ভোটারদের দিক থেকেও অংশগ্রহণমূলক হোক

বড় বড় রাজনৈতিক দল আর ভোটার ছাড়া এ দেশে বেশ কিছু নির্বাচন হয়েছে। সেগুলোর আয়োজকেরা এ দৈন্যকে সংবিধান ও আইনের আড়ালে ঢেকেছেন। এটা সত্য, কোনো নির্বাচনে বিশেষ কোনো দল যোগ না দিলে নির্বাচন আইনত অসিদ্ধ হয় না। ঠিক তেমনি কত শতাংশ ভোটারকে ভোট দিতে হবে, এরও কোনো নির্ধারিত সংখ্যা নেই। ৩ লাখ ভোটারের একটি নির্বাচনী এলাকায় ২০ জন ভোটার ভোট দিলেও অধিকাংশ ভোট যিনি পাবেন, তাঁর নির্বাচন অসিদ্ধ হবে না। তবে এটা বিবেচনায় নিতে হবে যে, নির্বাচন একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। আর রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার একমাত্র নিয়ামক জনগণ। সেই জনগণের বিশাল অংশ কোনো নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না থাকলে তা রাজনৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য হয়ে যায়। এর ফলাফল হারিয়ে ফেলে নৈতিক ভিত্তি।

সময়ে-সময়ে আমরা ভুলে যাই জনগণ এ রাষ্ট্রটির মালিক। সংবিধানেও এর উল্লেখ রয়েছে। সে জনগণকে বাদ রেখে যেকোনো রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার নৈতিক দিক দুর্বল হবে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। এ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল দেশটি পরবর্তী পাঁচ বছর শাসন করবে। নির্বাচন-প্রক্রিয়ার একাধিক ধাপ এরই মধ্যে পার হয়েছে। নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে সব রাজনৈতিক দল ও জোট। কারও কারও নির্বাচন বর্জনের একটি শঙ্কা থাকলেও সেটি দূর হয়েছে। সুতরাং বর্তমান পর্যায়ে নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক বলা চলে।

তবে কথা থাকছে, সাড়ে ১০ কোটি ভোটার ভোট দিতে পারবেন তো? অবশ্য শতভাগ ভোটার ভোটকেন্দ্রে কখনো যান না। ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ গেলেই যথেষ্ট বলে বিবেচিত হয়। আর এই ভোটারদের তাঁদের পছন্দমতো প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার সুযোগ থাকা অতি গুরুত্বপূর্ণ। সরকার ক্ষমতায়। তারা স্বাভাবিকভাবেই জিততে চাইবে। আর এ চাওয়া অসংগতও নয়। তেমনি জিততে চাইবে যারা ক্ষমতায় নেই, সেই বিরোধী দলগুলো। তবে এ জয়-পরাজয়টা যাতে ভোটারের ভোটে হয়—এর নিশ্চয়তা বিধানের দায়িত্ব সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে দিয়েছে। নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব জনবল উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত আছে। অবশ্য মূল কাজটি করেন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা। ভারতেও একই ব্যবস্থা। নিরাপত্তা বিধানও আমাদের মতোই। রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীই এর দায়িত্বে থাকে। বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় থাকবেন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা।

আয়োজনটা বরাবর একই রকম। আর এ ধরনের আয়োজনের মধ্যেই আমরা সফল ও প্রশ্নবিদ্ধ উভয় ধরনের নির্বাচন দেখেছি। প্রকৃতপক্ষে নির্বাচন কমিশনকে এখানে আম্পায়ারের দায়িত্বে সফল হতে হলে আরও দৃঢ় ও কুশলী হতে হবে। এর মধ্যে কিছু সুযোগ তারা হাতছাড়া করেছে। মনোনয়নপত্র দাখিলের দিনে বা তার আগে শোডাউন করেছেন সরকারি, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিরোধী দলের প্রার্থী। এ-জাতীয় দু-একটি ক্ষেত্রে জরিমানা করা হয়েছে বটে। তবে উপেক্ষা করা হয়েছে প্রায় সবগুলো। ভিআইপিদের এ-জাতীয় আচরণে কমিশন অসন্তোষ প্রকাশ করলেও কিছুটা টনক নড়ত।

দুর্ভাগ্যবশত কমিশনকে সবাই হালকাভাবে নিচ্ছে। এটি একটি বিপজ্জনক প্রবণতা। আর কমিশনও তাদের অস্ত্র একে একে হাতছাড়া করছে। জানা যায়, পর্যবেক্ষকদের কার্যক্রম যথেষ্ট পরিমাণে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। গণমাধ্যমের কর্মীরাও শঙ্কায় আছেন। এ ধরনের কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকলেও সিটি করপোরেশনগুলোর বিগত নির্বাচনে বেশ কিছু ক্ষেত্রে স্থানীয়ভাবেই তাঁদের কেন্দ্রের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। এটা ঠিক, অনেক সংখ্যক স্থানীয় পর্যবেক্ষক ও গণমাধ্যমের কর্মীর উপস্থিতি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সুষ্ঠু ভোট গ্রহণে কিছুটা চাপের সৃষ্টি হয়। তবে দেশব্যাপী ৪০ হাজার ২০০ কেন্দ্রে একসঙ্গে অনেক পর্যবেক্ষক বা গণমাধ্যমকর্মীর উপস্থিত হওয়ার কথা নয়। হাওর অঞ্চল, পার্বত্য জেলাসহ অনেক দুর্গম জায়গায় তাঁদের কারও পায়ের ছাপ না পড়ার সম্ভাবনাই বেশি। অথচ তাঁরা কোনো অনিয়মের সচিত্র খবর দ্রুত দিলে কমিশন জরুরিভাবে হস্তক্ষেপ করতে পারে। প্রকৃতপক্ষে তাঁরা হতে পারেন কমিশনের সহায়ক শক্তি।

