নোয়াম চমস্কি ৯০

নোয়াম চমস্কি
নোয়াম চমস্কি

বর্তমান বিশ্বে সাহসী বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সর্বাগ্রে যাঁর নাম আসে, তিনি নোয়াম চমস্কি। ৭ ডিসেম্বর ৯০ বছর পূর্ণ হলো চমস্কির। এ যেন জুলুমে ভরা বৈশ্বিক রাজনৈতিক কাঠামোর সঙ্গে এক বিদ্রোহীর বোঝাপড়ার ৯০ বছর পূর্তি। গত সপ্তাহে বিশ্বজুড়ে ‘চমস্কির নব্বই’ উদ্‌যাপিত হয়েছে।

৯০ ছুঁয়ে যাওয়া কাউকে চলতি হিসাবে বৃদ্ধই বলা হয়। কিন্তু এখনো দারুণ তারুণ্যদীপ্ত চমস্কির কণ্ঠ ও ভঙ্গি। সত্য বলা এবং মিথ্যাকে চ্যালেঞ্জ করার কাজটি বোধ হয় এরূপ ভঙ্গিই দাবি করে। চমস্কির এই ভঙ্গি বিশ্বজুড়ে বুদ্ধিজীবিতাকে কঠিন করে চলেছে। বুদ্ধিজীবীদের রাষ্ট্র ও জনস্বার্থের মাঝামাঝি অবস্থানকে চমস্কি দুরূহ করে তোলেন। এটাই তাঁর যুদ্ধাস্ত্র।

যুক্তরাষ্ট্রের ‘সক্রেটিস’

জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান মানুষের অভাব নেই চলতি বিশ্বে। আছেন সাহসী মানুষও বিস্তর। কিন্তু একই সঙ্গে সাহস, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সম্মিলন কমই দেখা যায়। আধিপত্যবাদ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে চমস্কি তাঁর প্রজন্মের সবচেয়ে নির্ভীক বুদ্ধিজীবীদের একজন। যে কারণে জীবিত ‘পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল’-এর তালিকায় সর্বাগ্রে তাঁর নাম আসে। চমস্কির বুদ্ধিমত্তা ও রণকৌশল বিস্ময় জাগায়। খোদ যুক্তরাষ্ট্রে বসে সেখানকার কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে লড়ছেন, লিখছেন দশকের পর দশক ধরে। ক্রুদ্ধ সমালোচকদেরও শান্ত ধীশক্তি দিয়ে মোকাবিলায় অভ্যস্ত তিনি। চমস্কির অ্যাকটিভিজমের মূল সৌন্দর্য সেখানেই। যুক্তরাষ্ট্রে তাঁকে একালের সক্রেটিস মনে করে অনেকে।

নিজ দেশের বৈশ্বিক ভূমিকাকে বরাবরই চমস্কি ‘বদমাশ পরাশক্তি’ হিসেবেই দেখেন। যুক্তরাষ্ট্রের সব অন্যায় যুদ্ধের সোচ্চার প্রতিবাদকারীদের সামনের সারিতে থাকেন চমস্কি। কেবল মানবিক অনাচারের কারণেই নয়, তিনি যুদ্ধের বিরুদ্ধে মূলত এর পেছনকার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ষড়যন্ত্র উন্মোচনের লক্ষ্যে। প্রায় ৬০ বছর ধরে চমস্কি তাঁর দেশের মানুষকে তথ্য-প্রমাণসহ দেখিয়ে যাচ্ছেন কীভাবে তাদের শাসকেরা সমগ্র বিশ্বকে ‘অমানুষ’ গণ্য করছে এবং বিভিন্ন অঞ্চলের খুদে খুদে দানবের পাশে দাঁড়াচ্ছে। সেটা পূর্ব তিমুর, মধ্য আমেরিকা, হাইতি বা ইসরায়েল—যেখানেই হোক।

ষাটের দশকের শুরুতে ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরোধিতার মধ্য দিয়ে চমস্কির প্রথাবিরোধী কর্মকাণ্ডের শুরু। এরপর থেকে ক্রমাগত ‘মূলধারা’র চিন্তাকে প্রভাবিত ও চ্যালেঞ্জ করেছেন। অসংখ্য বই, প্রবন্ধ ও সাক্ষাৎকারের মধ্য দিয়ে জীবদ্দশাতেই তিনি বিশ্বের সব প্রান্তে প্রথাবিরোধী, কর্তৃত্ববিরোধী, যুদ্ধবিরোধী চিন্তার একটা ঢেউ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। সবই করছেন তিনি ‘জনগণের মধ্যে’ থেকেই। তাঁর ঘনিষ্ঠরা বলে থাকে, এই বয়সেও প্রতিদিন চার-পাঁচ ঘণ্টা অপরিচিতদের ই-মেইলের জবাব লিখে কাটান তিনি। চমস্কির কাছে বিশ্বজুড়ে বোঝাপড়াটা বিশ্বের সঙ্গে থেকেই। প্রায় প্রতিমুহূর্তে তৎপর তিনি।

