আসছে অশনিসংকেত?

ভালো-মন্দে ২০১৮ সাল তো প্রায় চলেই গেল। কিন্তু ২০১৯ সালে কী হবে?

বিশ্বের হালচাল যা যাচ্ছে, তাতে নতুন বছর নিয়ে খুব একটা আশার কথা বলার উপায় নেই। আগামী বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অস্থিরতা, উগ্রতা, বিভেদ, সংঘাত বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। নতুন বছরে বৈশ্বিক গণতন্ত্রকে কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়তে হতে পারে।

বিশ্ব মাতবর খ্যাত যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যেই পরীক্ষার মধ্যে পড়ে গেছে। তারা অন্যকে নিয়ে মাথা ঘামাবে কী, এখন নিজেদের চিন্তাতেই অস্থির। ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ উঠতে-বসতে হোঁচট খাচ্ছে। তাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা আগের মতো নেই। বাইরের লোক আর কী বলবে, খোদ মার্কিনরা বলছে, তাদের দেশে গণতন্ত্র সংকটে আছে। ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে গোল্লায় তো পাঠাচ্ছেনই, নিজেও একই পথের পথিক হওয়ার সব আয়োজন সেরে রেখেছেন। নিজের পাতা ফাঁদে ট্রাম্প যেভাবে একের পর এক ফেঁসে যাচ্ছেন, তাতে আগামী বছর তাঁর অভিশংসনের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। চতুর ট্রাম্প অবশ্য আগেই হুমকি দিয়ে রেখেছেন, তাঁর সঙ্গে অমন কিছু হলে জনগণই বিদ্রোহ করবে। ট্রাম্প ক্ষমতায় থাকুন কিংবা অভিশংসিত হোন, যুক্তরাষ্ট্রের কপালে ভালো কিছু নেই। রাজনীতি, অর্থনীতিসহ পুরো বিশ্বব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবের কথা অস্বীকার করা যায় না। তাই যুক্তরাষ্ট্রে অস্থিরতা বাড়লে তার ঝাপটা বিশ্বের অন্য জায়গাতেও পড়বে।

যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র যুক্তরাজ্য অনেক দিন ধরেই খাবি খাচ্ছে। তার গলার কাঁটা ‘ব্রেক্সিট’। না পারছে গিলতে, না পারছে ছাড়াতে। এক ব্রেক্সিটের চক্করে যুক্তরাজ্যে কত যে ওলট-পালট হয়ে গেল, তার ইয়ত্তা নেই। দেশটি যে সামগ্রিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ব্রেক্সিটের ধাক্কায় এক প্রধানমন্ত্রী (ডেভিড ক্যামেরন) আগেই বিদায় নিয়েছেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মের অবস্থাও নড়বড়ে। সম্প্রতি তিনি আস্থা ভোটে টিকে গেলেও তাঁর বিপদ মোটেও কাটেনি। আসল বিপদ সামনে। ব্রেক্সিট নিয়ে দেশটিতে আগামী বছর কী হয়, তা অনুমান করা কঠিন। তবে এ কথা বলা যায়, সম্পাদিত ব্রেক্সিট চুক্তি দেশটির পার্লামেন্টে পাস করানো হবে থেরেসা মের জন্য এক অগ্নিপরীক্ষা। এই পরীক্ষায় ফেল করলে তাঁর শেষ রক্ষা তো হবেই না, উপরন্তু পুরো দেশ গভীর সংকটে পড়বে।

জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে গত নভেম্বরে ফ্রান্সে শুরু হওয়া ছোটখাটো আন্দোলন মুহূর্তের মধ্যে ব্যাপক রূপ ধারণ করে। প্যারিসের রাস্তার আগুন একপর্যায়ে এলসি প্রাসাদ পর্যন্ত যাওয়ার উপক্রম হয়। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ থেকে সৃষ্ট আন্দোলন সরকার হটানোর দাবিতে এসে ঠেকে। অবস্থা বেগতিক দেখে নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হন প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ। আগের অবস্থান থেকে সরকার সরে আসে। আন্দোলন থামাতে ন্যূনতম মজুরি, কর মওকুফসহ বেশ কিছু পদক্ষেপের ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু তারপরও আন্দোলন স্তিমিত হয়নি। সরকারবিরোধী এই গণ-আন্দোলনের উত্তাপ আগামী বছর বাড়বে বই কমবে না। মাখোঁর সামনে দুর্দিনই বটে।

চলতি বছর জার্মানি, হাঙ্গেরিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বর্ণবাদী, উগ্র জাতীয়তাবাদী, কট্টর ডানপন্থীদের উত্থান লক্ষ করা গেছে। আগামী বছর এই ধারা জোরদার হতে পারে। তেমনটা ঘটলে গণতন্ত্র, উদারবাদ, বহুত্ববাদ আরও চাপের মধ্যে পড়বে।

কর্তৃত্ববাদ ক্রমেই বিশ্বকে আঁকড়ে ধরছে। রাশিয়া, চীন, তুরস্ক, সিরিয়া, মিসর, ফিলিপাইন এখন এক নেতার দেশ। দুঃখজনক হলেও সত্য, এই দেশগুলোর নেতারা অনেকের কাছেই অনুসরণীয় হয়ে উঠছেন। এমনকি নির্বাচিত শাসকেরাও কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠছেন। আগামী বছর এই প্রবণতায় ভাটা পড়ার কোনো লক্ষণ আপাতত দেখা যাচ্ছে না। বরং বিশ্বকে আরও কর্তৃত্ববাদী শাসক দেখার প্রস্তুতি নিতে হতে পারে।

শ্রীলঙ্কায় রনিল বিক্রমাসিংহে আবার প্রধানমন্ত্রী পদে ফিরেছেন। সবশেষ এই ঘটনাপ্রবাহে মনে হতে পারে, দেশটির রাজনৈতিক সংকট বুঝি কেটে গেছে। কিন্তু খেলা আরও বাকি আছে। ফলে আগামী বছর দেশটিতে সংকট আরও ঘনীভূত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

ভারতে আগামী বছর জাতীয় নির্বাচন। বিজেপি ফের ক্ষমতায় এলে দেশটিতে হিন্দুত্ববাদ বিস্তারের ষোলোকলা তারা পূর্ণ করে ছাড়বে। ধর্মনিরপেক্ষতার শেষ অস্তিত্বটুকু ঢাকা পড়বে গেরুয়া রঙে। দেশজুড়ে উগ্র জাতীয়তাবাদের দামামা বাজবে। হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানিতে অস্থি হবে পুরো দেশ।

সম্প্রতি ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ২০১৯-২৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি পূর্বাভাস দিয়েছে। এতে জাতীয় নির্বাচনের পর বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।

২০১৯ সালে বিশ্বের স্থিতিশীলতার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হতে পারে সাইবার যুদ্ধ। এই যুদ্ধে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল, সরকার ও রাষ্ট্র লক্ষ্যবস্তু হবে। গণতন্ত্রের জন্য এক ভয়ংকর শত্রু হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে যোগাযোগের সামাজিক মাধ্যম।

সাইফুল সামিন: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
[email protected]