মাইনফিল্ডে সাবধানে পা ফেলুন

ভিকারুননিসা বিদ্যালয়ের ভেতরের দেয়ালে ছাত্রীদের আঁকা এই চিত্রটিতে জলদস্যু অভিযানের গল্পের ছায়া পড়েছে। পরীক্ষায় সাফল্য নামক গুপ্তধন পাওয়ার পথে Exams (পরীক্ষা), Pressure (চাপ), Anxiety (উদ্বেগ), Stress (মানসিক চাপ) এর ছবি এঁকে রেখেছে তারা। ছবি: মানসুরা হোসাইন
ভিকারুননিসা বিদ্যালয়ের ভেতরের দেয়ালে ছাত্রীদের আঁকা এই চিত্রটিতে জলদস্যু অভিযানের গল্পের ছায়া পড়েছে। পরীক্ষায় সাফল্য নামক গুপ্তধন পাওয়ার পথে Exams (পরীক্ষা), Pressure (চাপ), Anxiety (উদ্বেগ), Stress (মানসিক চাপ) এর ছবি এঁকে রেখেছে তারা। ছবি: মানসুরা হোসাইন

সমাজের মৃত্যু হলে যা পড়ে থাকে, তা হলো এক বিপজ্জনক মাইনফিল্ড। অরিত্রীর ঘটনা আবারও তা জানাল। বার্তা এল, ‘সেইভ আওয়ার সৌলস’। একেকটি বিস্ফোরণ ঘটছে আর মনে করিয়ে দিচ্ছে, মানবজমিনের তলায় কত বিস্ফোরকই–না জমেছে। কখন, কোথায়, কার মন বিস্ফোরিত হবে আর ঘটবে মর্মান্তিক কোনো ঘটনা, তা আগাম বলা অসম্ভব। কার মন কোন ঘটনায় ফাটবে, তার পরিণতিতে নিজের বা অপরের কত বড় ক্ষতি হবে, তা জানারও সুযোগ কম। এখানে কেবল ব্যক্তিকে দুষে বেশি দূর যাওয়া যাবে না।

দরকার ছিল বিষয়টাকে ফৌজদারি মামলা হিসেবে না দেখে সমাজ ও শিক্ষা প্রশাসনের হালচাল বদলানোর আলোচনার দিকে নিয়ে যাওয়া। তার বদলে অরিত্রী আর তার শিক্ষকদের মধ্যে কার কী দায়, সেই বিচারে বসলেন অনেকে। এই ধুলোঝড়ে সামগ্রিক শিক্ষাপদ্ধতি এবং পরিবার ও শিশুমনের দুরবস্থা নিয়ে কথা এগোল কম।

একের পর এক ঘটনায় তো টের পাচ্ছি, সমাজটা ভালো নেই। ঘরে ঘরে সংকট। এ সমাজের কোনো সংস্কার গত ১০০ বছরে হয়নি। পুরনো রীতিনীতি ধসে যাচ্ছে, নতুন সুনীতিরও দেখা নেই। সবই কাঁচা, পাকা কেবল দোষ চাপানোর ঘাড় খোঁজার বুদ্ধি। জোরদার ভুলে যাওয়ার অভ্যাস। তাই সড়কে নিরাপত্তার মতোই শিক্ষার মান ও প্রশাসন উন্নত করার দাবিটাও হারিয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। তলার দিকের এক শিক্ষককে জেলে নেওয়া আর ভিকারুননিসা স্কুলের নাম বদলানোর কথা তোলা থেকেই বোঝা যাচ্ছে, বিষয়টা ভিন্নখাতে নিতে খুব মেধা–বুদ্ধি খরচ করা হচ্ছে!

মাইরের বিষে বানানো ওষুধ!
স্কুলে অপমান-শাস্তি নিয়ে তর্ক হচ্ছে খুব। ‘মাইরের ওপর ওষুধ নাই’—প্রবাদটা চালু হয়েছিল সাবালক বেয়াড়া লোকের জন্য। শিশুদের শাস্তির পক্ষে সেই প্রবাদের ব্যবহার মানা যায় না। মাইরের বিষে বানানো ওষুধে ভরসা করা মানে মারামারিটা ছোট থেকে বড় সবার জগতেই জারি রাখা। যাঁরা ছোটবেলায় মার খেয়ে বড় হয়ে ‘মাইর দেওয়ার’ গুণ গাইছেন, তাঁরা নিজেরাই সমস্যাটার প্রামাণিক নমুনা। নিপীড়ন সইতে সইতে একসময় হয়তো তাঁরা এর ভক্ত হয়ে গেছেন। এই শক্তের ভক্তরাই হচ্ছেন নরমের (শিশুর) যম। নিপীড়নে শুধু কেউ কষ্টই পায় না, তার ভেতরকার মানবসত্তাটা দুমড়েমুচড়ে তার দুটি পরিণতি হতে পারে: হয় সে হবে ভীরু ও আত্মবিশ্বাসহীন, নয়তো তার মধ্যে বাসা বাঁধবে নিপীড়ক মানসিকতা।