তবে পেছন ফিরে তাকালে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রকে থামাতে পেরেছেন তিনি সামান্যই। কিন্তু বিশ্বজুড়ে দানবীয় অত্যাচারের শিকার ‘অমানুষ’গুলো জানে তাদের অত্যাচার, ক্রোধ ও বেদনার কথা অন্তত একজন বিরতিহীনভাবে বলে যাচ্ছেন—প্রতিনিয়ত সাক্ষাৎকার, প্রবন্ধ ও বই লিখে; বক্তৃতা দিয়েও। যার সর্বশেষ নজির ইয়েমেনে যুক্তরাষ্ট্র-সৌদি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে চমস্কির সক্রিয়তা।

তাঁকে অগ্রাহ্য করা দুরূহ

ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় যাঁরাই ‘এস্টাবলিশমেন্ট’কে কোনোভাবে উন্মোচিত ও আঘাত করেন, তাঁদের নানান উপায়ে ‘মানসিকভাবে অসুস্থ’ প্রমাণের চেষ্টা থাকে। যার সর্বশেষ প্রমাণ জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ, ব্র্যাডলি ম্যানিং প্রমুখ।

চমস্কিকেও প্রায় পাঁচ দশক বহুরূপে কোণঠাসা করার চেষ্টা ছিল। সিএনএন, টাইম, ফরেন পলিসির মতো প্রভাবশালী মিডিয়া তাঁর বক্তব্য প্রচার করে না। এরূপ ভাবুকদের তারা ‘ক্রেজি’ তকমা দিয়ে নীরবতার কবরে সঁপে দিয়েই স্বস্তি পায়। চমস্কির ক্ষেত্রে সেটা সফল হয়নি। তাঁর বক্তব্যের প্রতি উদাসীন থাকা দুরূহ। এমনও দেখা গেছে, তাঁর কোনো কোনো গ্রন্থ প্রথম মাসেই একই সঙ্গে চার-পাঁচ দেশে সর্বোচ্চ বিক্রীত প্রকাশনার স্বীকৃতি পাচ্ছে। নাইন–ইলেভেনের ক্ষেত্রে (২০০১) এমনটি ঘটেছিল। বইটি তাৎক্ষণিকভাবে ২৬টি ভাষায় তরজমা হয়।

কেবল রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিষয়েই নয়, চমস্কির পাণ্ডিত্যের প্রকাশ ঘটেছে ভাষাতত্ত্বেও। একাডেমিক জীবনের শুরুতে ভাষাতত্ত্ব ছিল তাঁর মনোযোগের কেন্দ্রে এবং তাতে শাস্ত্রটি কুয়াশাচ্ছন্ন অবস্থা থেকে সমাজবিদ্যার পরিসরে প্রভাবশালী পড়ালেখার ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। আধুনিক ভাষাতত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা বলা হচ্ছে এখন তাঁকে। মনোদর্শনেও তাঁর অবদান যুগান্তকারী। তবে সময় যত গড়িয়েছে, চমস্কি ততই বৈশ্বিক রাজনীতি-অর্থনীতির জগতের প্রভাবশালী চিন্তক হিসেবেই বেড়ে উঠেছেন। মুহূর্তে জুলুম-নিপীড়নবিরোধী রাষ্ট্রনৈতিক ভাবুক হিসেবেই বিশ্ব চেনে তাঁকে।

‘রাষ্ট্র’-এর কর্তৃত্ববাদী স্বার্থের দেখাশোনা ও তার অর্থনৈতিক প্রকল্পগুলোর পেছনে প্রচারমাধ্যম ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা নিয়ে বিস্তর লিখেছেন চমস্কি। এ বিষয়ে তাঁর সাড়া জাগানো বই ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট দুনিয়াব্যাপী জরুরি পাঠ্য এখন। ভাষাতত্ত্ব ও জ্ঞানবিদ্যার আলোচনায় তিনি হয়তো কেবল সতীর্থদের কাছে পাঠ্য—কিন্তু রাজনীতি ও কূটনীতির ধারাভাষ্যে তিনি সাধারণের কাছেও সহজবোধ্য। শিক্ষা বিষয়ে তাঁর অসাধারণ কিছু বিশ্লেষণ রয়েছে, যাতে তিনি দেখান কীভাবে তরুণদের মতাদর্শশূন্য করার কাজেই স্কুল-কলেজগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে। এরূপ ‘শিক্ষিত’রা যে ‘রাষ্ট্রীয় বর্বরতা’কে সমর্থন করবে, চমস্কির মতে ‘সেটাই স্বাভাবিক।’

