'আমি না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কোরো'

১৯৭১ সালে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে জুলফিকার আলী ভুট্টো
১৯৭১ সালে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে জুলফিকার আলী ভুট্টো
>

১৯৭১ নিয়ে পাকিস্তানি লেখকদের মধ্যে দ্বিবিধ প্রবণতা লক্ষ করা যায়। একশ্রেণির পাকিস্তানি লেখক যেকোনো অবস্থায় শাসকদের সব অপকর্মের সাফাই গেয়েছেন। আরেক শ্রেণির লেখক পাকিস্তানি ‘মন’ নিয়েও সত্যাসত্য বিচারের চেষ্টা করেছেন। ইকবাল আখুন্দ ছিলেন দ্বিতীয় শ্রেণির লেখক। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয় পর্বে তিনি কায়রো ও বেলগ্রেডে তাঁর দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই মেমোয়ারস অব আ বাইস্ট্যান্ডার: আ লাইফ ইন ডিপ্লোমেসি এবং আরও কিছু গবেষণামূলক বইয়ের আলোকে এই ধারাবাহিকের শেষ কিস্তি ছাপা হলো আজ।

মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগের সাবেক কর্মকর্তা ডেনিস কক্স, যিনি ১৯৪১ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের গণতন্ত্র নিয়ে গবেষণা করেছেন, তিনি একাত্তরে দেশটির বাংলাদেশ নীতিতে হতবাক হয়েছেন। পূর্ব পাকিস্তানে হত্যাযজ্ঞ শুরুর পর ২৭ এপ্রিল চীনা নেতা চৌ এন লাই যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত আগা শাহির মাধ্যমে একটি বার্তা পাঠান; যাতে মার্কিন প্রতিনিধিকে পাকিস্তান ও চীন সফরের আমন্ত্রণ ছিল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কিসিঞ্জার পাকিস্তান হয়ে গোপনে চীন সফর করেন। বাংলাদেশের সংকট উত্তরণে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত এল কে ঝাঁ যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চাইলে কিসিঞ্জার সরাসরি জানিয়ে দেন, ‘আমরা চীনের বিরুদ্ধে তোমাকে সহায়তা করতে অপারগ।’

কিন্তু তারা পাকিস্তানকেও কার্যকর কোনো সহায়তা করতে পেরেছে বলে মনে হয় না। জর্ডান ও ইন্দোনেশিয়ার মাধ্যমে কিছু অস্ত্র পাঠানোর বাইরে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সামরিক সহায়তা দিতে পারেনি। যুদ্ধের একেবারে শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্র যে বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিল, তার উদ্দেশ্য যুদ্ধে শরিক হওয়া নয়। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিজের শক্তি প্রদর্শন। সোভিয়েত ইউনিয়ন অষ্টম নৌবহর পাঠালে যুক্তরাষ্ট্র পিছু হটে। পাকিস্তানের শেষ আশাটিও হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। শেষ দিন পর্যন্ত ইয়াহিয়া খান আশা করছিলেন, চীন ও আমেরিকা হস্তক্ষেপ করবে। এ কারণে তিনি যুদ্ধ প্রলম্বিত করতে চেয়েছেন। নিয়াজির যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব বারবার ফিরিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু আগস্টে ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তির পর বেইজিংয়ের ভয় ছিল, তারা যুদ্ধে জড়ালে মস্কো পাল্টা ব্যবস্থা নিতে পারে। আবার মস্কোকে ওয়াশিংটন হুঁশিয়ার করে দিয়েছে, কোনোভাবে যেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তারা শক্তি প্রয়োগ না করে। পূর্বনির্ধারিত নিক্সন ও ব্রেজনেভের বৈঠকও বাতিল করে দেয় দেশটি। উপমহাদেশীয় সংকটকে কেন্দ্র করে তিন পরাশক্তিই নিজের স্বার্থ উদ্ধারে সচেষ্ট ছিল।

নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপিত পোল্যান্ডের প্রস্তাবটি ছিল ভারসাম্যপূর্ণ ও সবার জন্য সম্মানজনক। এতে বলা হয়েছিল, ‘পূর্ব পাকিস্তান’–এ শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর, অবিলম্বে শেখ মুজিবের মুক্তি, ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সামরিক তৎপরতা বন্ধ, একই সঙ্গে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রত্যাহার। আর ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রত্যাহার হবে ঢাকার নতুন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে।

১৫ ডিসেম্বর যখন পোলিশ প্রস্তাবটি নিরাপত্তা পরিষদে উঠল, তখন জাতিসংঘে মার্কিন প্রতিনিধি চার্লি নাস বললেন, ‘এখন সমস্যা হলো পশ্চিম পাকিস্তানকে রক্ষা করা।’ ১৬ ডিসেম্বর নিয়াজির আত্মসমর্পণের পর ইয়াহিয়া খানের কাছ থেকে বার্তা এল, অবিলম্বে যেন তিনি দেশে ফিরে যান। নিরাপত্তা পরিষদ থেকে ভুট্টোর নাটকীয়ভাবে বেরিয়ে আসার ঘটনা ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে। অনেকে তাঁকে নিয়ে উপহাসও করেছেন। পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আগা শাহি বলেছেন, ‘আমি নিশ্চিত, তিনি অধিবেশনে যাওয়ার আগে নিজে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মহড়া দিয়েছেন।’