এ ধরনের মনোভাব কায়েম আছে বলেই ঘরে বা রাস্তায় বা রাষ্ট্রের কোনো সমস্যার সমাধান মারামারি ছাড়া করতে পারি কি? ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টে আমাদের এই একটাই ওষুধ: মারো, মেরে শিখাও, বাধ্য করো, রিমান্ডে নাও, ফাঁসি দাও, জেলে ভরো, টিসি দাও, শরীরকে কষ্ট দিয়ে সোজা করো।

‘ডেথ অব দ্য সোশ্যাল’
আমরা যারা ছোটবেলায় মার খেয়েও মরে যাইনি, তাদের জীবনে অনেক আশ্রয় ছিল। চাচাতো-মামাতো-খালাতো এবং পাড়াতো মিলে অনেক ভাইবোন ছিল। পাশের বাড়িতে এমন নানা-নানি-ফুপু-মামা-ভাইবোন ছিলেন, যাঁরা কেউ রক্তের সম্পর্কের না। বাবা পেটালে সেই নানি বা মামা এসে বাঁচাতেন। ফুপু গল্পের বই পড়াতেন, মামা দিতেন ক্যারাতে ট্রেনিং। মানুষগুলোও ছিলেন অনেক মানবিক। আমার গরুর রাখাল টিউটর, অন্ধ মুয়াজ্জিন হুজুর কিংবা বাবার সাইটের ম্যানেজার-রাজমিস্ত্রি-সাবকনট্রাক্টররাও ছিলেন অনেক কিছুর ভরসা। আর ছিল প্রকৃতির আশ্রয়। স্কুল-কলেজের কোনো শিক্ষককেই নিষ্ঠুর মনে হয়নি। মারলেও আবার ফিরে আদর দিতেন, হায়-আফসোস করতেন। যদি কোনো নির্দয়ের পাল্লায়ও পড়ি, দয়াবান কারও পরশে মনের ক্ষত মুছে যেত। ছিল বিরাট বন্ধুমহল এবং তাদের ঘরদোরে অবাধ যাতায়াত ও আপনকীয়া সম্পর্ক। তা ছাড়া আশি-নব্বই দশকের শিশু-কিশোরেরা জগতের এত আনন্দ-নেশার ক্ষতিকর হাতছানির মুখে উন্মুক্ত ছিল না। আগলে রাখার মতো পরিবার ও সমাজ তাদের কাছাকাছিই ছিল।

আজকের শিশুর কী আছে? মা-বাবা জীবন-জীবিকা নিয়ে পেরেশান, কারও কোনো টাইম নেই। শিক্ষকেরা নিজেরাও এই পরিস্থিতির শিকার। অরিত্রীর গল্পে শুধু এই অবুঝ মেয়েটি না, তার বাবা–মা, তার শিক্ষক, কেউই কি আমাদের দেশের অমানবিক বাস্তবতার বাইরে? যন্ত্র আর যান্ত্রিক নগর-প্রতিষ্ঠানের হাতে শিশুরাই সবচেয়ে খারাপ আছে। ডিজিটাল স্ক্রিনের বরাতে তারা বিভিন্ন রকম ভায়োলেন্সের দৃশ্য আর ভোগবিকারের সামনে অরক্ষিত তারা। তারা যে জীবন মোকাবিলার ঘাতসহ মন পাবে, তার কোনো উপায়ই রাখা হয়নি। তারা সর্বংসহা হবে, এমন আশা তাই দুরাশা মাত্র। তো এই ‘ফার্মের মুরগি’রা সুপারকিডের মতো সুপার মনোবল দেখাক, এমন দাবি আমরা কী করে করি?

