হাসিনা, কন্যাদের কাহিনি

হাসিনা, কন্যাদের কাহিনি চলচ্চিত্রের পোস্টার
হাসিনা, কন্যাদের কাহিনি চলচ্চিত্রের পোস্টার

ঘটনাটা চমকে দেওয়ার মতো। চমকে যাচ্ছে মানুষ। বিস্মিত হচ্ছে, মুগ্ধ হচ্ছে।

ঘটনা ঘটছে প্রেক্ষাগৃহে। রুপালি পর্দায় চলমান চিত্র। আগ্রহ ও কৌতূহলে রুদ্ধশ্বাস দর্শক। এই দর্শকদের জীবনে এ রকমের অভিজ্ঞতা এই প্রথম। এখন বহু প্রেক্ষাগৃহে যে চলচ্চিত্রটি সগৌরবে চলছে, তা প্রথাগত নয়। তা জীবনেরই হুবহু গল্প। সত্য বর্ণনা। দুজন দুঃখী সন্তান জীবনের চরম দুঃখ, অসহায়কাল, বেঁচে থাকা, হাহাকার ও আত্মোপলব্ধির বর্ণনা করেন মাত্র। রক্তমাংসের মানুষ পরম আগ্রহ নিয়ে দেখেন, অনুভব করেন দুজন রক্তমাংসের মানুষকেই। যা আগে কোনোকালে ঘটেনি।

নির্মাতা রেজাউর রহমান খান পিপলু অসাধ্য সাধন করেছেন। অতি সংবেদনশীলতা দিয়ে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিষয়টা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর যোগ্যতা। বিবৃত বিষয়ে যত আকর্ষণীয় উপাদান থাকুক না কেন, প্রতিমুহূর্তে অতি স্পর্শকাতরও। তার আবেদন অক্ষুণ্ন রেখে দর্শকের সামনে উপস্থাপনা করা অশেষ যোগ্যতা বিনা সম্ভব নয়। পিপলু খান সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন সহজে। চেষ্টা, নিষ্ঠা আর সততা থাকলে কঠিন গলে গলে সহজ হয়, হাসিনা ডকুচিত্র তার গতিময় প্রমাণ।

ডকুচিত্রের নাম হাসিনা, কন্যাদের কাহিনি। যাঁরা এ ছবি দেখেছেন, তাঁরা একটা অসাধারণ সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন। কেউ বলছেন না, চমৎকার একটা ডকুচিত্র দেখে এলাম। ডকুচিত্রের আঙ্গিক হলেও তাতে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের ভাষা খুঁজে পাওয়া যায়। সততার সঙ্গে বিবৃত বলেই দর্শকমনে কাতরতা সৃষ্টি হয়। অনুভবে আলোড়ন ওঠে।

দেশে রাজনীতি নিয়ে মেতে থাকা মানুষের অভাব নেই। আবার রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক নেই, এমন মানুষের সংখ্যাও অনেক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘হাসিনা’ নামে একটা ছবি নির্মিত হচ্ছে, এ খবরটা বেশ ছড়িয়েছিল। দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর মানুষ, সবচেয়ে আলোচিত, যিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী, তাঁকে বিষয় করে সিনেমা। স্বাভাবিকভাবেই ছবি মুক্তির আগে বহু মানুষের মধ্যে আগ্রহ, কৌতূহল জন্মেছে। রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক থাকুক বা না থাকুক ‘হাসিনা’ সম্পর্কে অবগত হওয়ার পর মানুষে মানুষে আলাপ, দেখার আগ্রহের কারণ ছবিটার ট্রেলার। যাঁরা দেখেছেন, সবাই মনে আচমকা একটা ধাক্কা অনুভব করেছেন।

দেশে রাজনীতি করা মানুষ ও না করা মানুষের সংখ্যা অনেক এবং উভয়ের মধ্যে ব্যাপক প্রভেদ রয়েছে। ভেদটা ধ্যানধারণা ও বিশ্বাসে। রাজনীতি যাঁরা করেন, বিশ্বাস নিয়েই তাঁরা নিজেদের ধ্যানধারণা ব্যক্ত করেন। যাঁদের সংশ্লিষ্টতা বা যুক্ততা নেই, তাঁরা জীবনের অন্যান্য বিষয়ে নিজেদের মত ব্যক্ত করেন, রাজনৈতিক বিষয়ে হয়তো করেন না। এটাকে অনীহা বা অনাগ্রহ বললে পরিষ্কার হয় না। ভাষার জন্য সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্রের জন্য লড়াইয়ের যে অনন্য গৌরব, এর সবই যে রাজনীতির অসাধারণ অবদান, তা রাজনীতি না করা মানুষেরাও ভালো করে জানেন, মানেন। তা সত্ত্বেও কেন অসংখ্যজনের মনে রাজনীতির প্রতি দুর্বলতা জন্মায় না, তা গভীর বিশ্লেষণের বিষয়।

