প্রশাসনের ওপর নিয়ন্ত্রণ দৃশ্যমান নয়

প্রথম আলোয় খবর এসেছে ‘সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে নিয়ন্ত্রণ চায় প্রশাসন’। খবরে বলা হয়, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে নির্বাচন কমিশনে ডাকা আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত উচ্চপর্যায়ের এক সভায় কিছু বিধিনিষেধ প্রস্তাব এসেছে। প্রস্তাবে রয়েছে, ভোটকেন্দ্র থেকে সরাসরি সম্প্রচার ও ফেসবুক নিয়ন্ত্রণ। ইন্টারনেটের গতি কমানো, মোবাইল ব্যাংকিং বন্ধ রাখা ইত্যাদি। সভায় সিইসিসহ সব নির্বাচন কমিশনার ছাড়াও সংশ্লিষ্ট সচিব, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর প্রধান, সশস্ত্র বাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার এবং রিটার্নিং কর্মকর্তা আর পুলিশ সুপাররা উপস্থিত ছিলেন। খবরটিতে জানা গেছে, কমিশন এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।

তবে বিভিন্ন সূত্রের মতে, ভোটকেন্দ্র থেকেই সরাসরি সম্প্রচার না করতে নির্দেশনা দেওয়া হতে পারে। ৭২ ঘণ্টার জন্য কমিয়ে দেওয়া হতে পারে ইন্টারনেটের গতি। উল্লেখ্য, এ গতিতে ফেসবুক চলবে না। সভায় একজন নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, সাংবাদিকদের ভোটকেন্দ্রে প্রবেশে বাধা দেওয়া হবে না। তবে টিভি চ্যানেলগুলো যাতে ভোটকেন্দ্রের ভেতর থেকে সরাসরি সম্প্রচার না করে, সেদিকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। মনে হচ্ছে এ ধরনের সিদ্ধান্ত হয়েই আছে। প্রশ্ন থাকবে, এরূপ নিয়ন্ত্রণ আরোপের আবশ্যকতা কতটুকু?

নির্বাচনের সময় শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। এটা ঠিক, কোথাও গুজব সৃষ্টি করে ক্ষতিকারক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়। আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ক্ষেত্রবিশেষে এ গুজব সৃষ্টির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তিকে যখন আমরা একের পর এক আঁকড়ে ধরছি, তখন ক্ষেত্রবিশেষে আবার পিছু হটা কেন? ইভিএমে ভোট নেওয়া নিয়ে সমাজের একটি অংশের আপত্তি থাকলেও কমিশন পরীক্ষামূলকভাবে ৬টি নির্বাচনী এলাকায় এর মাধ্যমে ভোট নেবে। এতে খারাপ কিছু দেখছি না।

আলোচনা করতে হয় প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে। বলা হচ্ছে, সাংবাদিকেরা ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করে মোবাইল ফোনে ছবি তুলতে পারবেন। তবে টিভি ক্যামেরা থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা যাবে না। এত দিন টিভি ক্যামেরায় ছবি তোলা হতো। সাক্ষাৎকার নেওয়া হতো প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ও কিছু ভোটারেরও। অবশ্য ক্ষেত্রবিশেষে ভোটকেন্দ্রে বেআইনিভাবে ব্যালটে সিল মারার কিছু ছবিও তাৎক্ষণিক গণমাধ্যমে এসেছে। নিয়ন্ত্রণ করা হলে তা আসবে না। ভোটকেন্দ্রে যদি সুষ্ঠু ভোট হয়, সে ক্ষেত্রে গোপনীয় কক্ষ ব্যতীত অন্যত্র সাংবাদিকদের চলাচল এবং মোবাইল কিংবা টিভি ক্যামেরায় ছবি তোলায় কী ক্ষতি হবে, তা বোধগম্য হচ্ছে না। আর কোথাও যদি অনিয়ম হয়, সে সচিত্র বিবরণও গণমাধ্যমে পাঠানো সংবাদকর্মীদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। জানার অধিকার রয়েছে জনগণেরও।

এমনকি নির্বাচন কমিশন যদি কোনো রাখঢাক করতে না চায়, তবে এ ধরনের অনিয়মের সংবাদে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে পারবে। শুধু তা-ই নয়, দেখা গেছে, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করলে গুজব ডালপালা মেলে। একটি সত্যির সঙ্গে শত অসত্য যুক্ত হয়ে আরও ক্ষতির কারণ ঘটাতে পারে। হতে পারে একাধিক ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের উপস্থিতি ক্ষেত্রবিশেষে ভোট গ্রহণ কার্যক্রম কিছুটা ব্যাহত করে। সে ক্ষেত্রে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা তাঁর ক্ষমতা প্রয়োগ করে তাঁদের সংখ্যা ও সময় নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। আর বাস্তব অবস্থা হলো ৪০ হাজার ২০০ ভোটকেন্দ্রের এক-চতুর্থাংশও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার আওতায় আসবে বলে মনে হয় না। এত ভোটকেন্দ্রের তুলনায় ক্যামেরার সংখ্যা খুবই অপ্রতুল। তদুপরি যোগাযোগব্যবস্থার জটিলতার বিষয়টিও রয়েছে। সুতরাং এই প্রস্তাবিত বিধিনিষেধ নির্বাচনব্যবস্থাটিকে আরও প্রশ্নবিদ্ধ করবে।

