নির্বাচনী প্রচারণা ও সহিংসতা

নির্বাচনী প্রচারণার শুরুতেই অন্তত ১৮ জেলায় সহিংসতা দেখা দেওয়ার বিষয়টি আমাদের গভীরভাবে উদ্বিগ্ন করেছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের গাড়িবহরে হামলা, মওদুদ আহমদ ও মঈন খানের এলাকায় প্রচারকর্মে বাধা, বগুড়ায় যুবদল কর্মীর বাড়িতে আগুন, হামলাসহ কিছু স্থানে সংঘর্ষ-ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বিয়োগান্ত ঘটনা ঘটল নোয়াখালী ও ফরিদপুরে। ঝরল যুবলীগ ও আওয়ামী লীগ কর্মীর দুটো তাজা প্রাণ।

প্রায় প্রতিটি ঘটনায় পাল্টাপাল্টি দোষারোপের ঘটনা লক্ষ করা গেছে। এমনকি বিএনপির মহাসচিবের শান্তিপূর্ণ শোভাযাত্রায় হামলার পরে অভিযুক্ত আওয়ামী লীগ কর্মীরা ‘সস্তা ভাবাবেগ’ নিতে বিএনপিই হামলা করেছে বলেও দাবি করেছে। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার ওসি আশ্বস্ত করেছেন যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে, ঘটনার তদন্ত হবে। কিন্তু সার্বিক বিচারে পুলিশের নিয়ন্ত্রণ এবং ত্বরিত হস্তক্ষেপের অনুপস্থিতি আমাদের পীড়িত ও বিচলিত করছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ব্যথিত ও বিব্রত হয়েছেন মর্মে যে মন্তব্য করেছেন, তা যথেষ্ট নয়। পুলিশের ব্যর্থতা এখন ইসির কাঁধেই বেশি বর্তাবে। ইসিকে দেখাতে হবে, তারা পুলিশকে সঠিক নির্দেশনা দিয়েছে।   

আর সহিংসতা বিস্তারের দায়দায়িত্ব অবশ্যই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিতে হবে। এ রকম হামলার জন্য কারা দায়ী, তা নিয়ে যেহেতু পরস্পরবিরোধী অভিযোগ রয়েছে, তাই পুলিশ পক্ষপাতমুক্তভাবে কী বলে এবং কী করে, সেটাই হবে সবার দেখার বিষয়। ৩০ ডিসেম্বরকে সামনে রেখে ছোটখাটো সহিংসতাকেও অত্যন্ত গুরুত্ব ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া উচিত হবে। বড় ধরনের নির্বাচনী সহিংসতার আশঙ্কা নিয়ে গতকাল বুধবার কারওয়ান বাজারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘নিরাপত্তা বাহিনী দক্ষ, তাদের কাছে কোনো চ্যালেঞ্জই চ্যালেঞ্জ নয়। তারা যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় তৈরি।’ কিন্তু এটুকু আমাদের আশ্বস্ত করে না। ঐতিহ্য অনুযায়ী কিছু বিক্ষিপ্ত সহিংসতা ঘটেই থাকে। কিন্তু নির্বাচনী প্রচারণার শুরুতেই খোদ বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের গাড়িবহরে হামলা চালানোর বিষয়টি কিন্তু
সাধারণ ঘটনা নয়।

আমরা আশা করব, এই ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত, তা অবিলম্বে চিহ্নিত করা, দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং তদন্তের ফলাফল প্রকাশ করা হলে পুলিশের পক্ষে তার যথা ভূমিকা পালন করার শর্ত পূরণ করা হবে। নির্বাচনকালে সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন আধা সামরিক এবং এলিট ফোর্স নিয়োগ করা হবে, কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়টি একান্তভাবেই পুলিশকেই দায়িত্ব নিতে হবে।   

নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব পক্ষ মাঠ সমতল করার ধারণা সমর্থন করে। এ বিষয়ে পুলিশের যে হাতটি রয়েছে, সেটি যে পরিচ্ছন্ন, তাদেরই তা নিশ্চিত করতে হবে। অবশ্য ক্ষমতাসীন দলকেও তা চাইতে হবে। সংশ্লিষ্টদের মনে রাখতে হবে, মন্ত্রিসভার সদস্যরা শুধু নিরাপত্তা পাবেন, প্রটোকল পাবেন না। এত দিন পুলিশের একটি বড় অংশ প্রটোকল রক্ষায় নিয়োজিত ছিল। এই প্রটোকলের কারণে পুলিশ অনেক জরুরি বিষয়ে মনোযোগ দিতে পারে না বলে আমরা নানা সময় শুনেছি। প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভার সদস্যরা নির্বাচনী প্রচারণা চালাবেন, এ সময় প্রচারণার স্থানগুলোর নিরাপত্তা ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। প্রচলিত আইন এবং গণতান্ত্রিক রীতিনীতি দাবি করে যে, দেশের প্রধান বিরোধী দলের শীর্ষ নেতাদের, তাঁদের সভা–সমাবেশ ও যাতায়াতের ক্ষেত্রেও যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। মির্জা ফখরুলের গাড়িবহরের ওপর হামলার ঘটনাটিকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির একটি গুরুতর ঘাটতি হিসেবেই বিবেচিত হবে।অনেক সময় বলা হয়, মর্নিং শোজ দ্য ডে। নির্বাচনী প্রচারণার শুরুতেই সহিংসতা তাই আমাদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের আশঙ্কা অমূলক প্রতিপন্ন করাই হোক পুলিশের মূল দায়িত্ব।