উপকূলের উপদ্রুত বঞ্চিত মানুষ

পৃথিবীর অনেক বড় নগরী ও দেশ গড়ে উঠেছে জলের ধারে। নিউইয়র্ক, সিয়াটল, লন্ডন, এমনকি কাছের দ্বীপরাষ্ট্র সিঙ্গাপুর এর উদাহরণ। অথচ বাংলাদেশে জলের ধারে বসবাস মানেই দুর্গতি আর দুর্ভোগ। বুড়িগঙ্গা পার হয়ে মাদারীপুরের জাজিরা থেকে সন্দ্বীপ—সর্বত্র এর প্রমাণ মেলে।
সন্দ্বীপের কথাই ধরা যাক। প্রায় হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যসমৃদ্ধ এই দ্বীপ। দেশের ৪৯২টি উপজেলার মধ্যে শুধু সন্দ্বীপ উপজেলার মানুষের কাছ থেকেই দেশে প্রাপ্ত মোট রেমিট্যান্সের ১১ শতাংশ আসে। দেখা যাক এখানে কী ঘটছে।

অনুন্নয়ন ও অসম উন্নয়ন
ব্রিটিশ আমল থেকেই রয়্যাল স্টিম নেভিগেশন কোম্পানির পরিচালিত জাহাজ ১২ মাস (শুধু বিপৎসংকেতের সময় ছাড়া) চট্টগ্রাম থেকে সন্দ্বীপ যেত। পাকিস্তান আমলেও স্টিমারে চট্টগ্রামের সদরঘাট থেকে হাতিয়া হয়ে বরিশাল যাওয়া যেত। বাংলাদেশ আমলেও এ সুযোগ অব্যাহত ছিল। ২০১২-১৩ সাল থেকে তা বন্ধ হয়ে গেছে। এখন ঢাকা থেকে হাতিয়া যাওয়া যায় কিন্তু ঢাকা থেকে সরাসরি সন্দ্বীপ যাওয়ার ব্যবস্থা নেই। এখন সন্দ্বীপে যাতায়াতের ব্যবস্থা চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের নিয়োজিত ঠিকাদার পরিচালিত চট্টগ্রামের কুমিরা থেকে সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া পর্যন্ত স্পিডবোট সার্ভিস। শীতকালে দ্রুত ও সুবিধাজনক হলেও বর্ষা মৌসুমে উত্তাল সমুদ্রে যাতায়াত বিপজ্জনক, তাই স্পিডবোট সার্ভিস বেশির ভাগ সময়ই বন্ধ থাকে। এসব স্পিডবোটে রাডার বা যাত্রীর নিরাপত্তার জন্য লাইফ জ্যাকেট নেই। এ ছাড়া সরাসরি উপকূলে ওঠার ব্যবস্থা নেই। অসুস্থ, শারীরিক প্রতিবন্ধী, প্রসূতি মা ও শিশুদের যাতায়াতের জন্য দুই দিকের ঘাটেই কোনো ব্যবস্থা নেই। এক ব্যক্তিকে পাঁজাকোলা করে স্পিডবোটে তোলা দেখেছি। অনেক সময় বেশ কিছুটা পথ কাদামাটি ঠেলে স্পিডবোটে উঠতে হয়। কাদার ওপর নৌকা চলে! স্পিডবোট ছাড়া ইঞ্জিনচালিত কাঠের তৈরি ট্রলার যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হয়।
১৯৬৫ সালেও চট্টগ্রামের নিয়াজ স্টেডিয়ামের পাশের হেলিপ্যাড থেকে হেলিকপ্টারে সন্দ্বীপ যাওয়া যেত। তখন দেশে হেলিকপ্টার জনপ্রিয় ছিল না। এখন রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, খেলোয়াড়, অভিনেতা, মাওলানাসহ অনেকে হেলিকপ্টারে যাতায়াত করেন। কিন্তু উপকূলের মানুষের যাতায়াতের জন্য হেলিকপ্টার সার্ভিস নেই। তাই সন্দ্বীপের যাতায়াতব্যবস্থার ক্ষেত্রে অবনমন ঘটেছে। উন্নয়ন যে একেবারেই হয়নি, তা নয়। রাস্তাঘাট হয়েছে প্রচুর। রক্ষণাবেক্ষণে সমস্যা আছে এবং রাস্তাঘাটের উন্নয়নে এলাকাভেদে অসমতা আছে। বিশেষ করে, পৌরসভার রাস্তাগুলোর অবস্থা করুণ। পানীয় জল ও স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগারের ক্ষেত্রে অগ্রগতি লক্ষণীয়।