প্রেক্ষাগৃহে এই চলচ্চিত্র দেখার জন্য সমবেত হয়েছিল উভয় ধরনের মানুষ। একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে কেন্দ্র করে নির্মিত চলচ্চিত্র যে ব্যক্তি রাজনীতি করেন না, তাঁর কাছে আগ্রহের বিষয় কেন হবে?—এমনটা মনে করেনি সাধারণ দর্শক। এই সিনেমার যিনি কেন্দ্রবিন্দু, মোটেও তিনি ‘বিন্দু’ নন, তিনি বৃহৎ বলয়ের। তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী, সবকিছুর কেন্দ্রব্যক্তিত্ব। এমন মানুষকে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ মানে, সাধারণ মনে বহু জিজ্ঞাসা আবর্তিত হওয়া স্বাভাবিক।

‘প্রধানমন্ত্রী’, ‘জননেত্রী’, ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা’ বা ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ ইত্যাদি বিশেষ পরিচয় ছাপিয়ে শুধু সাধারণ, অসহায় মানুষ হিসেবে যখন তাঁকে চলচ্চিত্রে দেখা যায়, তখন তিনি হয়ে ওঠেন সবার। পর্দায় দেখা মানুষটার বেদনায় দর্শকপ্রাণ আপ্লুত হয়। অদেখা চরিত্র, অজানা স্বভাব যখন পর্দাজুড়ে আলো ছড়িয়ে দেয়, সে আলোয় সাধারণের মনও ঝলমল করে ওঠে। আবার সে আলো ম্লান হয়ে গেলে বিষণ্নতায় মলিন হয়ে যায় দর্শকমনও। নির্মাতা একের পর এক মুহূর্ত উপস্থাপনায় অসাধারণত্ব দেখিয়েছেন, তা কখনোই বলা যাবে না। কোনো মুহূর্তই সৃজন নয়, সত্য বলে সহজেই দর্শকপ্রাণ বর্ণনায়, ঘটনায় আবেগতাড়িত হয়ে ওঠে। ক্যামেরাটা শুধু যন্ত্র, তার সামনের এবং পেছনের মানুষেরা সব পরিচয় ভুলে মানুষ থাকেন বলে এই ছবিটা মানুষের ছবি হয়ে ওঠে। ছবিতে দেখা দুজন মানুষের মনে জমে থাকা অপ্রকাশ্য বেদনা, হাহাকারের অনেকটা দর্শক নিজের মনে বয়ে বাড়িতে ফেরে।

চলচ্চিত্রের নাম হাসিনা। ‘কন্যাদের কাহিনি’ও নামটার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। একটা পরিবারের কেউ বেঁচে নেই, একরকম শোক আর মাত্র দুজন বেঁচে আছেন, তা আর এক মাত্রার শোক। সেই মাত্রাকেই চলচ্চিত্রে উপস্থাপনা করা হয়েছে। বেঁচে থাকা দুজন মানুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা। যে মানুষটা মানুষের স্বপ্ন একত্র করেছিলেন। যাঁর এক আঙুলের উত্থানে কোটি মানুষের প্রাণে সাহস উত্থিত হয়েছিল। মানুষেরা জীবন তুচ্ছজ্ঞান করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তির সংগ্রামে। মানুষ পেয়েছিল দেশ, পতাকা ও স্বাধীনতা। মানুষের অস্তিত্বে যুক্ত হয়েছিল নতুন গৌরব।

সেই গৌরবের ভূমিতেই ইতিহাস হয়ে ওঠা গৌরবোজ্জ্বল মানুষটাকে নিহত হতে হয়। রাজনীতি সে ঘটনাকে নানাভাবে বিবৃত করেছে। সে অধ্যায় নিয়ে ব্যাপক বিশ্লেষণ বহুকাল ধরে মানুষ করে যাবে। জাতি ও মানুষের স্বভাব তেমনই। মানুষের মূল হচ্ছে মনুষ্যত্ব, মানবিকতা। এই দুই দিয়ে বিচার–বিশ্লেষণের উদাহরণ জগতে কম। হাসিনা ডকুচিত্রজুড়ে দুই বোধের নিয়ন্ত্রিত ও পরিশীলিত প্রকাশ দেখতে পায় মানুষ। যা সত্য, এবং সত্যরূপেই উপস্থাপিত বলে দর্শক মেরুদণ্ডে হিমশীতল প্রবাহ অনুভব করে। মানুষের মধ্যে মানুষকে জাগিয়ে দেওয়ার চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে হাসিনা, কন্যাদের কাহিনি।

