সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ

বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনে আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত সমন্বয় সভায় যেসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, তাতে আশ্বস্ত হওয়ার কিছু নেই। বরং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো কোনো কর্মকর্তা ‘সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে’ সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ, ৭২ ঘণ্টা ইন্টারনেটের গতি কমানো এবং কেন্দ্র থেকে টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার বন্ধের যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তা আমাদের উদ্বিগ্ন না করে পারে না। এসব প্রস্তাবের গুণাগুণ বিচারের আগে সংশ্লিষ্টদের যে প্রশ্নটি করা প্রয়োজন তা হলো, সংবাদমাধ্যমে খবর প্রচারের কারণে সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যাহত হয়েছে, এ রকম কোনো প্রমাণ কি তাঁরা দিতে পারবেন? আমরা হলফ করে বলতে পারি, সেই প্রমাণ তাঁরা দেখাতে পারবেন না।

 সাংবাদিক বা সংবাদমাধ্যমের কাজ হলো সত্য বা সঠিক তথ্য পাঠক ও দর্শকদের কাছে জানানো। যে মাধ্যমটি দ্রুততম সময়ে সেটি করতে পারবে, সাংবাদিকেরা সেটিই ব্যবহার করবেন। এ ক্ষেত্রে সরাসরি সম্প্রচার ও ইন্টারনেটের অপরিহার্যতার কথা অস্বীকার করা যায় না। যদি নির্বাচনের প্রক্রিয়াটি যথাযথভাবে পরিচালিত হতো, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পেশাগত দায়িত্ব পালন করত, প্রত্যেক প্রার্থী ও দলের আইনত যে সুযোগ আছে সেগুলো তারা ব্যবহার করতে পারত, তাহলে এসব অসার প্রস্তাব দেওয়ার প্রয়োজন হতো না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের কাজ প্রত্যেক প্রার্থী, তাঁর সমর্থক এবং ভোটারের নিরাপত্তা দেওয়া। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক সময় ভুল ও উসকানিমূলক প্রচার চালানো হয়ে থাকে, কিন্তু সেটি বন্ধের উপায় ইন্টারনেটের গতি কমানো বা সংবাদমাধ্যমের ওপর কড়াকড়ি আরোপ নয়। ভুল তথ্যের মোক্ষম প্রতিষেধক হচ্ছে সঠিক তথ্যটি জনগণকে জানানো। ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে তথ্যপ্রবাহ মন্থর করলে মানুষ সঠিক সময়ে সঠিক খবর পাবে না। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে সরাসরি সম্প্রচার না করার পক্ষে যেসব যুক্তি দেওয়া হয়েছে, তা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। কেন্দ্র থেকে সরাসরি তথ্য সম্প্রচার করলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাজুক হয় না, বরং এ ধরনের প্রচারের কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচিত সরাসরি সম্প্রচারের বিষয়টিকে  ইতিবাচকভাবে দেখা। একই কথা প্রযোজ্য ইন্টারনেটের বেলায়ও। ইন্টারনেট ব্যবহার করা হয় দ্রুত তথ্যের আদান-প্রদানের জন্য এবং সংবাদমাধ্যমের কর্মীরাই সেটি বেশি ব্যবহার করে থাকেন। নির্বাচনের সময় ইন্টারনেটের গতি মন্থর করলে দ্রুত তথ্যের আদান-প্রদানের কাজও ব্যাহত হবে এবং জনগণকেও দ্রুত তথ্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত করা হবে, যা কাম্য হতে পারে না।

রোম যখন পুড়ছিল, তখন সম্রাট নিরো বাঁশি বাজাচ্ছিলেন বলে একটি প্রবাদ চালু আছে। সারা দেশে যখন নির্বাচন নিয়ে হামলা-ভাঙচুর ও হানাহানি চলছে, তখন আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরীহ সংবাদমাধ্যমের রাশ টেনে ধরতে উঠেপড়ে লেগেছে। যেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; প্রার্থী, সমর্থক তথা নাগরিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি জরুরি ছিল, তার প্রতিকারের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার অঙ্গীকার না পাওয়া অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। তাঁরা চলেছেন উল্টো পথে।

এ অবস্থায় আমরা নির্বাচন কমিশনের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই, সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে। নির্বাচনের বাকি আর মাত্র ১৫ দিন। এরই মধ্যে ভোটকেন্দ্রিক সব সহিংসতা, হাঙ্গামা বন্ধ করতে হবে। নির্বাচনের সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করতে হবে। ইসি সচিব বলেছেন, বড় ধরনের ফৌজদারি অপরাধের মামলা নেই এমন ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার না করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এখন কোনটি বড় আর কোনটি ছোট অপরাধ, সেই বিচারের ভারও পুলিশের হাতে। তারা একই সঙ্গে বাদী ও বিচারকের ভূমিকায় নেমেছে। এ অবস্থায় নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি কোনোভাবেই সম্ভব নয়।