সিইসির কথা ও কাজ

যখন দেশের বিভিন্ন স্থানে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপির প্রার্থীদের ওপর উপর্যুপরি হামলা চলছে, সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের আক্রমণে আহত হয়ে তাঁদের কেউ কেউ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, তখন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদার মুখে শোনা গেল, ‘নির্বাচনে ইতিমধ্যে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত হয়েছে, প্রার্থীরা ইচ্ছামাফিক প্রচার চালাতে পারছেন।’ তিনি যেদিন (শনিবার) আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন করে ইসির কৃতিত্বের বয়ান করছিলেন, সেদিনই বিরোধী দলের ১২ জন প্রার্থীর ওপর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া প্রার্থীর গাড়িবহরে হামলা, তাঁদের প্রচারে বাধা দেওয়ার ঘটনা প্রতিদিন ঘটে চলেছে। তাঁর এই উক্তি আক্রান্ত মানুষগুলোর প্রতি মশকরা ছাড়া কিছু নয়।

পত্রিকার খবর থেকে আরও জানা যায়, বিরোধী দলের প্রার্থীরা শুধু সরকারি দলের হাতেই লাঞ্ছিত ও নিগৃহীত হচ্ছেন না; আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও তাঁদের প্রতি চরম বৈষম্যমূলক আচরণ করছে। কুমিল্লার একটি আসনের প্রার্থীসহ স্থানীয় তিন শীর্ষ নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে নাশকতার মামলায়। এ অবস্থায় সেখানে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর পক্ষে প্রচারকাজ চালানো অসম্ভব। ঢাকা-১৬ আসনে বিএনপির প্রার্থী আহসানউল্লাহর স্ত্রী রিনা হাসান নারী কর্মীদের নিয়ে প্রচারে বের হলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা তাঁদের বাধা দেন। তিনি বাড়ি ফিরে আসেন। এরপর পুলিশ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে তাঁকেই বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। তাদের দাবি, তাঁর বিরুদ্ধে মামলা আছে। নির্বাচন সামনে রেখে এ ধরনের শত শত মামলার দোহাই দিয়ে বিরোধী দলের প্রার্থী ও নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। অথচ সিইসি ও তাঁর সহযোগীদের মুখে শুনছি, ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত হয়েছে।’ এসবই কি তঁাদের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের নমুনা?

তফসিল ঘোষণার পর সিইসি বলেছিলেন, এখন থেকে জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্বাচন কমিশনের নির্দেশমতো কাজ করছে। সে ক্ষেত্রে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর এই যে দমন–পীড়ন ও হামলা চলছে, তার দায়ও তাঁকে এবং কমিশনকে নিতে হবে। নাশকতার মামলাগুলোর চালচিত্র সিইসির জানা না থাকলেও দেশবাসীর জানা আছে। কোথাও কোনো ঘটনা ঘটলে পুলিশ কিছু লোকের নাম উল্লেখ করার পাশাপাশি অন্যদের অজ্ঞাতনামা আসামি হিসেবে মামলা করে। এরপর সেই অজ্ঞাত নামের স্থলে যার খুশি তার নাম বসিয়ে দেয়। বিরোধী দলের অনেক প্রার্থী ও নেতা-কর্মীদের এভাবেই হয়রানি করা হচ্ছে।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দল অংশ নেওয়ায় জনমনে নির্বাচন নিয়ে যে আশাবাদ তৈরি হয়েছিল, তা পর্যায়ক্রমে ক্ষীণ হতে শুরু করেছে। সরকারি দলের লোকজন নির্বাচনী প্রচার শুরু করলেও বিরোধী পক্ষ অনেক ক্ষেত্রে মাঠেই নামতে পারছে না। একে আর যা–ই হোক স্বাভাবিক নির্বাচনপূর্ব পরিস্থিতি বলা যায় না। সরকারি দল আচরণবিধি লঙ্ঘন করে চললেও ইসি কিছু বলছে না।

আচরণবিধি লঙ্ঘনের ব্যাপারে সিইসি ১২২টি নির্বাচনী তদন্ত কমিটি গঠন করার কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সেসব কমিটি কাজ করছে কি না, করলেও কীভাবে করছে, সেই হিসাব কি তঁারা নিয়েছেন? যেখানে সিইসির বক্তব্যে আমরা আচরণবিধি ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি আশা করেছিলাম, সেখানে তাঁর বক্তব্যে অপরাধীরা আশকারা পেয়ে যাবে। এভাবে চলতে থাকলে সুষ্ঠু নির্বাচনের সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। সিইসি ও নির্বাচন কমিশনকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে বাস্তবতা কী তা সবাই দেখতে পাচ্ছে, সত্য আড়াল করার চেষ্টা কোনো ফল দেবে না। নির্বাচনের মাত্র ১৩ দিন বাকি আছে। এখনই বিরোধী দলের ওপর হামলা, মামলা ও প্রচারকাজে বাধা দেওয়ার ঘটনাগুলো কঠোর হাতে বন্ধ করুন।