কমিশনকে বুঝতে হবে, সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন করায় স্থানীয় প্রভাববলয় সক্রিয় রয়েছে। তীব্র চাপের মুখে আছেন রিটার্নিং কর্মকর্তাসহ সব ভোট কর্মী এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। বিরোধী দলের কোনো কোনো প্রার্থীও তাঁদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় পেশিশক্তির আশ্রয় নিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে পর্যবেক্ষক ও গণমাধ্যমের কর্মীদের গতিবিধি যত বেশি হবে, সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্ভাবনা ততটাই বাড়বে। ভোটকক্ষে তাঁদের প্রবেশ ও ছবি তোলার অধিকার রেখে সময় সীমিত করা চলে। এ মর্মে কমিশন রিটার্নিং কর্মকর্তাদের বিষয়টি নিশ্চিত করতে নির্দেশ দিতে পারে। এতে লাভবান তারাই হবে।

বস্তুতপক্ষে মাঠপর্যায়ে কমিশন ও সরকার একাকার হয়ে যায়। এমনটা ভারতেও হয়। তবে পার্থক্য হচ্ছে, সেখানে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় থাকে কমিশন। বাংলাদেশে প্রধানত এর বিপরীত চিত্রের সঙ্গেই আমরা পরিচিত। বারবার বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় আসার পরেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে কখনো কখনো অকারণ বা তুচ্ছ কারণে মামলা দেয়। তাঁদের গ্রেপ্তার ও এলাকাছাড়া করা হয়। এ অভিযোগ আমরা দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কাছ থেকে শুনছি। সরকারের ভেতরের অতি উত্সাহী মহলটি দেশের গণতন্ত্রকে ভিত গাড়তে দিচ্ছে না। ক্ষমতাসীন দল জনগণের ভোট নিয়ে আরও চারবার সরকার গড়লেও কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। দেশটির মালিক জনগণ। তাঁদের ইচ্ছানুসারেই সরকার গঠিত হবে।

অনেকেই আশঙ্কা করছেন, ভোটের দিন প্রভাবশালী মহলের চাপে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী একদিকে হেলে পড়বে। সর্বত্র না হলেও অনেক জায়গায় এরূপ হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এতে কেন্দ্রের ভোটকর্মীরা অনেকটা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়তে পারেন। যার ভোট তার দেওয়ার ব্যাপারটি তখন আর থাকবে না। সূচনা থেকেই কেন্দ্র দখল হলে ভোটকেন্দ্রে খুব কম ভোটারই যাবেন। থাকবে না অন্য প্রার্থীর এজেন্টও। সে ক্ষেত্রে পাল্টে যাবে ভোটের ফলাফল। এতে নির্বাচনটি থাকবে না আর অংশগ্রহণমূলক। কেননা, এখানে নির্বাচনব্যবস্থার নায়ক ভোটাররাই অনুপস্থিত।

সরকার ও নির্বাচন কমিশনের একরকম যোগসাজশমূলক ভূমিকায় ২০০৭-এর সূচনায় অনুষ্ঠেয় নির্বাচনটি বানচাল হয়ে যায়। ২০০৬-এ তখনকার সরকার ক্ষমতা ছাড়ার আগেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা নেয়। একপর্যায়ে তখনকার রাষ্ট্রপতিকে করা হয় সরকারপ্রধান। অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনকে মনে হতো সরকারের সম্প্রসারিত একটি অঙ্গ। এর নায়কেরা কিন্তু ইতিহাসের কাছে দায়মুক্তি পাননি। সব মিলিয়ে তখন পরিস্থিতি কী দাঁড়িয়েছিল, আর এর পরিণতি আমাদের স্মৃতি থেকে এত সহজে ম্লান হয়ে যায়নি। বর্তমান সরকার কিন্তু সংবিধান পরিবর্তন করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করেছে। পৃথিবীর অনেক দেশেই এমনটা আছে। এখানেও যে এটি সফলভাবে করা যাবে, তা প্রমাণের দায়িত্ব কিন্তু ক্ষমতায় থাকা সরকারের। কিন্তু সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কিছু কর্মকর্তা যেভাবে নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে সক্রিয়, তাতে তাদের সে ধরনের কোনো দৃঢ় ইচ্ছা আছে—এমনটা এখনো দৃশ্যমান নয়।

সংবিধান ও আইনের দ্বারা নির্বাচন কমিশনকে ক্ষমতায়ন করা হয়েছে। তাদের ক্ষমতার প্রয়োগও খুব একটা নজরে আসছে না। সফলতার কৃতিত্ব ও ব্যর্থতার গ্লানি দুটোরই নজির আছে আমাদের সামনে। জাতির স্বার্থে একটি প্রকৃত অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে অবশিষ্ট দিনগুলোতে তারা জোরালো পদক্ষেপ রাখুক—এ প্রত্যাশা রইল। যুদ্ধ ময়দানে হয়। সেনানায়কেরা দূর থেকে তা পরিচালনা করেন। কিন্তু সাফল্যের স্বাদ কিংবা ব্যর্থতার দায় তাঁদেরই বহন করতে হয়।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
majumderali [email protected]