ওপরে উঠলে মাথা ঘুরে যায়

বছর ১২ বয়সের একটা ছেলেকে নিয়ে তার বাবা ট্রেনে করে যাচ্ছেন। ছেলেটা জানালা দিয়ে তাকিয়ে বাবাকে বলছে, বাবা, বাবা, দেখো, গাছগুলো সব পেছনের দিকে দৌড়াচ্ছে। বাবা, বাবা, দেখো, মেঘগুলো আমাদের সঙ্গে যাচ্ছে। বাবা বাবা, দেখো দেখো, কতগুলো গরু মাঠে চরছে।
তখন একজন যাত্রী বাবাকে বললেন, আপনার ছেলেকে বোধ হয় ডাক্তার দেখানো দরকার। ওর বোধ হয় কোনো সমস্যা আছে।
বাবা বললেন, আমার ছেলে বহুদিন ধরে চোখে দেখতে পেত না। আমরা সম্প্রতি অপারেশন করে চোখ সারিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছি।
বাইরে থেকে দেখে চট করে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে হয় না। কারণ, ভেতরে গভীরে অন্য কোনো গল্প থাকতে পারে।
একটা গাধা গর্তে পড়ে গেছে। তার মালিক কৃষক তখন ওপর থেকে কোদাল দিয়ে গর্তে মাটি ফেলতে লাগল। মাটি পড়তে লাগল গাধার মাথায়–কানে। সে খুব বিরক্ত হতে লাগল। শেষে গর্তটা যখন বুজে আসতে লাগল, গাধাটা দেখতে পেল, সে বাইরে সবুজ ঘাস দেখতে পাচ্ছে। আরেকটু মাটি ফেলা হলে সে লাফিয়ে উঠতে পারল গর্তের বাইরে। গাধা কান–মাথা ঝেড়ে সবুজ ঘাসের দিকে চলে গেল। যাওয়ার আগে বলে গেল, ধন্যবাদ।
অনেক সময় মনে হতে পারে, আমাদের বুঝি অপমান করা হচ্ছে, গায়ে-মাথায় ময়লা ছোড়া হচ্ছে। পরে আমরা বুঝতে পারি, যা করা হয়েছে, তা আমাদের ভালোর জন্যই।
একটা হাতি বাঁধা এক পায়ে চিকন একটা দড়ি দিয়ে। পাশ দিয়ে যাচ্ছেন এক পথিক। তিনি বিস্মিত। এত বড় একটা প্রাণী, এত যার শক্তি, সামান্য একটা দড়ি দিয়ে তাকে বেঁধে রাখা গেল! তিনি গেলেন প্রশিক্ষকের কাছে। আমাকে বুঝিয়ে বলুন তো, এত বড় হাতি এই দুর্বল দড়িতে বেঁধে রাখা সম্ভব হয়েছে কীভাবে?
প্রশিক্ষক বললেন, হাতিটা যখন ছোট ছিল, তখন তাকে এই দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হতো। তখন সে এই দড়ি ছিঁড়তে পারত না। ওর ধারণা হয়েছে, এই দড়ি কখনো ছিঁড়বে না। তাই সে কখনো চেষ্টা করে না।
জনগণও তেমনি। জনগণের ধারণা থাকে, তারা কখনো বাঁধন ছিঁড়ে বেরোতে পারবে না। তাদের নিজেদের যে কী শক্তি আছে, এটা তারা অনেক সময়ই অনুধাবন করে উঠতে পারে না।
নোয়াম চমস্কি বলেন, ‘পপুলার কালচার থেকে শুরু করে প্রোপাগান্ডা ব্যবস্থার সর্বত্র একটা সার্বক্ষণিক চাপ আছে, জনগণকে এই কথা বিশ্বাস করাতে হবে। জনগণ অসহায়, তাদের একমাত্র ভূমিকা হলো সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া আর সিদ্ধান্ত পালন করা।’
নোয়াম চমস্কি তাঁর ১৯৬৭ সালে ‘বুদ্ধিজীবীর দায়িত্ব’ শীর্ষক বিখ্যাত বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘বুদ্ধিজীবীর দায়িত্ব হলো সত্য বলা এবং মিথ্যাকে উন্মোচন করা।’