উল্লেখ করা যায়, পক্ষগুলোর জন্য নির্বাচনের মাঠ মোটেই সমতল হয়নি। তার মধ্যেও সব দল ও জোট নির্বাচনে আছে—এটা ভালো লক্ষণ। তবে শুরু থেকেই বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের প্রচারণার সুযোগ থেকে বিরত রাখার নানামুখী প্রচেষ্টা চলছে। এতে সরকার-সমর্থক কর্মী থেকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন সংশ্লিষ্ট বলে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় খবর আসছে। সংঘাত-সহিংসতায় প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। বিভিন্ন স্থানে প্রার্থীদের ওপর হামলা ঘটনা ঘটে চলেছে। এ অবস্থায় দলমত-নির্বিশেষে দায়ী প্রকৃত দাঙ্গাবাজদের গ্রেপ্তার করা উচিত। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই গোটা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো কমিশনের আওতায় কাজ করছে বলেও গণ্য হবে। বিরোধী দলের একজন নেতা আক্রান্ত হওয়ার পর সিইসি বিব্রতও হয়েছেন। আমরা তাঁর সৌজন্যের প্রশংসা করি। কিন্তু তিনি তাঁর কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করছেন কি না, এ নিয়েও সংশয়ে রয়েছি। কারণ, এরপরও হামলার ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতা ড. কামাল হোসেনের গাড়িবহরে হামলা হয়েছে। সিইসির খোঁজ নেওয়া উচিত ছিল এ হামলার ক্ষেত্রে কী ব্যবস্থা নিয়েছে প্রশাসন। কিছু না নিয়ে থাকলে দায়িত্ব নির্ধারণ করাও সংগত ছিল। তদুপরি প্রয়োজন ছিল দ্রুত দৃশ্যমান ব্যবস্থা নিতে ঊর্ধ্বতন মহলকে সময়াবদ্ধ নির্দেশ দেওয়ার। নির্বাচন খুব দ্রুত ঘনিয়ে আসছে। এ ধরনের হামলা অব্যাহত থাকলে ভোটের দিন বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা খুব একটা বের হতে সাহস করবেন না। নির্বাচনে জয়লাভের জন্য সরকারি দলের নিশ্চয়ই একটি কর্মকৌশল আছে। আর তা থাকাই সংগত। অবশ্য এ হামলাগুলো যদি সেই কৌশলের অংশ হয়, তবে নির্বাচনটি নিয়ে আশাবাদ ক্রমান্বয়ে ফিকে হয়ে যাবে।

এ ক্ষেত্রে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর কমিশন তেমন কোনো নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পেরেছে—এমনটা মনে হয় না। এই প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তার অদূরদর্শী পরামর্শে যদি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়, তাহলে সরকারি দলের সেই কর্মকৌশলে কমিশনও অংশীদার বলে জনগণ বিবেচনা করতে পারে। আমরা চাই না, এমনটা হোক।

কমিশনকে নিয়ে শুরু থেকেই সমালোচনা অনেক হয়েছে। এর কিছু যৌক্তিকতাও ছিল। তবে এবারে মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের পর আপিল পর্যায়ে তারা যথেষ্ট ধীশক্তি ও বিবেচনাবোধের পরিচয় দিয়েছে। প্রশংসিতও হয়েছে। তবে শেষ ভালো যার সব ভালো তার। ভোটের দিনে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার পরিবেশ দিনে দিনে হালকা হয়ে আসছে। বিরোধী দলের প্রচারকাজে বাধা দেওয়ায় তাঁদের নেতা-কর্মী এমনকি প্রার্থীদেরও কারণে-অকারণে হয়রানি, গ্রেপ্তার ও ভীতি প্রদর্শন নির্বাচনটিকে শেষতক প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ না-ও রাখতে পারে। সেটা প্রশ্নবিদ্ধই থাকবে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি অংশের সরাসরি সরকারি দলের পক্ষ নিয়ে কাজ করার অভিযোগ রয়েছে। শুরু থেকে তারা কমিশনের রক্তচক্ষু দেখলে ব্যাপারটা এ পর্যায়ে আসত না।

উচ্চপর্যায়ের বিশেষ আইনশৃঙ্খলা সভায় সিইসি নির্বাচনকালে ২০১৪ সালের মতো সহিংসতা যাতে না হতে পারে, তার দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন। এটা যথার্থ। সহিংসতা কোনো পর্যায়েই গ্রহণযোগ্য নয়। আর সূচনাতেই এর শিকড় উপড়ে ফেলতে হয়। তবে তাঁরা সেটি করছেন না বা সক্ষম হচ্ছেন না করতে। তাহলে ধীরে ধীরে এটা বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কাই থাকে। আর ভোটের দিনে কেন্দ্র দখল, ব্যালট পেপারে অবৈধভাবে সিল মারা, বিরোধী দলকে এলাকাছাড়া করা—এগুলো তো ক্ষোভকে উসকে দেবে।

সুতরাং এ খেলায় ‘ফেয়ার আম্পায়ারিং’ করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনারের। আর এ ধরনের কাজে বাইরে থেকে প্রভূত সহায়তা করতে পারেন গণমাধ্যমকর্মীরা। তাঁরা সবাই সাধু-সজ্জন, এমনটা নয়। তবে পেশাগত চাপে খুব একটা বিভ্রান্তিকর খবর দেওয়ার সুযোগ তাঁদের কম। আর তা যদি করেনও, সে ক্ষেত্রে আইনের আওতায়ও নেওয়া যাবে। তাঁদের দ্রুতলয়ে পাঠানো খবরগুলো নির্বাচন সামাল দেওয়ার জন্য কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হতে পারে। তাঁদের আরও সক্রিয় না করে চলমান ব্যবস্থায় প্রাপ্ত সুযোগ কাটছাঁট করলে ক্ষতি তাঁদের কতটুকু হবে, জানি না। তবে স্বচ্ছতার আবরণ ঢেকে ফেলার জন্য দায়ী হবে কমিশন। আর এ অবস্থার সুযোগ নিয়ে ভোট প্রদান পর্বকে কলুষিত করার দায়ও যাবে তাদের ওপরেই।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
[email protected]