পাকিস্তানি নেতারা তখনো কল্পনার জগতে বাস করছিলেন। ইয়াহিয়া খান নতুন সংবিধান তৈরি করছেন, যাতে পূর্ব পাকিস্তানসহ সব প্রদেশের সর্বোচ্চ স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল।

দেশে ফেরার আগে ভুট্টো পিয়েরে হোটেলে বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর কূটনীতিকদের সম্মানে এক মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করেন। এর আগে তিনি ইকবাল আখুন্দসহ তিন কূটনীতিককে তাঁর লাউঞ্জে ডেকে পরামর্শ চাইলেন। তাঁদের কাছে জানতে চাইলেন, ভবিষ্যতে আমাদের করণীয় কী। ইকবাল আখুন্দ বললেন, সামরিক শাসকের জঞ্জাল মুক্ত করে সবকিছু নতুন করে শুরু করতে হবে। তাঁর প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিয়ে দেশে ঘরে ফেরার ব্যবস্থা করা। ভুট্টোর মধ্যাহ্নভোজে অন্যদের মধ্যে তিনজন বাঙালিও ছিলেন, যাঁরা সাধারণ পরিষদে গিয়েছিলেন পাকিস্তানের প্রতিনিধি হয়ে। এই তিন প্রতিনিধির মধ্যে ইকবাল আখুন্দ শুধু জুলমত আলীর নাম উল্লেখ করেছেন।

আলোচনার মধ্যেই ইসলামাবাদ থেকে একটি টেলিফোন এল। ভুট্টো পাশের ঘরে গিয়ে টেলিফোনটি ধরলেন। লাইনের ওপাশে ছিলেন পিপিপি নেতা মোস্তফা খার। ভুট্টো চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘আমি না আসা পর্যন্ত কিছু কোরো না। আমি সরাসরি দেশে চলে আসছি।’ মোস্তফা খার তাঁকে বোঝাচ্ছিলেন, দেশের পরিস্থিতি খুবই খারাপ। সারা দেশে সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হচ্ছে। মানুষ রাজপথে বেরিয়ে এসেছে। সেনাসদস্যদের মধ্যেও বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। সেনাসদর দপ্তরে বৈঠক চলাকালে সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল হামিদের ওপর জুনিয়র কর্মকর্তারা চড়াও হন। জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারাও ইয়াহিয়া ও তাঁর সহযোগীদের এই বলে হুমকি দিলেন যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করলে সেনাসদরের নিয়ন্ত্রণও তাঁরা নিয়ে নেবেন।

এরপরও কিছুদিন জাতিসংঘে ভারত-পাকিস্তান নিয়ে বিতর্ক চলে। ভুট্টো ‘হাজার বছর ধরে’ যুদ্ধ করার ঘোষণা দিলেও ১৬ ডিসেম্বরই তা শেষ হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের শঙ্কা ছিল, ভারত পশ্চিম পাকিস্তানও দখল করে নিতে পারে। ভারতকে নিবৃত্ত করতে তঁারা সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে ধরনা দেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন আশ্বস্ত করে, ভারত পশ্চিম পাকিস্তান দখল করবে না।

নিউইয়র্কে ব্যর্থ মিশন শেষে ইকবাল আখুন্দ বেলগ্রেডে ফিরে এসে দেখতে পান, দূতাবাসের অনেক বাঙালি কর্মকর্তা চলে গেছেন। একজন কাউন্সিলর বিদায়ের সময় একটি নোট লিখে রেখে গেছেন, ‘আমি জেনারেলদের শাসনামলে এক বছর আন্তরিকতা না থাকা সত্ত্বেও কাজ করেছি। এখন সবকিছু পরিষ্কার। বাংলাদেশ একটি বাস্তবতা।’

দূতাবাসে এরপরও কিছু বাঙালি কর্মকর্তা ও কর্মচারী ছিলেন। ইসলামাবাদ থেকে নির্দেশনা এল তাঁদের পাসপোর্ট আটকে দেওয়ার জন্য, যাতে তঁারা বাংলাদেশে ফিরে যেতে না পারেন। ইকবাল আখুন্দ সেই নির্দেশনা অগ্রাহ্য করলেন।

প্রথম দিকে যেসব দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়, যুগোস্লাভিয়া ছিল তার অন্যতম। যেদিন দেশটি স্বীকৃতি দেবে, তার আগের দিন রাতে জরুরিভাবে পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে পাঠানো হয় এবং তাঁকে সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা তাঁকে জানান, ‘সকালে খবরটি প্রচারের আগেই তোমাকে জানাতে চাই।’

ইকবাল আখুন্দ বিষয়টি সহজভাবে নিলেও পাকিস্তান সরকার পাল্টা ব্যবস্থা নেয়। ইসলামাবাদে খবরটি পৌঁছানোর পর পাকিস্তান যুগোস্লাভিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দেয়। পরদিন ইসলামাবাদে যুগোস্লাভিয়ার দূতাবাস থেকে দেশটির পতাকা নামিয়ে ফেলা হয়। অনুরূপ দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে বেলগ্রেডে পাকিস্তান দূতাবাসও।

কয়েক দিন পর ইকবাল আখুন্দ নিউইয়র্কে চলে যান জাতিসংঘের স্থায়ী প্রতিনিধি হয়ে। (শেষ)

সোহরাব হাসান, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]