নির্বাচনী ইশতেহার: নাগরিক প্রত্যাশা

আমাদের দেশে জাতীয় নির্বাচনের আগে প্রতিটি বড় দলের পক্ষ থেকে নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ একটি প্রতিষ্ঠিত রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এ রেওয়াজ যেন বর্তমানে একটি অর্থহীন আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে। কারণ, রাজনৈতিক দলগুলো অঙ্গীকার করার ব্যাপারে যত আগ্রহী, তা রক্ষার ব্যাপারে ততটাই যেন অনাগ্রহী, যদিও নির্বাচনী ইশতেহারকে দল ও ভোটারদের মধ্যকার একটি লিখিত চুক্তি বলে ধরে নেওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ‘সুশাসন, গণতন্ত্রায়ণ ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ’কে তাদের অগ্রাধিকার হিসেবে ঘোষণা করেছিল, যেগুলো অর্জনে গত পাঁচ বছরে খুব একটা অগ্রগতি লক্ষ করা যায় না। তবু নির্বাচনী ইশতেহার গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এর মাধ্যমে ভোটাররা রাজনৈতিক দলের অগ্রাধিকার সম্পর্কে জানতে পারেন।

কী কী বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকা দরকার?
আমরা মনে করি যে ইশতেহারের ভূমিকাতেই প্রতিফলন ঘটাতে হবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার প্রতি বিশ্বাস এবং রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি—গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রতি দলের অঙ্গীকার। একই সঙ্গে ইশতেহারের প্রারম্ভিক বক্তব্যে থাকতে হবে দলের নীতি-আদর্শ ও অতীতের অর্জনের বর্ণনা।

গ্রহণযোগ্য নির্বাচন গণতান্ত্রিক শাসনের পূর্বশর্ত। তবে ২০১৪ সালের বিতর্কিত জাতীয় এবং পরবর্তীকালের কারচুপিপূর্ণ স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থাই এখন বহুলাংশে ভেঙে পড়েছে। তাই ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা এবং নাগরিকের স্বাধীনভাবে ভোট প্রদানের সুযোগ সৃষ্টি করাই আজ সর্বাধিক জরুরি। কারণ, ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা হলেই—অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর নাগরিকেরা তাঁদের ভোটের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের সুযোগ পেলে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের মধ্যে পরিবর্তন আনতে এবং দায়িত্বশীল আচরণ করতে বাধ্য হবে। বাধ্য হবে রাষ্ট্র পরিচালনায় কতগুলো সুদূরপ্রসারী সংস্কারে উদ্যোগ গ্রহণ করতে, যা আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার পথকে সুগম করবে। তাই নাগরিকের স্বাধীনভাবে ভোট প্রদানের অধিকার প্রতিষ্ঠার ও সে লক্ষ্যে করণীয় রাজনৈতিক দলের ইশতেহারে
অন্তর্ভুক্ত হতে হবে।

সমগুরুত্বপূর্ণ বা ‘কো-ইকুযয়াল’ ব্রাঞ্চ হিসেবে প্রশাসন, আইনসভা ও বিচার বিভাগের সমন্বয়ে গঠিত একটি শক্তিশালী নজরদারির কাঠামো সত্যিকারের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অপরিহার্য পূর্বশর্ত। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় এই নজরদারির কাঠামো বা ‘চেকস অ্যান্ড ব্যালান্স’ পদ্ধতি বহুলাংশে ভেঙে পড়েছে এবং আমাদের রাষ্ট্রের সবকিছুই এখন ‘ইম্পিরিয়াল প্রিমিয়ার’–এর করায়ত্ত। এই অকার্যকর ব্যবস্থার পরিবর্তনের লক্ষ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার একটি সুস্পষ্ট রূপরেখা রাজনৈতিক দলের ইশতেহারে থাকতে হবে। একই সঙ্গে ইশতেহারে থাকতে হবে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন, ‘উইনার-টেক অল’ ব্যবস্থার অবসান এবং রাজনৈতিক দলকে গণতান্ত্রিক, স্বচ্ছ ও দায়বদ্ধ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার অঙ্গীকার।

ইশতেহারে চিহ্নিত করতে হবে সংবিধান সংশোধনের সম্ভাব্য ক্ষেত্রসমূহ যেমন: নির্বাচনকালীন সরকার, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব, টার্ম লিমিট বা মেয়াদের সীমা নির্ধারণ, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, ৭০ অনুচ্ছেদের সংস্কার, গণভোট, রি-কল ব্যবস্থা, আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ইত্যাদি। এ ছাড়া সুশাসন তথা আইনের শাসন, মানবাধিকার সংরক্ষণ, স্বচ্ছতা-জবাবদিহি চর্চার মাধ্যমে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের অবসান ও সর্বক্ষেত্রে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দলের করণীয় ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসানের অঙ্গীকারও ইশতেহারে থাকতে হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রশাসনিক ও আর্থিক বিকেন্দ্রীকরণ এবং স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালী ও কার্যকর করার পরিকল্পনাও রাজনৈতিক দলের ইশতেহারের অংশ হতে হবে।

