দলান্ধ সাইক্লোপসের মৌসুম

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘দেশ আজ দুই ভাগে বিভক্ত।’ কথাটা সত্য, কিন্তু এই বাস্তবতা স্বাস্থ্যকর নয়। স্বাস্থ্যকর নয়, কারণ বৈচিত্র্যই সুন্দর। দল বলেছে, ‘নিজের শ্রবণ ও দৃষ্টিকে অস্বীকার কর, মানো শুধু দলীয় বয়ান। আর এটিই হচ্ছে দলের পক্ষ থেকে চূড়ান্ত ও একমাত্র আদেশ।’ ‘স্ট্রংম্যান’ শাসনের বিচারে অতি দরকারি এই আদেশ ও তার অবধারিত ফলাফলের কথা অনেক আগেই বলে গিয়েছেন জর্জ অরওয়েল তাঁর ‘১৯৮৪’ উপন্যাসে।

যত দিন যাচ্ছে, জর্জ অরওয়েল ততই সমসাময়িক হয়ে উঠছেন। কি দেশ, কি বিশ্ব, সবখানেই যেন সেই ‘১৯৮৪’ উপন্যাসের বাস্তবতা। অরওয়েল একটি কর্তৃত্ববাদী সরকারব্যবস্থার শুলুক–সন্ধান করতে গিয়ে সরাসরি জানিয়ে দেন, এমন একটি সরকারব্যবস্থার মূল ঘাঁটিটি থাকে জনসাধারণের মগজে। সেখানেই তার প্রচার ও প্রসার। এই মগজেই সরকারি নজরদারি, পুলিশ ইত্যাদি নানা ব্যবস্থা প্রকৃত শক্তির চেয়েও অনেক বেশি শক্তিধারীর আবহ তৈরি করে তাকে নিষ্ক্রিয় করে রাখে। কারণ, নাগরিকদের কাছে দলের চাওয়াই হচ্ছে সে যেন নিজের দৃষ্টিভঙ্গি, বিচার-বিশ্লেষণ ইত্যাদি দলীয় ব্যবস্থাপত্র মেনেই করে। এ ক্ষেত্রে এমনকি ব্যক্তির স্মৃতিকেও মুছে দিতে চায় সে। যেন এক জাদুর ইরেজার। করপোরেট পুঁজির এ যুগে এই জাদুর ইরেজারটি অনেক শক্তিশালী হয়েছে। খুব সহজেই রাষ্ট্র এবং তার মসনদের দাবিদার পক্ষগুলো মানুষের মগজে তার বিস্তার ঘটাচ্ছে। লোপ করে দিতে পারছে নিজস্ব বিচার-বিবেচনা। নির্বাচনী ডামাডোলের মধ্যে বাংলাদেশে এই বাস্তবতা খুব দারুণভাবে নজরে পড়ছে। নিজের চারপাশের ঘটনাগুলোকে এড়িয়ে যে যার কুয়োয় বসে বলে দিচ্ছে জগতের মাপজোখ। অনেকটা গ্রিক পুরাণের সাইক্লোপসের মতো।

