জোর যার মুল্লুক তার

‘নৌকা’ একসময় পূর্ব পাকিস্তান পুলিশের লোগো ছিল। রাজনীতিতে নৌকার প্রবেশ ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের সময়। তখন আওয়ামী লীগ, কৃষক-শ্রমিক পার্টি, নেজামে ইসলাম, গণতন্ত্রী দল—এরা মিলে তৈরি করেছিল ‘যুক্তফ্রন্ট’। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থীদের প্রতীক ছিল নৌকা। ১৯৭০ সাল থেকে আওয়ামী লীগ এককভাবে এই প্রতীক ব্যবহার করে আসছে। এখন তার জোটসঙ্গীরাও নৌকায় উঠেছেন।

‘ধানের শীষ’–এর রাজনীতি শুরু হয় ১৯৭০ সালে। ন্যাপ (ভাসানী) এই প্রতীক নিয়ে তখন নির্বাচনী লড়াইয়ে নেমেছিল। পরে অবশ্য দলটি রহস্যজনক কারণে নির্বাচন বর্জন করে।

‘নৌকা’ ও ‘ধানের শীষ’ দুই–ই আবহমান বাংলার চিরচেনা প্রতীক। গ্রামীণ জনপদে এ দুটিকে চিনিয়ে দিতে হয় না। দুইয়ের মধ্যে বিরোধও নেই। বর্ষা এলে কৃষক জমির ধান কেটে নৌকা বোঝাই করে নিয়ে আসেন। মাঝেমধ্যে দুর্ঘটনা ঘটে। প্রকৃতি বৈরী হলে নদীতে নৌকা ডোবে। সঙ্গে সঙ্গে ডোবে ধানও। ফলে গেরস্ত সর্বস্বান্ত হন।

আপাতনিরীহ এই দুটি অতি প্রয়োজনীয় জিনিসের মধ্যে এখন সাংঘাতিক আড়াআড়ি। কেননা, এর মধ্যে রাজনীতি জড়িয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি রাজনীতির মধ্যে পরস্পরের প্রবল প্রতিপক্ষ। আওয়ামী লীগের আছে নৌকা। বিএনপির আছে ধানের শীষ। অন্য দলগুলোর আলাদা প্রতীক থাকলেও রাজনীতির মাঠে তারা বিশেষ সুবিধা করতে পারছে না। তারা বড় দুই দলের কক্ষপথে ঘুরপাক খাচ্ছে। এর বাইরে যারা টিমটিম করে জ্বলছে, তাদের আলো তেমন ছড়ায় না।

আসছে ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে নৌকা আর ধানের শীষে জোর লড়াই হবে বলে কেউ কেউ পূর্বাভাস দিচ্ছেন। আবার কেউ কেউ বলছেন, ফলাফল হবে একতরফা। এখানেও মতামত দুই ভাগে ভাগ হয়ে আছে। কেউ বলছেন, নৌকার জয় অবশ্যম্ভাবী। আবার কেউবা বলছেন, ধানের শীষের জয় ঠেকায় কে। নিজেকে বিজয়ী দেখতে কার না ভালো লাগে এবং বিজয়ী হতে কে না চান। কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, ভোটের ফলাফল পূর্বনির্ধারিত হয়ে আছে।

দেশে ভোটার আছেন ১০ কোটির ওপর। তাঁরাই পছন্দের প্রতীকে ‘টিক’ চিহ্ন দিয়ে জয়-পরাজয় নির্ধারণ করে দেবেন। নির্বাচনে মাঠের খেলোয়াড় হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো। তাদের প্রধান অস্ত্র হলো নিজ নিজ প্রতীক বা মার্কা। কিন্তু এই অস্ত্র আর নিরীহ থাকে না। অনেকেই জোর করে জিততে চান।

একটা সময় ছিল, যখন কথার তুবড়ি ফুটিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে ভোটযুদ্ধে জয়ী হওয়ার চল ছিল। এখন কথায় আর কাজ হয় না। অন্যান্য অস্ত্রেও শাণ দিতে হয়। গাঁও-গেরামে গেরস্তের বাড়িতে নানান অস্ত্র এমনিতেও মজুত থাকে। যেমন টেঁটা, বল্লম, কোঁচ, দা, লগি ইত্যাদি। নানান গৃহস্থালি কাজে, মাছ ধরতে বা নৌকা বাইতে এগুলো কাজে লাগে। চোর-ডাকাত থেকে আত্মরক্ষার জন্যও এগুলো ব্যবহৃত হয়ে আসছে অনেক বছর ধরে। নদী-শিকস্তি এলাকায় নতুন চর জেগে উঠলে ওটি দখলের জন্যও এসব অস্ত্র যথেচ্ছ ব্যবহার হতো। একসময় মেঘনার বুকে জেগে ওঠা চর গজারিয়া নিয়মিত সংবাদ শিরোনাম হয়েছিল। আশপাশের জেলা থেকে লাঠিয়ালেরা এসে নিজ নিজ পক্ষের জোতদারদের হয়ে দাঙ্গা-ফ্যাসাদ করত। খুন হতো শয়ে শয়ে লোক। এখন চর গজারিয়া বেশ শান্ত।

তবে চর দখলের লড়াই একেবারে থেমে যায়নি; বরং নতুনরূপে এটি দেখা যাচ্ছে। সারা দেশই এখন দখলদারদের লক্ষ্য। এটির দেখভাল যাঁরা করেন, আইনকানুন বানান, তাঁরা বসেন শেরেবাংলা নগরের একটি বড় দালানে। ওটি দখলের লড়াই জারি আছে এবং এ লড়াই দিন দিন তীব্রতর হচ্ছে। অধ্যাপক রওনক জাহান এ নিয়ে একটি গবেষণা করেছেন। সূত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের উপাত্ত। তাঁর বিশ্লেষণে দেখা যায়, দাঙ্গা-হাঙ্গামা প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেই শুধু সীমাবদ্ধ থাকে না। দলের মধ্যে কোন্দলের কারণেও ‘গৃহযুদ্ধ’ হয়। এসব ঘটনায় হতাহত হন অনেকেই।

দেখা যাচ্ছে, ২০০২ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে মারামারিতে ১ হাজার ২৫৭টি সংঘর্ষ হয়েছে। তুলনামূলকভাবে আওয়ামী লীগ আর জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ছিল অনেক কম—মাত্র ৮৯টি। আমরা সবাই জানি, জামায়াত হলো বিএনপির পার্টনার। তো, তাদের মধ্যেও মারামারি বাধে মাঝেমধ্যে। ওই সময় বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের সংঘর্ষ হয়েছিল ১৪২ বার। দেখা যাচ্ছে, জাতীয় পার্টি মারামারিতে তেমন পারঙ্গম নয়। ওই ১২ বছরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় পার্টির মারামারি হয়েছিল ১৪ বার, আর বিএনপির সঙ্গে হয়েছিল ৭ বার। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে এসব সংঘর্ষে নিহতের সংখ্যা ছিল ২৫৬।

দেখা যায় যে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে মারামারি বেধে গেলে পুলিশ অনেক সময় দর্শকের ভূমিকা নেয়, আবার অনেক সময় হস্তক্ষেপও করে। সরকারি দলের ওপর পুলিশের পক্ষপাত থাকে অনেক সময়। এ অভিযোগ রাজনৈতিক দলগুলোর। ওই গবেষণায় দেখা গেছে, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন আওয়ামী লীগের ২ জন, বিএনপির ১১ জন এবং জামায়াত–শিবিরের ৪৮ জন। দলের মধ্যে নানা কারণে নিজেরাও মারামারি করে মরে। দেখা গেছে, এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ‘আন্ত-পার্টি সংগ্রামে’ খুন হয় বেশি, বিএনপিতে তুলনামূলকভাবে কম। ওই ১২ বছরের হিসাবে দেখা যায়, যাঁরা নিহত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে আওয়ামী লীগের ১৫৯ জন এবং বিএনপির ৮৬ জন। (সূত্র: রওনক জাহান, পলিটিক্যাল পার্টিজ ইন বাংলাদেশ: চ্যালেঞ্জেস অব ডেমোক্রেটাইজেশন, প্রথমা প্রকাশন, ২০১৫)

