উৎসবমুখর না হোক সংঘাতময় চাই না

মুনতাসীর মামুন
মুনতাসীর মামুন

আমাদের যৌবনে একটি স্লোগান ছিল খুব জনপ্রিয়-সংগ্রাম চলছে, চলবে। গত ৭০ বছর এ দেশে নির্বাচন হচ্ছে, হবে। আজ পর্যন্ত এ দেশে ১৯৭০ ছাড়া কোনো নির্বাচনই সংঘাতবিহীন হয়নি। উপমহাদেশের সব দেশের ক্ষেত্রেই এ কথা প্রযোজ্য। তবে, হামলা, ভাঙচুর ও হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। প্রযুক্তির উন্নতি হয়তো এর একটি কারণ। সব ধরনের প্রযুক্তির কথাই বলছি, তা সেলফোন হোক কি ক্ষুদ্রাস্ত্র।

এবারের নির্বাচনের বৈশিষ্ট্য হলো, প্রার্থী ও দলের সংখ্যা, যা সব হিসাবকে ছাড়িয়ে গেছে। আদর্শের বিষয়টি ক্ষীণ হয়ে আসছে। যদিও দুই জোটের মৌল আদর্শটা এখনো বহিরঙ্গে ঠিক আছে। ধারণা করছি, সংঘাত হোক আর হতাহত হোক, নির্বাচন ছেড়ে কেউ যাবে না।

বর্তমান নির্বাচন সহিসালামতে সমাপন হবে—এ কথা সরকার বা বিরোধী দল নিশ্চয়ই ভাবেনি। নির্বাচনী প্রচারের শুরুতেই এর লক্ষণগুলো দেখা যাচ্ছে। প্রথম দিনেই সরকারপক্ষের দুজন নিহত, মির্জা ফখরুলের গাড়িবহরে হামলা ইত্যাদি। ঢাকার বাইরে থেকে আমি ফিরেছি। চারদিকে উত্তেজনাকর ও উৎসবমুখর পরিস্থিতি বিরাজ করবে ভেবেছিলাম। সে রকমটি হচ্ছে না সব জায়গায়। প্রার্থীরা যে রাস্তায় নামছেন, সে রাস্তায়ই শুধু মিছিল। যে জায়গায় বিএনপি-জামায়াত শক্তিশালী, সে এলাকায় সরকারপক্ষীয়রা রয়েসয়ে কাজ করছে। যে জায়গায় সরকারপক্ষীয়রা শক্তিশালী, সে জায়গায় বিরোধীপক্ষীয়রা খুব সোচ্চার, তা নয়। দুই পক্ষই অপেক্ষা করছে।

সংঘাত হচ্ছে কেন? কারণ, দুই পক্ষই প্রবলভাবে ঘৃণা করে পরস্পরকে এবং সেটি চরম মাত্রায়। মনে হয় না সেখানে বড় ধরনের কোনো সমঝোতার আশা আছে। তা ছাড়া, দুই পক্ষেই আছেন দলবদলকারীরা। তাঁদের সঙ্গে মূল দলের নেতা-কর্মীদের রেষারেষি। তারপর আছে মনোনয়ন নিয়ে দ্বন্দ্ব। বিএনপির প্রতিদিন অভিযোগ এখন গা-সওয়া হয়ে গেছে। নির্বাচনের পরও তা চলবে। আওয়ামী লীগের উন্নয়ন রাজনীতি অনেকটা গ্রাহ্য। এর মধ্যে সংখ্যালঘুদের ও সাধারণ ভোটারদের নিরাপত্তার বিষয়টিও জড়িত। নির্বাচন কমিশনকে এ বিষয়ে আমরা বলেছিলাম। তারাও আশ্বস্ত করেছিল, কিন্তু সুষ্ঠু ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো লক্ষণ এখনো চোখে পড়েনি।

এবার ইতিবাচক দিকের কথা বলি। সব দল যে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে এবং নির্বাচন যে হচ্ছে-এটি সবাই ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছেন এবং স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছেন।

সব সময় শেষ সপ্তাহে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। এবারও তা-ই হবে। তবে আমরা আশা করব, তা মাত্রা ছাড়িয়ে যাবে না। একটি বিষয় সরকার ও বিরোধী দলকে বিবেচনায় রাখতে হবে। দুই পক্ষ যদি মরিয়া হয়ে ওঠে এবং অপপ্রচার ও সংঘাত মাত্রা ছাড়ায়, তাহলে আশঙ্কা থেকেই যায়। নির্বাচন মোটামুটি সুষ্ঠু না হলে সরকারপক্ষ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তেমনি বিএনপির মাত্রাধিক মরিয়া হয়ে ওঠাও তার বিপক্ষে যাবে। দায়িত্ব দুই পক্ষেরই। ২০১৪ সালে বিএনপি-জামায়াত যে অবস্থার সৃষ্টি করেছিল, তার পুনরাবৃত্তি হলে দল হিসেবে বিএনপির গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। তবে, এটুকু বলতে পারি, এ নির্বাচনে অনেক পরিচিত রাজনীতিবিদের রাজনৈতিক জীবনের ইতি ঘটবে। সবাই অপেক্ষা করছেন, নির্বাচন উৎসবমুখর না হোক, সংঘাতময় যেন না হয়। অর্থাৎ সংঘাত যেন মাত্রা না ছাড়ায়।

এ নির্বাচনের ইতিবাচক প্রধান দিক হলো, সরকার ও বিরোধী দল-দুই পক্ষই ক্ষমতা বদলের মাধ্যম হিসেবে নির্বাচনকে মেনে নিয়েছে, সন্ত্রাসকে নয়। এই ইতিবাচক দিকটি নষ্ট হোক, আমরা তা চাই না।

মুনতাসীর মামুন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সাবেক অধ্যাপক