গ্রিক পুরাণের সাইক্লোপসরা ছিল একচোখা দৈত্য এবং ভীষণ শক্তিশালী। প্রচণ্ড অসামাজিক ও রাগী এ দৈত্যের স্বভাবও ছিল তার শারীরিক গড়নের মতোই। নিজের বলয়েই থাকত সে। এর বাইরে সবকিছুর সঙ্গেই তার বিবাদ। তাদের বসবাস নিজস্ব গুহায়। সেখানে আগন্তুকের প্রবেশ বারণ। এই হলো সাইক্লোপস, যার দক্ষতা শুধু প্রকৌশল ও যুদ্ধে। পৌরাণিক দুনিয়া ইঙ্গিতে কথা বলে। সাইক্লোপসও একটি ইঙ্গিত, যা তাকাতে বলে সেই সব মানুষের দিকে, যারা অন্য সব কিছুকে খারিজ করে দিয়ে শুধু নিজের ধারণার জগতেই বাস করে। আর প্রকৌশল ও যুদ্ধের দক্ষতা দিয়ে সেই নিজস্ব একমুখী জগৎকে একই সঙ্গে বিস্তৃত ও রক্ষা করে অন্য জগৎ ও ধারণাগুলোকে প্রতিনিয়ত আক্রমণের মাধ্যমে। কোনো ব্যক্তি যদি এই সাইক্লোপসের ধারায় চলে, তবে তাকে এড়িয়ে চলা সম্ভব, এমনকি তাকে সংশোধন করার চেষ্টাও নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু যখন সমাজটাই সাইক্লোপসের পথে হাঁটা শুরু করে, তখনই দেখা দেয় সত্যিকারের বিপত্তি। বাংলাদেশ ও গোটা বিশ্ব সম্ভবত এখন এমন এক বিপদের সামনেই রয়েছে, যেখানে সাদা ও কালোয় বিভাজিত হয়ে যাচ্ছে পৃথিবী, কোনো ধূসর অঞ্চল ছাড়াই। ‘হয় পক্ষে আছো, নয়তো অবধারিতভাবে শত্রুপক্ষে’—এই যুদ্ধংদেহী মনোভাবই যেন এখন নিরঙ্কুশ।

পুঁজি মাত্রই মুনাফা খোঁজে। তার নজর থাকে বাজারে, চায় নিজের পণ্যটিই রাজত্ব করুক। তাই হটাতে চায় অন্য সব পুঁজিকে। ছোট ছোট পুঁজিকে গিলে নিজের উদরপূর্তি করে আকারে-প্রকারে, প্রভাবে ও বলয়ে বিস্তৃত হতে চায় সে। এ জন্য যেকোনো কিছু করতে প্রস্তুত সে। এই প্রস্তুতিই তাকে এবং তার আশপাশের সবকিছুকে নিয়ে যায় সেই সাইক্লোপস বাস্তবতার দিকে। তার উৎপাদন, নির্মাণ, প্রচার ও বণ্টন—সবকিছুতেই থাকে এই একমুখী বাস্তবতা। পুঁজিতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও এর সংশ্লিষ্ট কাঠামোর পক্ষে তাই এই একমুখিতা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ফলে রাষ্ট্র ও এর ক্ষমতার প্রতিটি প্রতিযোগী পক্ষ প্রতিনিয়ত নির্মাণ করে চলে একমুখী বয়ান। এটা এতটাই প্রভাব রাখে যে পক্ষগুলোর অনুসারীদের পক্ষে আর নিজস্ব বিবেচনাবোধ কাজে লাগানো সম্ভব হয় না।

একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। গত নভেম্বরে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ১৩টি সরকারি সংস্থা নতুন করে সতর্কতা জারি করলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেকে ‘উচ্চপর্যায়ের বুদ্ধিমান’ দাবি করে এই সতর্কতাকে খারিজ করে দেন। বরাবরের মতোই তিনি বলেন, বিজ্ঞানীরা যে জলবায়ু পরিবর্তনের কথা বলছেন, তা একটি ‘গুজব’। এই পরিপ্রেক্ষিতে পিউ রিসার্চ সেন্টারের একটি জরিপ চালায়, যেখানে দেখা যায় হাজারো বৈজ্ঞানিক গবেষণা নিবন্ধ ও নানা প্রমাণ সত্ত্বেও রিপাবলিকান দলে ৮৫ শতাংশ সমর্থকই মনে করে, ‘প্রেসিডেন্ট ঠিক বলছেন’। এই একই পরিস্থিতি বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করেছে রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র ঘিরে সুন্দরবনের বাঁচামরার প্রশ্নে। শুধু বড় বিষয়গুলোই নয়, প্রতিটি ছোট ছোট বিষয়েই এই বিভাজনের দেখা মেলে। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের বহু দেশে। এর অর্থ হচ্ছে, কুয়োয় ঢুকতে তৎপর মানুষের সংখ্যাই বেশি। তার মানে এই নয় যে এর বাইরে কেউ নেই। আছে, কিন্তু ক্ষমতায় ও প্রভাবে ততটা নয়, যতটা কুয়োর পক্ষগুলো ধারণ করে। কুয়োর বাইরে থাকা ব্যক্তিদের প্রভাবশালী হওয়াটাও কষ্টকর। কারণ প্রথমত, সবার জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে ওঠা এই মানুষদের বিপরীতে গোটা রাষ্ট্রই তার সমস্ত শক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। দ্বিতীয়ত, এই অংশ খোলা আলাপে অভ্যস্ত। নিজে যেমন কুয়োয় থাকে না, সে অন্যকেও কুয়োয় টানে না। আর এই বিবেচনাবোধসম্পন্ন অংশটির খর্বশক্তির কার্যকারণের পথ ধরেই এগোয় নানা ধারার দলগিরি, যার রয়েছে প্রতিটি বিষয়েই ‘প্রকল্পিত সত্যের’ ট্যাবলেট।