ইতিহাসে এই কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে যে আমাদের বুদ্ধিজীবীরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁরা সত্য উচ্চারণ করেছেন। কোন সত্য? সরকারি সত্য নয়। আইয়ুব খান, মোনায়েম খান যাকে সত্য বলে প্রচার করত তা নয়। ক্ষমতা যেটাকে সত্য বলে জনগণকে বিশ্বাস করাতে চাইত, তা নয়। তাঁরা নতুন কথা বলতেন। তাঁরা বিদ্রোহের কথা বলতেন। তাঁরা জনগণের জাগরণের কথা বলতেন। তাঁরা মানুষের মুক্তির কথা বলতেন। সে জন্য তাঁদের দাম দিতে হয়েছে। তাঁদের হত্যা করা হয়েছে। তালিকা প্রস্তুত করে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাঁদের। পিঠমোড়া করে বেঁধে, চোখ বেঁধে তাঁদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল আলবদর আর পাকিস্তানি সৈন্যরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, লেখক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কবি...তাঁদের তালিকা ছিল বিশাল আর তাঁদের বাছাই ছিল নির্ভুল। ১৯৭১-এ বুদ্ধিজীবীদের হত্যার মধ্য দিয়ে যে শূন্যতা তৈরি হলো, যে ক্ষতি হলো এই জাতির, তা আজও পূর্ণ হয়নি।
কিন্তু বুদ্ধিজীবিতার ওপরে হামলা আজও অব্যাহত আছে। এখনো তালিকা করা হচ্ছে লেখক-বুদ্ধিজীবী-চিন্তাশীল চিন্তার বিদ্রোহী মানুষদের, তাঁদের ওপর হামলা করা হচ্ছে। অন্যদিকে বুদ্ধিজীবীর প্রধান কাজ যে চিন্তার বিদ্রোহ, সেটাও আমরা ভুলে যাচ্ছি। ক্ষমতা, কায়েম হয়ে বসা ব্যবস্থা যাকে বুদ্ধিজীবিতা বলে, তাকেই অনুমোদন দেওয়া যেন দস্তুর হয়ে উঠছে। এটা খুব ভয়ানক লক্ষণ।
একটা চিড়িয়াখানায় একটা উট আর তার বাচ্চা ছিল।
বাচ্চাটা বলল, মা, আমাদের পিঠে কুঁজ থাকে কেন?
আমরা হলাম উট। আমরা মরুভূমির প্রাণী। এই কুঁজে আমরা পানি সংরক্ষণ করি। মরুভূমির শুষ্ক প্রান্তরে যেন আমরা পানি ছাড়া চলতে পারি, তাই এই ব্যবস্থা।
উটের বাচ্চা এরপর বলল, মা, আমাদের পা এত লম্বা কেন? শক্ত কেন?
যাতে মরুভূমির তপ্ত বালুময় পথে আমরা চলতে পারি।
মা, আমাদের চোখের পাপড়িগুলো এত বড় বড় কেন?
মরুভূমির ধূলিকণা যাতে আমাদের চোখে না ঢোকে। রোদ যেন আমাদের দুচোখ ধাঁধিয়ে না দেয়। সে জন্য আমাদের চোখের পাপড়ি বড়।
মা সবকিছুই যদি মরুভূমিতে চলার জন্য দেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে আমরা চিড়িয়াখানার খাঁচার মধ্যে বন্দী কেন?
গল্পগুলো ইন্টারনেটে পাওয়া এবং ইংরেজি থেকে অনূদিত। শেষ গল্পটা নিচ্ছি চণ্ডী লাহিড়ীর ‘চলমান প্রসঙ্গ’ থেকে। জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী জর্জ লেবের প্রথম জীবনে ছিলেন রাজমিস্ত্রি। মন্ত্রী হওয়ার পর তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, ‘প্রথম ও পরবর্তী জীবনের মধ্যে তফাত কোথায়?’
‘কোনো তফাত নেই। ওপরে উঠলে দুটি ক্ষেত্রেই মাথা ঘুরে যায়।’

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক