কমিশনের স্বচ্ছতা ও দৃঢ়তা বজায় থাকুক

আমার আগের নির্বাচন-সংক্রান্ত অনেক লেখায় বলেছি, ২০১৮ সালের নির্বাচন নানাবিধ কারণে বেশ জটিল হবে। নির্বাচনকালীন সরকার এবং সর্বোপরি যারা সাংবিধানিকভাবে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে, সেই প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন। জটিলতার অনেক উদাহরণ ইতিমধ্যেই তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে প্রধান বিষয় বহুল আলোচিত নির্বাচনকালীন সরকার। কী হবে সেই সরকারের কাঠামো এবং তাদের কার্যপরিধিই–বা কেমন হবে? এসব প্রশ্নের কারণ উপমহাদেশের কোথাও সংসদ বহাল রেখে এবং অপরিবর্তিত মন্ত্রিসভা নিয়ে নির্বাচন হয় না। অন্যান্য দেশে সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার এবং বিলুপ্তির পর চলতি সরকারের ছোট আকারে গঠিত সরকারের তত্ত্বাবধানেই সরকার পরিচালিত হয় এবং নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে নির্বাচন পরিচালনা করে থাকে।

ব্রিটেনে সংসদের মেয়াদ স্থির ছিল না, তবে ২০১১ সালে পাঁচ বছর অন্তর সংসদ শেষ দিনের মধ্যরাতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং বিলুপ্তির ১৭ দিনের মাথায় পরবর্তী নির্বাচন হয়। কেবিনেট রানির কাছে পদত্যাগপত্র দিলে ওই সরকারকেই ছোট সরকার গঠন করে নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে পুনর্নিয়োগ দেওয়া হয়। ব্রিটেনে উল্লিখিত অ্যাক্টের সঙ্গেই নির্ধারিত তফসিল ঘোষিত রয়েছে, আলাদা করে তফসিল ঘোষণা করা হয় না; শুধু মধ্যবর্তী নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হয়। ব্রিটেনে নির্বাচন কমিশন শুধু নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে এবং ফলাফলও ঘোষিত হয় সেখান থেকেই।

উপমহাদেশে স্বাধীন নির্বাচন কমিশনগুলোই সম্পূর্ণ নির্বাচন পরিচালনা করে থাকে মাঠ প্রশাসনের মাধ্যমে। এই সব নিয়োগের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে রিটার্নিং কর্মকর্তা (আরও)। উপমহাদেশের দেশগুলোতে ক্ষেত্রবিশেষে নিজস্ব অথবা বেসামরিক প্রশাসন এবং কয়েকটি দেশে বিচার বিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এই উপমহাদেশে শুধু বাংলাদেশেই নির্বাচন কমিশন, যার বিশাল কর্মী বাহিনী রয়েছে এবং এখন উপজেলা পর্যন্ত রয়েছে বিশেষায়িত নিজস্ব অফিস। তা ছাড়া, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় অ্যাক্ট ২০০৯-এর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন কাঠামোগত, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এবং বাজেটের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বাধীন, যা অনেক নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারবহির্ভূত। কাজেই বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন আক্ষরিক অর্থে স্বাধীন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক সংস্থা। সংবিধানের ধারা ১১৯-এর মাধ্যমে অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সর্বময় ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

উল্লিখিত সাংবিধানিক ধারা এবং অন্যান্য ধারাবলেও জনপ্রতিনিধিত্ব অাদেশের প্রেক্ষাপটে নির্বাচনকালে মাঠপর্যায় থেকে সরকার পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা; বিশেষ করে মাঠপর্যায়ে নিয়োজিত রিটার্নিং কর্মকর্তা থেকে ভোটকেন্দ্রের সাধারণ আনসার পর্যন্ত।ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশন ৬৬ জন রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছে। মূলত ডেপুটি কমিশনারদের (ডিসি) রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে; যে ব্যবস্থা স্বাধীনতার আগে থেকে বহাল রয়েছে। বর্তমানের নির্বাচন ব্যবস্থাপনা আগের তুলনায় বেশ জটিল। যার কারণে একজন রিটার্নিং কর্মকর্তার পক্ষে অনেকগুলো নির্বাচনী আসন এবং বহু প্রার্থীকে সমানভাবে নিরীক্ষণ ও তদারকি করতে হিমশিম খেতে হয়। উপমহাদেশের অন্যান্য দেশে প্রতিটি সংসদীয় আসনের জন্য একজন রিটার্নিং কর্মকর্তাকে নিয়োগ করা হয়। ভারত ছাড়া পাকিস্তান ও নেপালে জেলার বিচার বিভাগের কর্মকর্তাদেরই রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে পাকিস্তানে কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাদেরও নিয়োগ দেওয়া হয়।

বাংলাদেশের নির্বাচনী আইন গণপ্রতিনিধিত্ব অাদেশ ১৯৭২ ধারা ৭ (১)-এ প্রতি সংসদীয় আসনের জন্য একজন অথবা দুটির অধিক আসনের জন্য একজনের নিয়োগের উল্লেখ রয়েছে। কাজেই একটি জেলায় একাধিক অথবা প্রতিটি আসনে একজন রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগের বিধান থাকলেও স্বাধীনতার পর থেকে এ ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়নি; এমনকি নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব প্রশিক্ষিত লোকবল থাকা সত্ত্বেও এ পর্যন্ত জাতীয় নির্বাচনে নিয়োজিত হয়নি। অবশ্য ২০০৮ সালের পর উপনির্বাচন এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তা নিয়োগ শুরু হয়।