এমআইটিতে আছেন তিনি ১৯৫৭ থেকে। অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেও পেশাগত সম্পর্ক আছে তাঁর। তবে মূলত চমস্কি এখন বিশ্বের তরুণদের প্রধানতম এক শিক্ষক ও পথপ্রদর্শক। দেশ থেকে দেশান্তরে নিয়মিত বক্তৃতা দিয়ে চলেছেন।

তিনি ‘সমাধান’ হাজির করেন কম

চমস্কির সমালোচনাও কম নেই। একদল মনে করছে, তিনি আমেরিকার বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর ক্ষেত্রে ইরানের আয়াতুল্লাহদের মতোই ভূমিকা রাখছেন। নিজে ইহুদি হয়েও ইসরায়েলের লাগাতার সমালোচনার জন্য তাঁকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ মনে করে ইহুদি রাজনীতিবিদদের বড় এক অংশ। বামপন্থীরও একাংশ তাঁর সমালোচক।

চমস্কি নিজের রাজনৈতিক মত ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জানান, তিনি ‘মুক্তিদায়ী সমাজতন্ত্রী’। কিন্তু বামপন্থী বিরুদ্ধবাদীরা বলে, বিদ্যমান ‘ব্যবস্থা’র সমালোচক হিসেবে তিনি যতটা তীক্ষ্ণ ও সোচ্চার, ততটা নন বিকল্প মডেল উপস্থাপনে। অর্থাৎ তিনি ‘সমাধান’ হাজির করেন কম। পার্টিরূপী কোনো কাঠামো গড়তে দেখা যায়নি তাঁকে।

কিন্তু চমস্কির মনোযোগী পাঠক-শ্রোতার এটা চোখ এড়ায় না যে তিনি নিপীড়িতের সমবায়ধর্মী এক স্বশাসিত সমাজের কথা বলছেন প্রতিনিয়ত। নিঃসন্দেহে তাঁর চিন্তা কর্তৃত্ববাদী সমাজতন্ত্রের ধারণার চেয়ে পৃথক। চমস্কি সমাজতন্ত্রী হলেও কর্তৃত্ববাদী পার্টি ধারণার বিরোধী। তিনি চাইছেন এমন সমাবেশশক্তি, যার সব সিদ্ধান্ত হবে অংশগ্রহণমূলক। তাঁর অবস্থান লেনিনবাদী পার্টি মডেলের চেয়ে ভিন্ন। তিনি মনে করেন, গণতন্ত্রের চর্চা গড়ে ওঠা উচিত নিচ থেকে। স্ব-আগ্রহে সবার অংশগ্রহণমূলক ‘সমাজ’ ও ‘কর্মস্থল’-এর ওপর জোর দেন চমস্কি। যেখানে ব্যক্তির স্বাধীন মতের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি থাকবে এবং রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের প্রভাব হবে সর্বনিম্ন। কেবল এভাবেই ব্যক্তির ‘সৃজনশীলতার সার্বভৌমত্ব’ এবং জগতের ‘মানবিক বৈচিত্র্য’ রক্ষা করা সম্ভব এবং সেটাই জরুরি। চমস্কি কোনো রাজনৈতিক ইশতেহার প্রচার করতে অভ্যস্ত নন। ‘জনগণের এটা করা উচিত’ বলার চেয়ে তাঁর আগ্রহ ভিন্নমতের মনোভাবকে উসকে দেওয়া, ‘যা মানুষকে তার প্রত্যাশিত পরিবর্তনে সম্পৃক্ত করে নেবে।’

প্রায় ছয় দশকের চিন্তা ও তৎপরতায় তিনি মূলত হাজির ছিলেন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ নিয়ে। যা কিছু কর্তৃত্ববাদী ও উদারনৈতিক বুদ্ধিজীবীরা গোপন করেন, চমস্কি তা জানিয়ে দেন। তিনি সব সময় তৃণমূলের সমাবেশশক্তির পক্ষপাতী। তাঁর বিখ্যাত উক্তি, ‘জনগণের উচিত তাদের কাজ ও তত্পরতার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ।’ তরজমা করলে এই উক্তির অর্থ দাঁড়ায়, জনগণকে তার ভবিষ্যৎ নির্মাণের দায়িত্ব নিতে হবে। নিঃসন্দেহে তাবৎ বিশ্ববাসীর ক্ষেত্রেই এটা প্রাসঙ্গিক, বাংলাদেশের জন্যও (অতি) জরুরি।

আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ের গবেষক