শিল্পোন্নয়ন, কর্মসংস্থান ও বেকারত্ব দূরীকরণ, খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টি নিশ্চিতকরণ, টেকসই যোগাযোগব্যবস্থা ও অবকাঠামো উন্নয়ন, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের প্রসার ইত্যাদিসহ অর্থনৈতিক উন্নয়নের রূপরেখা ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। আরও অন্তর্ভুক্ত হতে হবে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার এবং এই খাতে লুটপাটকারীদের এবং বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের বিচারের আওতায় আনার পরিকল্পনা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বৈষম্য নিরসন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ, সড়কে নৈরাজ্যের অবসান, নারীর ক্ষমতায়ন, জেন্ডার সমতাসহ সামাজিক উন্নয়ন সম্পর্কিত অগ্রাধিকারও ইশতেহারে স্থান পেতে হবে। সমাজে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য অবসানে রাষ্ট্রীয় সম্পদে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ন্যায্য হিস্যা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি নতুন ‘সামাজিক চুক্তি’ প্রণয়নের বিষয়টি ইশতেহারে যুক্ত হতে হবে। একই সঙ্গে ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তরুণদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, কর্মসংস্থান ও প্রযুক্তিগত সুযোগ সৃষ্টির পরিকল্পনা ইশতেহারে থাকতে হবে।

এ ছাড়া পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে জাতিকে রক্ষা করার পরিকল্পনা ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। প্রসঙ্গত, সুষম অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন এবং পরিবেশের ভারসাম্য নিশ্চিত হলে ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব দূরীভূত করা গেলে এসডিজি বাস্তবায়নের পথ সুগম হবে এবং কেউ আর পিছিয়ে পড়ে থাকবে না। বস্তুত ইশতেহারে এসডিজি অর্জনকে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে।

দুর্ভাগ্যবশত আমাদের অনেকগুলো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানই এখন অত্যন্ত ভঙ্গুর ও অকার্যকর অবস্থায়। ব্যাপক দলীয়করণ, মেধাশূন্যতা ও দুর্নীতির কারণে আমাদের প্রশাসন বর্তমানে এক করুণ অবস্থার মধ্যে নিপতিত। আইনসভা এখন প্রশাসনের করায়ত্ত এবং এর স্বাধীন সত্তা বিলুপ্ত ফলে এই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটি এখন সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিতে অপারগ। আমাদের বিচার বিভাগ এক মহাপ্রলয়ের শিকার এবং এর স্বাধীনতা ব্যাপকভাবে খর্ব, তাই বিচারহীনতার এক ভয়াবহ সংস্কৃতি আমাদের দেশে সৃষ্টি হয়েছে। নির্বাচন কমিশনকেও অনুগত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোও দলীয়করণের শিকার এবং নাগরিকদের প্রয়োজনীয় সেবা দিতে আজ বহুলাংশে অপারগ। এসব প্রতিষ্ঠানকে কার্যকর ও দায়বদ্ধ করার সুস্পষ্ট পথরেখা নির্বাচনী ইশতেহারে থাকতে হবে।

বাংলাদেশে নাগরিকদের সংবিধান স্বীকৃত অনেকগুলো মৌলিক অধিকার ক্রমাগতভাবে সংকুচিত হচ্ছে। সংকুচিত হচ্ছে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও নাগরিক সমাজের ওয়াচ-ডগের ভূমিকা পালনের সুযোগ। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো নিবর্তনমূলক আইন পাস নাগরিকের মৌলিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার উপভোগের ক্ষেত্রে চরম হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া ক্রমবর্ধমান হারে প্রসার ঘটছে গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার মতো ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা। মানবাধিকার সংরক্ষণে কী সুস্পষ্ট ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তা রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারে থাকতে হবে।

সহিংস জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে থাকলেও ধর্মীয় উগ্রবাদ আমাদের সমাজে বিস্তার ঘটছে বলে অনেকের আশঙ্কা। এ সমস্যা সমাধানের জন্য সমাজে বিরাজমান পরিচয়ভিত্তিক বিদ্বেষের অবসান ঘটাতে হবে। মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করতে হবে নাগরিকত্ববোধ ও পারস্পরিক সহমর্মিতা। একই সঙ্গে বিস্তার ঘটাতে হবে সামাজিক সম্প্রীতি ও বহুত্ববাদের মানসিকতা, যা বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র সৃষ্টির মূল চেতনার অংশ। এ ‘ফাউন্ডিং প্রিন্সিপালগুলো’ সম্পর্কে নাগরিকদের অনমনীয়তা সৃষ্টির এবং উগ্রবাদ বা জঙ্গিবাদ রোধের সম্ভাব্য কৌশল সম্পর্কে রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে সুস্পষ্ট পথরেখা থাকতে হবে।

পরিশেষে নির্বাচনী ইশতেহার যেন অতীতের মতো নিতান্তই সুবচনের ফুলঝুরিতে পরিণত না হয় সে লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর নাগরিকদের আশ্বস্ত করতে হবে। এই আশ্বাসের অংশ হিসেবে নির্বাচনী ইশতেহারে প্রদত্ত অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়নের একটি সংক্ষিপ্ত কর্মপরিকল্পনাও এতে অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। অর্থাৎ ইশতেহারের আলোকে এবং এসডিজি, পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ও দলের ভিশনকে বিবেচনায় নিয়ে প্রথম ১০০ দিনের কর্মসূচি; প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম বছরে এবং দীর্ঘ মেয়াদে অর্জন করা যাবে এমন সংখ্যাগত ও গুণগত লক্ষ্য নির্ধারণ করে একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে হবে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক