মূর্তিবাদী গণতন্ত্রে জাতির কল্যাণ হয় না

ব্যালট বাক্স
ব্যালট বাক্স

দুদিন আগে স্বাধীন বাংলাদেশের ৪৭ বছর পূর্ণ হলো। যেকোনো জাতি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উন্নতি করেই। এক হাজার বছর আগে আজকের বাংলাদেশ যেখানে ছিল, আলিবর্দীর সময় সেখানে ছিল না। আলিবর্দীর সময় যেখানে ছিল, ঔপনিবেশিক শাসক হেস্টিংস বা কর্নওয়ালিশের সময় সেখানে ছিল না। ১০০ বছর পর লর্ড কার্জনের সময় বাংলাদেশ যেমনটি ছিল, সামরিক শাসক আইয়ুব খানের সময় বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থা ছিল তার চেয়ে উন্নত। ষাটের দশকে বাংলাদেশ যেখানে ছিল, আজ তার চেয়ে বহুগুণ উন্নত ও সমৃদ্ধ।
কোনো জাতির উন্নয়নের চারটি দিক: অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক। এই চারটির যেকোনো একটি ছাড়া অন্য তিনটির উন্নতি পূর্ণতা পায় না। পরাধীন দেশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম ও অন্যান্য কবি-সাহিত্যিকের দ্বারা ভাষা ও সংস্কৃতির যে উন্নয়ন হয়েছিল, তার তুলনা হাজার বছরের ইতিহাসে দ্বিতীয়টি নেই। কিন্তু তাতেই জাতি সন্তুষ্ট ছিল না। মানুষ চাইছিল স্বাধীনতা। তার চেয়ে কম কিছুতে তাদের শান্তি ছিল না।
১৯৬৯-৭০ সালে দেশের মানুষ সে সময়ের তুলনায় খেয়ে–পরে খারাপ ছিল, কিংবা ১৯৭২-৭৩ সালের চেয়ে খারাপ ছিল, তা বলা যাবে না। কিন্তু মানুষ তাতেই সন্তুষ্ট ছিল না। তারা চাইছিল গণতান্ত্রিক অধিকার। সেটা না পাওয়ায় আর এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে চায় স্বাধিকার এবং সবশেষে স্বাধীনতা। এবং তা অর্জন করতে গিয়ে খেয়ে না–খেয়ে তাদের দিতে হয় চড়া মূল্য। সেই সময়টির যাঁরা সাক্ষী, তাঁরা ছাড়া এখন যাঁরা মাইকে দু–তিনটি দেশাত্মবোধক গান বাজানোর মধ্যে দেশপ্রেমের প্রকাশ ঘটান, তাঁদের বোঝানো যাবে না একাত্তরের নয়টি মাসের পরিস্থিতি।
কোন রাষ্ট্র কতটা স্বাধীন ও সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী, তা সে দেশের জনগণের চেয়ে বেশি সরকারের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। একটি দেশ অর্থনৈতিকভাবে কতটা টেকসই ও মজবুত, তা সাধারণ মানুষের চেয়ে প্রশাসনের বোঝার কথা নয়। একটি সমাজ কতটা সৌহার্দ্য ও শান্তিপূর্ণ, তা শুধু সেই সমাজের মানুষই জানে—পুলিশ বা গ্রাম প্রতিরক্ষা ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা নন। একটি জাতির সাংস্কৃতিক উন্নতি পরিমাপ করার শক্তি সরকার ও প্রশাসনের নেই। প্রশাসনের জাঁদরেল আমলাদের দিয়ে যেকোনো বিষয়ে মোটাসোটা রিপোর্ট লেখানো সম্ভব, কিন্তু একটা গীতাঞ্জলি বা অগ্নিবীণা লেখানো যাবে না। ওসব ফাইলওয়ার্ক করে সম্ভব নয়।
রাজনৈতিক স্বাধীনতার কোনো বিকল্প নেই। সেই সঙ্গে মানুষ আরও কিছু চায়। দেশটি স্বাধীন, কিন্তু তার সামাজিক অবস্থা অস্থিতিশীল ও ভীতিকর, মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নেই, মানবিক মর্যাদা নেই, ন্যায়বিচার নেই, সে স্বাধীনতা মানুষকে তৃপ্তি দেয় না। একটি স্বাধীন দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত—আফ্রিকার কোনো কোনো দেশে যেমন—সে স্বাধীনতা অর্থহীন। সাধারণ মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের নিশ্চয়তা যেমন চাই, তেমনি তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের মূল্য দিতে হবে। তাদের সেই মতামতের প্রকাশ ঘটে
নির্বাচনের মাধ্যমে।