ক্ষমতার বিকার ও সামাজিক ক্যানিবালিজম
এই দেশে সামাজিকতার জায়গা নিয়েছে ক্ষমতাকারিতা। যাঁর হাতে যেটুকু ক্ষমতা, সেটা দিয়ে তিনি অন্যকে কষ্ট দিচ্ছেন। অফিসে বা বাড়িতে বড় ক্ষমতা ছোট ক্ষমতাকে চাপে ফেলছে। রাস্তাঘাট থেকে মনের অন্দরমহল, সবখানেই ক্ষমতার বিকার, প্রতিযোগিতা, অপরের প্রতি ভয়-বিদ্বেষ। এ অবস্থায় মানুষ মানুষকে কষ্ট দেয়; হোক তা ইচ্ছা করে বা বাধ্য হয়ে বা না জেনে। এটা একটা সামাজিক রোগ। মনোরোগের শিকার হয়ে মানুষ মানুষখেকো হয়ে উঠতে পারে, তেমনই বিকারগ্রস্ত সমাজে চলতে পারে সাধারণের দ্বারা সাধারণকে কষ্টদান। এটা একধরনের সামাজিক ক্যানিবালিজম, যেখানে সবাই হতে পারে সবার ভিকটিম।

বাচ্চাকাচ্চাকে বড়দের বিভিন্ন রকম চাহিদা মেটানোর বস্তু ভাবাও সমস্যা। অভিভাবক ও শিক্ষকেরা চান তারা মনের মতো চলে তাঁদের আনন্দ দিক, তারা পরিবারের গর্বের সাইনবোর্ড বহন করুক, তারা কাঙ্ক্ষিত উপায়ে ‘সফলতা’ এনে দিক। এ লক্ষ্যে চলবে তাদের টার্গেট করে ব্যবসা-বিনোদন আর শাসন–ত্রাসনের পেশাদারি আয়োজন। ওই সব ব্যাপারের ব্যাপারীদের হাতেই তো রাখছি শিশুদের, তাই না? একশ্রেণির শিক্ষক, চিকিৎসক, কোচ, হুজুর ইত্যাদির খুব ‘পাওয়ার’ শিশুদের ওপর। হয়তো এ ধরনের পাওয়ারফুলরা সংখ্যায় কম, কিন্তু প্রতাপ ও প্রভাবে তাঁরাই বেশি। এভাবে আত্মাহীন পুঁজিবাদ যখন শৈশবের ওপর টাকা, ক্ষমতা বা ভোগের উপনিবেশ বানায়, তখন কী হয় শিশু-কিশোরদের অবস্থা?

বাচ্চারা রেসের ঘোড়া নয়
আমরা এসব জানতে চাই না। আমাদের দেশে যদি সব ব্যক্তির মর্যাদা ও স্বাধীনতা ও অধিকার সুরক্ষিত থাকত, তাহলে শিশুদেরও আমরা ব্যক্তি হিসেবে দেখতাম। তাদের ইচ্ছা ও ভালো-মন্দ লাগাকে গুরুত্ব দিতাম। তাদের মনের কথা জানতে চাইতাম। ইউরোপ–আমেরিকা এ নিয়মে যতটা চলে, ততটাই আমাদের থেকে এগিয়ে। আমরা তা দিতে পারি না বলেই শিশুরা গুটিয়ে যায়, মনের কথা লুকায় এবং বুকে জমে আত্মনাশা বারুদ। যদি সব বুঝতাম এবং মানতাম, তাহলে এ রকম শিশুবিরোধী ঘরবাড়ি-শহর-গ্রাম-পরিবেশ-রাষ্ট্র বানিয়ে রাখতাম না। টের পেতাম সমাজ নামক মাইনফিল্ডে আমরা খুব বেসাবধানে পা ফেলছি।

ভালো স্কুলগুলো অনেকটাই এখন বাণিজ্য আর ক্ষমতার কেন্দ্র। ভর্তি ও বেতনের বিপুল টাকা, ভর্তি ও কোচিংয়ের বিপুল বাণিজ্য, স্কুল কমিটিকে দখলে রেখে এমপি-নেতার প্রভাব বাড়ানো, চাকরিতে নিয়োগ-বাণিজ্য, প্রশ্নপত্র ফাঁসের ব্যবসা কী হচ্ছে না স্কুল-কলেজে? স্কুল প্রশাসনকে ব্যবসা ও মাফিয়ার আসরমুক্ত করতে হবে। ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক-মানসিক কষ্টদান শিক্ষা ও মানবিকতার বিরুদ্ধে বলে চিহ্নিত করতে হবে। এ ব্যাপারে যে আইন আছে, তার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। বাচ্চাদের বিনিয়োগ ভাবা চলবে না, তাদের রেসের ঘোড়ার মতো প্রতিযোগিতার মাঠে ছোটানো বন্ধ করতে হবে। নইলে সারা দেশে জানিয়ে দিতে হবে, যা–ই ঘটুক, ‘কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়’। 

এসব থেকে দৃষ্টি সরিয়ে একজন অরিত্রীকে দোষানো কিংবা ক্ষমতার সিঁড়ির অনেক নিচে থাকা দুই-তিনজন শিক্ষককে ভিলেন ভেবে আসলে আমরা কাকে বাঁচাচ্ছি?   

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]