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যে পরিবেশে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, তা অতীতের যেকোনো নির্বাচন থেকে (১৯৯১-২০১৪) ভিন্ন। সংসদ বহাল অবস্থায় অত্যন্ত শক্তিশালী সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশনের সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা, বিশেষ করে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের দায়িত্ব সম্পাদন করতে হচ্ছে। এর কিছু প্রতিফলন দেখা গেছে রিটার্নিং কর্মকর্তা কর্তৃক রেকর্ড পরিমাণ প্রার্থী বাতিলের মধ্য দিয়ে। এতসংখ্যক প্রার্থী বাতিলের যে মেরুকরণ দৃশ্যমান হয়েছিল, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য দলের বিদ্রোহী, স্বতন্ত্র প্রার্থী এবং বিএনপির প্রার্থী। প্রাথমিক বাছাইয়ে এ চিত্র ফুটে ওঠায় নির্বাচনী পরিবেশ বাদানুবাদে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল এবং এর চাপ পড়েছিল খোদ নির্বাচন কমিশনের ওপর। কারণ, একমাত্র বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনই (উপমহাদেশে) আপিল আদালত হিসেবে আপিল গ্রহণ ও নিষ্পত্তি করার আইনগত ক্ষমতা রাখে। এরই ধারাবাহিকতায় নির্বাচন কমিশনে ৫৪৩ জন প্রার্থী বাতিলের এবং গ্রহণের বিরুদ্ধে আপিল করেছিলেন। তিন দিন বিরামহীন শুনানির পর গৃহীত সিদ্ধান্তে ২৪৩ জনকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে।

নির্বাচন কমিশনকে তিন দিনের শুনানিতে ৫৪৩টি আপিলের নিষ্পত্তি করতে হয়েছে, তার মানে প্রতিদিন গড়পড়তা ১৮১টি আপিল শুনতে হয়েছে, যার জন্য শুধু ধৈর্যেরই নয়, একাগ্রতার প্রয়োজন রয়েছে। তা ছাড়া, বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশের মধ্যে কাজটি সহজ ছিল না। বর্তমান নির্বাচন কমিশন এ ক্ষেত্রে সফল হয়েছে এবং ধন্যবাদ পাওয়ার অধিকারী। তবে এই পরিস্থিতির জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের উদাসীনতা এবং আইনের সঠিক ব্যাখ্যা ও সিদ্ধান্তহীনতা দায়ী। যেসব কারণে মনোনয়ন বাতিল হয়েছে বলে প্রকাশ, তার অনেকটাই আরপিও-১৯৭২-এর ধারা ১৪ (১) (ডি) (ii)এর পরিপন্থী বলে মনে করা যায়। ধারাটি হয় রিটার্নিং কর্মকর্তারা সঠিক প্রয়োগ করেননি, অথবা একটি গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।

উল্লিখিত ধারাটিতে উল্লেখ রয়েছে যে, যেসব ত্রুটি মনোনয়নপত্রে মূলগত (Subetential) পরিবর্তন আনবে না এবং যা তাৎক্ষণিকভাবে সংশোধনযোগ্য, ওই সব কারণে মনোনয়নপত্র বাতিল না করা। কিন্তু পত্রিকা পর্যালোচনায় দেখা যায় যে এ ধরনের ভুলের জন্য প্রচুর মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছিল; যার কারণে বাড়তি চাপ পড়েছে নির্বাচন কমিশনের ওপর। তবে দু-একটি ক্ষেত্রে রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্ত সঠিক মনে হলেও নির্বাচন কমিশন কর্তৃক গৃহীত হয়েছে। তবে এমন ধরনের গ্রহণের কারণ কী, তার ব্যাখ্যা নির্বাচন কমিশনই দিতে পারবে।

যা হোক এতসংখ্যক মনোনয়নপত্র বাতিল এবং বৈধতা পাওয়ার বিষয়গুলো খতিয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড একদিকে মাঠপর্যায়ের সামঞ্জস্যহীনতার পরিচয়, তেমনি আইনের স্পষ্টীকরণের অভাব মনে হয়। কমিশন এসব বাতিল এবং পরে এতসংখ্যক বৈধতার রিটার্নিং কর্মকর্তা পর্যায়ের কারণগুলো খতিয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে এ কারণে যে, এসব বাতিল করা মনোনয়ন, যা নির্বাচন কমিশনে বৈধতা পেয়েছে। যেগুলোর পেছনে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের অনভিজ্ঞতা, খামখেয়ালি অথবা অন্য কোনো অজ্ঞাত কারণ রয়েছে কি না। খামখেয়ালি অথবা অন্য কোনো অজ্ঞাত কারণ থাকলে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।

নির্বাচন কমিশন অবশ্য শুনানি এবং কার্যকরভাবে সিদ্ধান্তসহ নিষ্পত্তি যেভাবে করেছে, তার জন্য অনেক ধন্যবাদ। আশা করা যায়, নির্বাচন কমিশন তাদের ক্ষমতার সঠিক প্রয়োগ করে সুষ্ঠুভাবে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করবে। এতটুকুই জাতি নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে প্রত্যাশা করে।

ড. এম সাখাওয়াত হোসেন, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক
[email protected]