শহীদের মর্যাদা ও বিজয়োত্তর করণীয়

বিজয় আল্লাহর দান। পবিত্র আল–কোরআনে এ প্রসঙ্গে ‘আল–ফাত্হ’ নামে আল্লাহ তাআলা একটি সুরাও অবতীর্ণ করেছেন। তাতে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আমি আপনাকে সুস্পষ্ট বিজয় দান করেছি।’ (সুরা-৪৮ আল–ফাত্হ, আয়াত: ১)। এই সুরার শেষাংশে বিজয়ের জন্য স্বপ্ন ও পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ রয়েছে। এতে বর্ণিত হয়েছে, ‘অবশ্যই আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসুল (সা.)-এর স্বপ্ন সত্যই বাস্তবায়ন করে দিয়েছেন। অবশ্যই তোমরা মসজিদে হারামে প্রবেশ করবে নিরাপদে; “ইনশা আল্লাহ। ”’ (সুরা-৪৮ আল–ফাত্হ, আয়াত: ২৭)।

বিজয়ের জন্য আল্লাহর সাহায্য প্রয়োজন; আল্লাহর সাহায্য প্রাপ্তির জন্য প্রয়োজন আল্লাহর ওপর ভরসা ও নির্ভরতা। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলার নির্দেশনা হলো, ‘আর তুমি কখনো “ইনশা আল্লাহ” (আল্লাহ চাইলে) বলা ব্যতিরেকে কোনো বিষয়ে এমন বলবে না যে আমি ভবিষ্যতে এই কাজ করব।’ (সুরা-১৮ কাহাফ, আয়াত: ২৩)।

নবী, রাসুল পাঠানোর উদ্দেশ্য হলো শান্তি, সাম্য ও ন্যায়ের বিধান প্রতিষ্ঠা করা। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তিনি মহান আল্লাহ! যিনি তাঁর রাসুল (সা.)-কে পাঠিয়েছেন হিদায়াত, সঠিক পথনিদের্শ ও সত্য দীন পরিপূর্ণ জীবনবিধান সঙ্গে দিয়ে, যাতে তিনি তা সব মতবাদের ওপর বিজয়ীরূপে প্রতিষ্ঠা করেন; সাহায্যকারী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট।’ (সুরা-৪৮ আল–ফাত্হ, আয়াত: ২৮)।

আল্লাহর সাহায্যেই বিজয় আসে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে এবং আপনি মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দীনে প্রবেশ করতে দেখবেন, তখন আপনি আপনার প্রতিপালকের প্রশংসাসহ তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করুন এবং তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করুন; তিনি তো তওবা কবুলকারী।’ (সুরা-১১০ নাসর, আয়াত: ১-৩, পারা: ৩০)।

জীবমাত্রই মরণশীল। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘সকল সত্তাই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করবে।’ (সুরা-৩ আলে ইমরান, আয়াত: ১৮৫)। সব ধরনের মৃত্যুর মধ্যে গৌরবের ও মর্যাদার মৃত্যু হলো শহীদের মৃত্যু বা শহীদি মরণ। ‘শহীদ’ আরবি শব্দ, মূল আরবি উচ্চারণে এটি ‘শাহীদ’। প্রমিত বাংলা বানানে ‘শহিদ’ ব্যবহৃত হয়। এর অর্থ হলো ‘উপস্থিত’, ‘প্রত্যক্ষকারী’, ‘সাক্ষ্যদাতা’ ও ‘সাহায্যকারী’। যার মূল ধাতু হলো ‘শাহদ’ এবং এর ক্রিয়ামূল হলো ‘শাহাদাত’। নামাজেও এই সাক্ষ্য রয়েছে ‘তাশাহহুদ’ নামে; সাক্ষ্য রয়েছে আজানে এবং ইকামাতেও। তাঁদেরও শহীদ বলা হয়, যাঁরা আল্লাহর প্রেমে নিজের সবকিছু কোরবান করে দিয়েছেন।

আল্লাহ তাআলার আসমাউল হুসনা বা সুন্দর নামগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি নাম হলো ‘শাহীদ’। ইসলামি পরিভাষায় ‘জিহাদে’ বা ধর্মীয় যুদ্ধে যাঁরা দীন ইসলামের জন্য জীবন দেন, তাঁদের শহীদ বলা হয়। শহীদ হলো সবচেয়ে সম্মানীয় ব্যক্তি। শহীদকে শাহাদাতের পর জানাজার আগে গোসল দিতে হয় না; বরং পরনের কাপড়, জুতা, মোজাসহ দাফন করা হয়। শহীদের সব পাপ ও ভুলত্রুটি আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। শহীদ শাহাদাতের চিহ্ন নিয়ে হাশরের ময়দানে উঠবেন এবং অন্যদের জন্য সুপারিশ করবেন। শহীদি মৃত্যু সর্বাধিক সম্মানের। নবী-রাসুলরাও শাহাদাতের জন্য দোয়া করতেন।

যাঁরা নিজের জীবন, সম্পদ ও সম্মান রক্ষার জন্য এবং ন্যায্য অধিকার আদায়, প্রাপ্য অধিকার রক্ষা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করেন, তাঁরাও গাজি এবং শহীদের মর্যাদা লাভ করেন। হাদিস শরিফে এসেছে হজরত জায়েদ ইবনে আমর ইবনে নুফাইল (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার সম্পদ রক্ষার জন্য জীবন দিল সে শহীদ; যে ব্যক্তি তার জীবন রক্ষার জন্য নিহত হলো সে শহীদ, যে ব্যক্তি তার ধর্ম রক্ষার জন্য জীবন দিল সে শহীদ, যে ব্যক্তি তার পরিবার, আত্মীয়স্বজন রক্ষার জন্য জীবন দিল সে শহীদ।’ (আবু দাউদ ও তিরমিজি, হাদিস: হাসান-সহিহ)। শহীদ ও গাজিরা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান।

বিজয় কাঙ্ক্ষিত, বিজয় গৌরবের; কিন্তু বিজয় যদি হয় লক্ষ্যভ্রষ্ট আর বিজেতারা যদি হন নীতিভ্রষ্ট; কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হীন স্বার্থ যদি পায় অগ্রাধিকার তাহলে সে বিজয় প্রকৃত আনন্দ উপহার দেয় না। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের স্বাধীনতা ও বিজয়কে কিয়ামত পর্যন্ত অক্ষুণ্ন রাখুন, মুক্তির প্রকৃত স্বাদ আস্বাদনের তৌফিক দান করুন এবং বিজয়-পরবর্তী করণীয় অনুধাবন ও প্রতিপালনের সুযোগ দান করুন।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক
smusmangonee@gmail, com