আশার বিদ্যুৎ
সাবমেরিন কেব্লের মাধ্যমে সম্প্রতি সন্দ্বীপে বিদ্যুৎ–সংযোগ দেওয়া হয়েছে। ৩০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন লাইন এবং ১০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন সাবস্টেশন বসানো হয়েছে। বৈদ্যুতিক খুঁটি বসানো হচ্ছে। এর ফলে বরফকলসহ অন্যান্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকারখানা স্থাপিত হলে কর্মসংস্থান বাড়বে। সরকার এখানে শতভাগ বিদ্যুতায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। দুর্নীতিমুক্তভাবে সরকারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।

দুই সন্দ্বীপ
সন্দ্বীপে দুই ধরনের লোকের বসবাস। একদিকে রেমিট্যান্সনির্ভর বিত্তশালী জনগোষ্ঠী। সন্দ্বীপের সাধারণ দোকানে বিদেশ থেকে আমদানি করা ফলের সম্ভার দেখা যায়। দ্রব্যমূল্য ও পরিবহন ব্যয় বেশি। যেমন উত্তর থেকে দক্ষিণ সন্দ্বীপে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় যাওয়ার ভাড়া ১ হাজার ৫০০ টাকা। অন্যদিকে সহায়সম্বলহীন নদীভাঙা মানুষ। এমনই একজন নূরুদ্দিনের সঙ্গে রহমতপুর ঘাটে কথা হলো। ৩৭ বছরের এই যুবক বললেন, ‘ছ লড়া দিছি।’ অর্থাৎ তিনি ছয়বার বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। আরও বললেন, মারা গেলে তাঁদের মতো মানুষের কবর দেওয়ারও জায়গা নেই। অন্যান্য নদীভাঙা মানুষের মতো নদীতেই তিনি সর্বস্ব হারিয়েছেন।

বদ্বীপ ও উপকূলীয় অঞ্চলের সম্ভাবনা
সন্দ্বীপসহ সব উপকূলের জনপদের বড় সমস্যা হচ্ছে উপকূলীয় অঞ্চল ব্যবস্থাপনায় জাতীয় অনাগ্রহ ও প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব। বিভিন্ন উপকূলে হাজার হাজার বর্গমাইল নতুন ভূমি জেগে উঠছে। এগুলোকে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কাজে লাগাতে হবে। স্বাধীনতার পর থেকে শুনে আসছি, সন্দ্বীপকে ক্রসড্যামের মাধ্যমে নোয়াখালীর মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করা হবে। এ জন্য একনেকে প্রকল্পও অনুমোদিত আছে। কিন্তু প্রভাবশালীদের বাধার কারণে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেই। ২০১২ সালে প্রধানমন্ত্রী সন্দ্বীপ সফরে এলে তাঁকেও এ বিষয়ে অবহিত করা হয়।