২০১৪ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এর আগে ও পরে মোট কতজন যে নিহত হয়েছেন, তার সঠিক সংখ্যাটি জানা যায়নি। ওই সময় পরিস্থিতি ছিল খুবই উত্তপ্ত। নিহতদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন নিরীহ নাগরিক, যাঁদের কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছিল না। তাঁদের অনেককেই আগুনে পুড়িয়ে ও অ্যাসিড দিয়ে জ্বালিয়ে মারা হয়েছিল। রাজনৈতিক বর্বরতার এমন নিষ্ঠুর উদাহরণ সাম্প্রতিক কালে দেখা যায় না।

এসব মারামারি বা সংঘর্ষের লক্ষ্য একটিই, পেশিশক্তি ব্যবহার করে রাজনীতিতে কর্তৃত্ব কায়েম করা বা বজায় রাখা। এর ওপর আদর্শের একটা চাদর চড়িয়ে দেওয়া হয়। এভাবেই চলে আসছে এবং তা আরও বাড়ছে। ৩০ ডিসেম্বর হবে জাতীয় সংসদের নির্বাচন। নির্বাচনের তফসিল অনুযায়ী ১০ তারিখে আনুষ্ঠানিক প্রচারের বলটি মাঠে গড়িয়েছে। প্রথম দিনেই অন্তত পাঁচটি স্থানে দুই প্রতীকের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। ১১ তারিখ ১৮ টি,১২ তারিখ ১৭ টি,১৩ তারিখ ২৩টি এবং ১৪ তারিখে ৮টি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। গত শুক্রবার রাত থেকে শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ১৯ জেলায় হামলা-সংঘর্ষে আহত হয়েছেন ১৫০ জন। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন কেউ কেউ। শনিবার রাত থেকে রোববার সারা দিনে ১৬ জেলায় ১৮টি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। (সূত্র: প্রথম আলো)।

পয়লা দিনই নির্বাচনী ‘প্রচার অভিযানে’ দুজন নিহত হয়েছিলেন। দুজনই আওয়ামী লীগের। খুনোখুনি শেষতক কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, তা নিয়ে আছে নানান জল্পনা, নানান শঙ্কা। সাংঘর্ষিক রাজনীতির কারণে তফসিল ঘোষণার পরেও ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনটি হয়নি।

এখন কারও সঙ্গে দেখা হলেই প্রশ্ন শুনি, ‘ভাই, নির্বাচন কি হবে?’

প্রশ্ন হলো, কেন এই শঙ্কা? ভোটের দিন কোথায় ভোটাররা উৎসবে মেতে উঠবেন, তা নয়। চারদিকে ছড়াচ্ছে আতঙ্ক। জয়ের জন্য সবাই মরিয়া। কেউ হারতে চান না। চারদিকে শুধুই তর্জন-গর্জন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার একটি ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছেন, তিনি বিব্রত, মর্মাহত। তাঁর কাজ কিন্তু বিব্রত বা মর্মাহত হওয়া নয়। তাঁর কাজ হলো মাঠে শৃঙ্খলা বজায় রাখা। যাঁরা আচরণবিধি লঙ্ঘন করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ত্বরিত ও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া। তেমনটি এখনো দেখছি না। নির্বাচনের মাঠের দিকে তাকালে একটি অতি পুরোনো প্রবাদের কথা মনে পড়ে—জোর যার মুল্লুক তার।

মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক
[email protected]