এ ছবির চিত্রগ্রহণ নিয়ে অনেকের অনেক রকম মতামত শুনলেও সময়কে বিশ্বস্তভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য আলো–আঁধারির ব্যবহার যথার্থই মনে হয়েছে। তা ছবির ভাব প্রকাশে বিশেষ ভূমিকা রাখে। সম্পাদনার কাজটা ছিল সবচেয়ে দুরূহ। ছবি দেখতে দেখতে কোথাও হোঁচট খেতে হয়নি। অনায়াসে ছবির সঙ্গে বয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে। এর কৃতিত্ব অবশ্যই কুশলী সম্পাদনার। এমন চলচ্চিত্রের জন্য চিত্রনাট্য প্রস্তুত সম্ভব নয়। ঘটনার বর্ণনা, কিছু বাস্তব মুহূর্ত, সময়কে চিত্রায়ণ—এই তিনের যোগে যা সৃষ্টি হয় আবহসংগীতে সবটুকুকে একাকার করে ফেলা, সেও সহজ নয়। মুহূর্তগুলোতে যেন প্রাণের সঞ্চার করেছে আবহসংগীত।

স্বাধীনতার ৪৭ বছরের মাথায় এমন একটা চলচ্চিত্রের খুবই প্রয়োজন ছিল। মানুষ স্বভাবে, বিশ্বাসে অনেক বদলে গেছে। সময়ের ঘাড়ে দোষ চাপাতে পারলেও মানুষকে বদলে দেওয়ার জন্য মানুষেরা কম দায়ী নয়। সংবেদনশীল মন নিয়ে জীবন দেখা, সত্যকে সম্মান ও স্বীকারের অনুশীলনের উৎসাহ কমেছে। ক্ষুদ্র স্বার্থ টিকিয়ে রাখতে বৃহৎ স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতে বুক কাঁপে না। এ রকম সময়কে ও সময়ের মানুষদের বুক কাঁপিয়ে দেওয়ার জন্য এমন একটা উদ্যোগ খুবই জরুরি ছিল। অন্তত জানা হয়, নতুন করে বিশ্বাস জন্মে, মানবিকতা ও সংবেদনশীলতায় জং ধরে যায়নি। সত্যে মানুষের বুক এখনো কাঁপে।

এই সামর্থ্য সৃজনশীলতার। রাজনীতি এদিকে তাকায় না, এ পথে পা বাড়ায় না। অথবা বলা যায়, রাজনীতি যেহেতু একরকমের দৃষ্টিভঙ্গি, তা সকল প্রকার মানুষের প্রাণে একই রকম অনুভূতির জন্ম দেয় না। সৃজনশীলতায় পক্ষপাত নেই, তা সব মানুষের। মানুষ তা নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী গ্রহণের ক্ষমতা রাখে। সত্যকে সত্যরূপে গ্রহণ ও আবেগাপ্লুত হওয়া এ রকম স্বাধীন প্রাণের পক্ষেই সম্ভব। রাজনীতি ও শিল্পচর্চা এক বিষয় নয়। একাকার হওয়ার বিষয়ও নয়। হাসিনা, কন্যাদের কাহিনি দেখে ফেরার পথে মনে হয়েছে এমন শিল্পকর্মের, সৃজনশীলতার জন্য সবাইকে রাজনীতি করতে হবে, রাজনীতিক হতে হবে—এমন কথা ঠিক নয়। এ ছবির পরিচালকের যদি রাজনৈতিক পরিচয়, দৃষ্টিভঙ্গি থাকত—এমন একটা মহৎ চলচ্চিত্রের জন্ম হতো না। আবার এ কথাও বেঠিক নয়, রাজনীতি যাঁরা করেন, এমন সৃজনশীল কর্মের পেছনে তাঁদের আগ্রহ, অনুপ্রেরণাও খুব জরুরি। সে বিষয়টা জরুরিভাবে অনুধাবন করতে পারার কারণে এমন একটা মুগ্ধ করা শিল্পকর্মের জন্ম হলো।

হাসিনা বিষয় ভিত্তিতে ডকুচিত্র। মানুষের মনে তা হৃদয়গ্রাহী এক চলচ্চিত্র হয়ে উঠেছে। শুধু চলচ্চিত্রের ভূমিকা ছাড়াও এমন সৃজনশীলতার আলাদা সামর্থ্য রয়েছে। সে সামর্থ্যের প্রকাশ অদৃশ্য থাকেনি। এক চোখে দেখার মনুষ্য স্বভাব খানিকটা হলেও বদলাবে। এ ছবি সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, একটা নয়, সবার চোখ দুটো করে। দুভাবে দেখাই প্রাকৃতিক। দেখা, শোনা ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে অনুভব করা। অনুভব করার সাধ্য থাকলেই কেবল মানুষ এ জগতের বিশেষ কেউ।

আফজাল হোসেন: অভিনেতা, চিত্রশিল্পী, লেখক ও নির্দেশক
afzalhossain 1515 @yahoo. com