্ট নয়। তদন্ত কমিটিগুলোকে সক্রিয় হতে হবে। তদন্ত কমিটিগুলো অধস্তন আদালতের তুলনামূলকভাবে কম বয়োজ্যেষ্ঠ বিচারকদের নিয়ে গঠিত। প্রথাগত বিচারব্যবস্থা অনুসরণ করে, অর্থাৎ অভিযোগপত্র পাওয়া, অভিযোগকারী সাক্ষীসাবুত নিয়ে হাজির হলে তারপর লম্বা শুনানি, সবকিছু যাচাই-বাছাই ও পরীক্ষা করা, তারপর বিস্তারিত রায় লেখা—এই ঐতিহাসিক পথে চললে নির্বাচন বিপথে চলে যাবে। দেশের এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে এই কমিটিগুলোকে উদ্যমী ও উদ্যোগী হতে হবে। গাড়ির কাচ ভেঙেছে কি না, ইটপাটকেল পড়েছে কি না, সেটা দেখতে ও বুঝতে গভীর তদন্তের প্রয়োজন পড়ে না। এই বিচারকেরা বেশ কয়েক বছর বিচার করেছেন, এবারের বিচার গতিশীল ও ফলপ্রসূ হতে হবে। সময় বেঁধে দেওয়া আছে তিন দিন। এখানে মামলার জট হলে সুষ্ঠু নির্বাচন অত্যন্ত দুরূহ হয়ে পড়বে।

ড. শাহদীন মালিক: বাংলাদেশ, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের আইনের শিক্ষক