জনগণের মনোভাব উপেক্ষা করে বড় বড় দলের নেতারা কী ভাবেন বা করেন, তারও গুরুত্ব রয়েছে। কারণ, তাঁদের সমষ্টিগত হাত দিয়েই দেশের কল্যাণ ও অকল্যাণ হয়ে থাকে। কাজ করতে গেলে মানুষমাত্রেরই ভুল হয়। কোনো ভুলই ক্ষমার অযোগ্য নয়, কিন্তু সুপরিকল্পিতভাবে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থে কোনো কাজ করলে তার দায় থেকে তাদের যুক্তি দেওয়া যায় না। জনগণের আবেগ, অনুভূতি ও মতামত উপেক্ষা করা খুব বড় করমের নির্বুদ্ধিতা। নেতারা তখনই ভুল করেন, যখন তাঁরা জনগণকে একেবারে ‘নাই’ করে দেন। মানুষকে হিসাবের মধ্যেই গণ্য করেন না। তথাকথিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়ও তাঁরা জনগণকে মনে করেন অধীনস্থ প্রজা; নাগরিক নন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নাগরিকের ক্ষমতা থাকে, প্রজার কোনো ক্ষমতা নেই। প্রজার ভোটাধিকার
থাকা না-থাকা সমান। প্রজাকে ভোটের দিন ঘরে বসে
থাকতে বললে তা–ই করে। নেতা তাঁর সমর্থনে হাত উঁচু করতে বললে বল্লমের মতো উঁচুতে তুলে ধরে হাত। নাগরিক তার মতপ্রকাশে স্বাধীন।
খুব বড় দলীয় নেতা এক রকম, আর জাতীয় নেতা অন্য জিনিস। জাতীয় নেতা বিভক্ত জাতিকে সুসংগঠিত করেন, সংহত করেন। যেমন আব্রাহাম লিঙ্কন বা একালের হো চি মিন কিংবা নেলসন ম্যান্ডেলা। যুদ্ধ ও দীর্ঘ মুক্তিসংগ্রামের ভেতর দিয়ে যেসব জাতি স্বাধীনতা অর্জন করে, সেখানে বিজয়ী শক্তিকে উদার হতে হয়। বিজয়ী শক্তি যদি দখলদার ও পরাজিত শক্তির মতোই নিষ্ঠুর ও সহিংস আচরণ করে, তা মানুষের আস্থা ও শ্রদ্ধা হারায়।
আজকে গণতন্ত্রের যে সংকট, তার শিকড় অতি গভীরে। যেসব দল দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে, তাদের এক পক্ষের পুঁজি মুক্তিযুদ্ধ, আর এক পক্ষের পুঁজি ধর্ম। এই দুটোই অতি মূল্যবান জিনিস। কিন্তু দুটোরই অপব্যবহার অতিমাত্রায় বেশি। দেশের প্রতিটি দেশপ্রেমিক মানুষের কাছে মুক্তিযুদ্ধ অতি অমূল্য সম্পদ। অন্যদিকে সব ধর্মের মানুষের কাছে তার ধর্ম অতিগুরুত্বপূর্ণ। এই দুয়ের বিরোধ নিষ্পত্তি করা কোনো কঠিন কাজ ছিল না। সে পথে কেউ গেলেন না। রাজনীতিতে দুটোকেই বিক্রয়যোগ্য পণ্য করে ফেললেন।
ধর্ম নিয়ে যেমন রাজনীতি হয় না, ইতিহাস নিয়েও রাজনীতি হয় না। তা যাঁরা করতে চান, তাঁরা সাময়িকভাবে সফল হলেও পরিণামে ব্যর্থ হতে বাধ্য। বাংলাদেশে ধর্মীয় মৌলবাদীরা যদি তা কিছুটা বুঝে থাকেন ভালো। ইতিহাস নিয়ে যাঁরা রাজনীতি করছেন, তাঁরা এখনো তা অনুধাবন করার প্রয়োজন বোধ করেননি। মুক্তিযুদ্ধ যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে হয়েছে, তা টিক্কা খানের নাতি-নাতনিকেও স্বীকার করতে হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের একটি মাত্র বয়ান নিয়ে আওয়ামী লীগ রাজনীতি করছে। অন্যদের একেবারে বাতিল করে দিয়েছে। বামেরাও তাঁদের ভূমিকার কথা তুলে ধরতে পারেননি। ফলে রাজনীতি হয়ে পড়েছে ধর্মনিরপেক্ষতা বনাম ধর্মভিত্তিক। অন্যভাবেও বলা যায়, বাঙালি বনাম মুসলমান। বিএনপির রাজনৈতিক আদর্শটা কী, তা বোঝা যায় না। দুই পক্ষই গোঁজামিলের মাধ্যমে সুবিধা নিতে চায়।
প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নীতি–আদর্শে এই গোঁজামিলের কারণে গণতন্ত্র আজ গুরুতরভাবে অসুস্থ। বিভিন্ন রোগে সে আক্রান্ত। নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। আস্থা হারিয়ে ফেলেছে মানুষ। কারণ, তারা জানে নির্বাচনে ভোটার ও ভোটারদের মতামতের কোনো মূল্য নেই। নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্রে পর্যবেক্ষক ও সংবাদকর্মীদের যেমন মূর্তির মতো দায়িত্ব পালন করতে বলা হয়েছে, তেমনি রক্তমাংসের ভোটার ও কোনো কোনো প্রার্থীর পোলিং এজেন্টদের ভূমিকাও হতে পারে পাথরের মূর্তির মতো। গণতন্ত্র মানুষের ব্যাপার, প্রাণহীন মূর্তিদের নয়। মূর্তিবাদী গণতন্ত্র জাতির ক্ষতি ছাড়া কল্যাণ করতে পারে না।

সৈয়দ আবুল মকসুদ লেখক ও গবেষক