দুর্বল জনপ্রতিনিধি ও অনৈক্য
উপকূলীয় অঞ্চলের দুর্বল জনপ্রতিনিধি ও তাঁদের মধ্যে অনৈক্য এসব অঞ্চলের অনগ্রসরতার একটি প্রধান কারণ। উদাহরণস্বরূপ সন্দ্বীপের প্রতিবেশী এলাকা নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ ও ভোলার দুই বড় দলের রাজনৈতিক নেতারা জাতীয় পর্যায়ের নেতা ও মন্ত্রী। সন্দ্বীপের সাংসদ হতে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়ন তাঁদের অনুগ্রহের ওপর নির্ভরশীল। তাই সন্দ্বীপের নেতারা চিরকালই তাঁদের তুষ্ট করতেই ব্যস্ত। দীর্ঘদিন ধরে সন্দ্বীপে ‘সবকিছু বিজয়ীর’—এ নীতি চলে আসছে। জাতীয় সংসদ, উপজেলা ও পৌরসভার নেতৃত্ব বিভক্ত ও কোন্দলে লিপ্ত। কেউ কেউ এমনকি দ্বীপে বসবাসও করতে পারেন না। নিজ দলের ক্ষেত্রেই এ অবস্থা। বিরোধী দলের হলে তো কথাই নেই। শুনেছি, বিরোধিতার কারণে সন্দ্বীপের সড়কে ৫০০ সড়কবাতি লাগানো সম্ভব হয়নি।
কাজী মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন সিএসপি ছিলেন সন্দ্বীপের সন্তান। দীর্ঘদিন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে অধিষ্ঠিত থাকার পর রাষ্ট্রপতির সচিব থাকাকালে ১৯৮৪ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর শোকসভা হবে কি না—এ নিয়ে সন্দ্বীপের বাসিন্দাদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। উপস্থিত কেউ কেউ তাঁকে বেইমান বলেন। কারণ, বরগুনার বরাদ্দ কেটে সন্দ্বীপের বেড়িবাঁধের বরাদ্দ প্রদানের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রস্তাব করলে তিনি তা নাকচ করে বলেন, ‘সন্দ্বীপও আমার দেশ, বরগুনাও আমার দেশ। সন্দ্বীপকে সাহায্য করার ঐকান্তিক ইচ্ছা সত্ত্বেও আমি বরগুনাকে বঞ্চিত করতে চাই না।’ তখন পদস্থ সরকারি কর্মকর্তারাও সারা দেশকে নিজের দেশ মনে করতেন এবং সব এলাকার সম-উন্নয়নে কাজ করতেন। আজ মন্ত্রীরাও তাঁদের শুধু নিজেদের এলাকার প্রতিনিধি মনে করেন। ফলে অবহেলিত উপকূলীয় অঞ্চলের ন্যায্য স্বার্থ দেখার কেউ নেই।

ভাসানচর যাত্রা
সন্দ্বীপের মানুষের একটা ক্ষোভের কারণ হলো নেয়ামস্তি ইউনিয়নে তাদের পিতৃপুরুষের জমি ভেঙে যে ভাসানচর (স্থানীয়ভাবে ঠেঙ্গারচর, গুগল ম্যাপে চর পিয়া) জেগে উঠেছে, তা নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আমরা সরেজমিনে তা লাল বোটে চড়ে দেখতে যাই। এই লাল বোটে সন্দ্বীপে নামতে গিয়েই গত বছর ১৮ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। সন্দ্বীপের বাংলাবাজার ঘাট থেকে সেখানে যেতে সময় লাগল এক ঘণ্টার মতো। স্পিডবোটে আধা ঘণ্টার বেশি সময় লাগার কথা নয়। অন্যদিকে হাতিয়ার নলচিরা ঘাট থেকে ভাসানচরে যেতে ট্রলারে প্রায় তিন ঘণ্টা লাগে। ভাসানচর গিয়ে দেখি, নদীভাঙনের শিকার চরটিতে নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবস্থানের জন্য বিরাট কর্মযজ্ঞ চলছে। চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার ২০১৭ সালের অক্টোবরের পরিদর্শন প্রতিবেদনে ভাসানচরকে হাতিয়ার অন্তর্ভুক্ত বলে উল্লেখ করেছেন। এ ব্যাপারে হাইকোর্টে মামলা হয়েছে। নিকটবর্তী স্থলভাগ, নদী শিকস্তি–পয়স্তি আইন ও বিধি বিবেচনা না করেই ক্ষমতাধারীদের প্রভাবে চরটিকে হাতিয়ার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নদীভাঙা মানুষের একটা আশা থাকে, তাদের ভাঙা এলাকায় নতুন চর জাগলে তারা আবার সেখানে বসতি স্থাপনের অগ্রাধিকার পাবে। কিন্তু তাদের আশার গুড়ে বালি। কেননা, এখানে আইনের চেয়ে কর্তৃত্বের ক্ষমতাই বড়।