এর মানে কি এই যে অধিকাংশ মানুষের যুক্তি ও বিবেচনাবোধ কম? না, তা নয়। অধিকাংশ মানুষই একটি নির্বিরোধ জীবন কাটিয়ে দিতে ইচ্ছুক। তারা চায় সুখ না হোক, স্বস্তি যেন থাকে। ফলে, সে বেছে বেছে এমন যুক্তি ও বিবৃতিকেই গ্রহণ করে, যা তার ধারণাকে পোক্ত করে। নিজের ধারণাকে ভেঙে যেতে দেখাটা তার কাছে অস্বস্তিকরই নয় শুধু শঙ্কারও। এই প্রবণতা এমন এক ধাপে উন্নীত হয়, যখন দেখা যায় প্রতিটি পক্ষ নিজের অংশটিই শুধু বলছে, বিপরীতের কিছু শুনছেও না। এমনকি খণ্ডনের তাগিদ থেকেও সে প্রতিপক্ষের যুক্তি শুনতে নারাজ। এটিই নিয়ে আসে সেই অরওয়েলীয় বাস্তবতাকে, যেখানে দর্পণ ও আমি ছাড়া আর কিছু শুধু অবান্তরই নয় প্রতিপক্ষও, যা পরিণত হয় সাইক্লোপস তৈরির কারখানায়। এই সাইক্লোপসদের কাজ হচ্ছে দলীয় বিবৃতিকে অকাট্য মেনে প্রতিপক্ষের ওপর হামলে পড়া।

নির্বাচনী প্রচার শুরুর পর থেকে প্রতিদিন এক পক্ষের ওপর অন্য পক্ষের হামলার যে খবর আসছে, তা এই সাইক্লোপসদের কথাই মনে করিয়ে দেয়, যারা নিজের বৃত্তের বাইরে আর কাউকেই সহ্য করতে পারে না। মাঠে যেমন, অনলাইনেও তেমনি ‘যুদ্ধ’ চলছে, যেখানে একের অপকর্মের প্রত্যুত্তরে অন্যের অপকর্মের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অর্জন দিয়ে অর্জনের মোকাবিলা নয়, ব্যর্থতা দিয়ে ব্যর্থতার মোকাবিলা করা হচ্ছে, যা আরও বড় ব্যর্থতার বৃত্তের দিকে দেশকে ঠেলে দেওয়ার আশঙ্কা তৈরি করছে। বিশালদেহী এই সাইক্লোপসদের যুদ্ধের হুজ্জতে আড়ালে পড়ে যাচ্ছে, সেই মানুষদের লড়াই, যারা এমন অন্ধত্বকে অস্বীকার করে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য এই তথাকথিত মুক্তদের দায়টিও কম নয়। কারণ, প্রশ্নের সংস্কৃতিটি তারা পুষ্ট করতে ও ছড়িয়ে দিতে পারেনি। কারণ, একমাত্র প্রশ্নের সংস্কৃতিই পারে একচোখা আনুগত্য ও এর থেকে উৎসারিত উন্মাদনাকে মোকাবিলা করতে।

ফজলুল কবির: সাংবাদিক।