কিছু লজ্জা আছে, যা তৈরি হয় হাতে গোনা কিছু ব্যক্তির নির্লজ্জ লালসার কারণে, কিন্তু মাথা হেঁট হয় গোটা জাতির। অবশ্য জাতির মাথা হেঁট হওয়া নিয়ে তাদের আদৌ মাথাব্যথা আছে কি না, তা অবশ্য এক বড় প্রশ্ন। ক্ষমতা ও অর্থ লোপাটের লোভ তাঁদের লজ্জাবোধের ওপর নির্লজ্জতার পর্দা টেনে দিয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মতো পবিত্র বিষয়ও সেই পর্দাকে ছিন্ন করতে পারছে না।

মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা বন্ধুপ্রতিম বিদেশি ব্যক্তিত্ব ও সংগঠনকে দেওয়া সম্মাননার ক্রেস্ট জালিয়াতি নিয়ে কম জল ঘোলা হয়নি। সম্মাননা পদকের সোনার ১৬ আনার ১২ আনাই ফাঁকি ছিল। এই ফাঁকির মধ্য দিয়ে প্রায় ৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা লুটপাট হয়েছে। যথারীতি তদন্ত কমিটি হয়েছে। তদন্ত হয়েছে। তদন্ত করতে গিয়ে আরও কিছু টাকাপয়সা খরচ হয়েছে। শেষমেশ কাউকে কোনো দণ্ড ভোগ করতে হয়নি।

অন্যায়ের প্রতিকার না করলে তার পুনরাবৃত্তি যে অনিবার্য তা অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি নির্মাণে দুর্নীতির খবরে আবার প্রমাণিত হলো। খবরে
জানা যাচ্ছে, অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের একটি করে একতলা পাকা ভবন বানিয়ে দেওয়ার কাজ চলছে। এর সঙ্গে গরু, হাঁস, মুরগি পালনের জন্য পৃথক শেড থাকছে। সেই সঙ্গে থাকছে একটি করে নলকূপ। এই বাড়ির নাম দেওয়া হয়েছে ‘বীর নিবাস’।

দেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলায় এ রকম ২ হাজার ৯৭১টি ‘বীর নিবাস’ বানিয়ে দেওয়ার কথা। ৮৫৫টি ইউনিটের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। ১ হাজার ৭৪টি ইউনিটের কাজ চলছে। এ ছাড়া ২৭৩টির দরপত্র প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। একেকটি ভবন নির্মাণে খরচ হয়েছে আট থেকে দশ লাখ টাকা।

এত টাকা খরচ করে যে ‘বীর নিবাসগুলো’ ইতিমধ্যেই বানিয়ে দেওয়া হয়েছে, বছর না পেরোতেই তার নানা স্থানে ফাটল ধরেছে। যাঁরা বীর নিবাসে উঠেছিলেন, তাঁরা এখন ছাদ ধসে মারা পড়ার আতঙ্কে আছেন। অনেক ভবনেই পলেস্তারা খসে পড়েছে।

নিম্নমানের কাঠ ব্যবহার করায় জানালা খুলে পড়ছে। অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা ক্রেস্টের সোনার বদলে যেভাবে তামা–দস্তা চালিয়ে দেওয়া হয়েছিল, একইভাবে এখানেও ইট–বালু–সিমেন্টের সঙ্গে ভেজাল নির্মাণসামগ্রী দেওয়া হয়েছে। আরও ভয়ানক কথা হলো অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যাঁদের বাড়ি করে দেওয়া হয়েছে, তাঁদের মধ্যে একটি বড় অংশ মোটেও অসচ্ছল নয়। প্রভাব খাটিয়ে নিজের বাড়িতে সরকারি টাকায় এই ভবন বানিয়ে তাঁরা ভাড়া দিয়েছেন।

সাধারণ অবকাঠামো এবং রাস্তাঘাট নির্মাণে ঠিকাদার ও প্রকৌশলীর যোগসাজশে দুর্নীতি হয়। জাতি এটিকে দুর্ভাগ্য হিসেবে প্রায় মেনেই নিয়েছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ গোটা দেশবাসীর আবেগের জায়গা। তঁাদের নামে বরাদ্দ করা ভবন নির্মাণেও যদি এভাবে দুর্নীতি হয়, তবে আমাদের আর থাকে কী!