সাধারণ সুপারিশ
শুধু সন্দ্বীপই নয়, প্রায় সব উপকূলীয় দ্বীপই অবহেলা ও বৈষম্যের শিকার। এতে শুধু উপকূলীয় লোকজনই যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা নয়, দেশ ও জাতি বঞ্চিত হচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলের বিকাশের জন্য সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে; এ জন্য জনবলকে প্রশিক্ষিত করতে হবে। আমাদের উন্নয়ন প্রচেষ্টা সরকারি দপ্তরচালিত বিধায় এ জন্য বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিস সৃষ্টি করতে হবে। ইতিপূর্বে উপকূলীয় দ্বীপগুলোর উন্নয়ন দেখাশোনার জন্য ‘অফশোর আইল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বোর্ড’ ছিল। সেটা বিলুপ্ত করা হয়েছে। দপ্তরটি পুনর্জীবিত করা যেতে পারে। অথবা ক্ষমতাপ্রাপ্ত নতুন দপ্তর সৃষ্টি করা যেতে পারে। বর্তমান ব্যবস্থা উপকূলীয় দ্বীপগুলোর স্বার্থ সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে।

সন্দ্বীপে কী করতে হবে?
ন্যূনতম নাগরিক অধিকার হিসেবে ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে ১২ মাস সন্দ্বীপ আসা–যাওয়ার নিরাপদ ব্যবস্থা করতে হবে। চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ নিয়োজিত বেসরকারি ঠিকাদার ছাড়াও বিআইডব্লিউটিসিকে এর দায়িত্ব নিতে হবে। বর্তমানের একচেটিয়া ব্যবস্থার পরিবর্তে প্রতিযোগিতামূলক বেসরকারি অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। সন্দ্বীপকে নদীবন্দর ঘোষণা করে নৌযান চলাচলের নিরাপত্তা বিধান করতে হবে। বর্তমানে গুপ্তছড়া ঘাটটি শুধু দক্ষিণ সন্দ্বীপের জন্য সুবিধাজনক। তাই উত্তর সন্দ্বীপের অধিবাসীদের যাতায়াতের জন্য গাছুয়া ঘাট ও তৎসংলগ্ন রাস্তাটির সংস্কার করতে হবে। নদীভাঙা পরিবারগুলোকে জমি দিতে হবে, তাদের জন্য গৃহ নির্মাণ করতে হবে। ভাসানচরের সঙ্গে হাতিয়ার অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে হবে এবং আইনসংগতভাবে এর নিষ্পত্তি করতে হবে। স্থলভাগের সঙ্গে সন্দ্বীপের সংযোগের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ক্রসড্যাম নির্মাণ করতে হবে।

সুবিধাজনকভাবে স্পিডবোটে সন্দ্বীপ গিয়ে চড়ুইভাতির মতো আতিথেয়তা গ্রহণ করে ফিরে এসেছি। কিন্তু ফেলে আসা মানুষগুলোর নৈমিত্তিক দুর্ভোগের চিত্র দেখে এসে তাদের জন্য খারাপই লাগছে।

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান: সাবেক সচিব ও প্রতিষ্ঠাতা সিইও ইডকল
fouzul. khan@gmail. com