উৎসবের নির্বাচন নাকি আশঙ্কার

ইমতিয়াজ আহমেদ
ইমতিয়াজ আহমেদ

বাংলাদেশে আবারও নির্বাচনী মৌসুম এসেছে। তবে অতীতের মতো এবারও আনন্দের চেয়ে আশঙ্কাটাই যেন বেশি। এর বেশ কিছু কারণ রয়েছে। ১৯৯১ সাল থেকে গত ছয়টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভোট গ্রহণের দিন থেকে আগের তিন সপ্তাহ এবং পরের এক সপ্তাহ নিয়ে সংবাদপত্রে উঠে আসা চিত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, নির্বাচন সহিংসতামুক্ত ছিল না। ওই নির্বাচনগুলোতে সেই সময়কালের ভেতরে মোট নিহতের সংখ্যা ৫৩২ এবং আহতের সংখ্যা ২০ হাজার ২৫০। অর্থাৎ প্রতি জাতীয় নির্বাচনে সহিংসতায় গড়ে ৮৮ জনের প্রাণ গেছে, আহত হয়েছেন ৩ হাজার ৩৭৫ জন। উল্লেখ্য, ২০০১ সালের নির্বাচনে সহিংসতায় সবচেয়ে বেশি ২৪৮ জন নিহত হন, আহত হন ১১ হাজার ৭৪ জন। বিষয়টিই ভীতিকর।

এর জন্য দায়ী বিভাজনের রাজনীতি। তবে নির্বাচনী ব্যবস্থায় বা ‘গণতন্ত্রে’ এটাই হয়, এতে ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ’ কিংবা ‘বিজয়ীর দখলেই চলে যায় সবকিছু’! এ ক্ষেত্রে মহাত্মা গান্ধীর উদ্ধৃতির উল্লেখ না করলেই নয়, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের কল্যাণই যে সর্বোত্তম, এই মতবাদে আমি বিশ্বাসী নই। সাফ কথা, ৫১ শতাংশের ভালোর জন্য প্রায়ই ৪৯ শতাংশের স্বার্থ বিসর্জন দিতে হয়। এটি একটি নিষ্ঠুর মতবাদ এবং এটি মানবতার ক্ষতি করেছে।’ সুনির্দিষ্টভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনের এটাই সহজাত দুর্বলতা এবং বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশ এখনো এই দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আধুনিক যুগের প্রথম দিককার গণতন্ত্রের একটি যুক্তরাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে ভালো উদাহরণ হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের মূল ভাবটি এ অর্থে ‘গণতন্ত্রবিরোধী’। সম্ভবত এর সংবিধান রচয়িতারা সংখ্যাগরিষ্ঠের ক্ষমতায়ন নয়, বরং ক্ষমতার সীমায়ন করতে চেয়েছিলেন। মার্কিন কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেট ও নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদ গঠন এবং জটিল প্রক্রিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন—সেখানে আংশিক আঞ্চলিক হিসাবে, আংশিক সংখ্যার হিসাবে এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচনব্যবস্থার প্রচলন ঘটিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা হয়েছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের সদস্য অথবা প্রেসিডেন্টের নীতি বাস্তবায়নকারী পুরো দলের সদস্য, যাঁদের ‘মন্ত্রী’ বলে অভিহিত করা হয়, তাঁরা নির্বাচিত হন না, প্রেসিডেন্ট তাঁদের মনোনয়ন দেন। পরে সিনেট তাঁদের নিয়োগ অনুমোদন করে। কাজেই সরকারের তিনটি শাখার মধ্যে কেবল প্রেসিডেন্ট বা নির্বাহী বিভাগের প্রধান এবং আইনসভার সদস্যরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন। এমনটা করা হয়েছিল প্রধানত সংখ্যাগরিষ্ঠের ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান নির্বাচনী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দেখা যাচ্ছে, প্রেসিডেন্ট তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে ৩০ লাখ কম ভোট পেয়েও নির্বাচিত হয়েছেন। অভিযোগ উঠেছে, বিদেশি শক্তির সহায়তা নিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আরও বেশি কার্যকর করতে সংবিধানের সৃজনশীল সংশোধনীর প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।

শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে না পারায় আমরা ভুলেই যাচ্ছি যে জাতীয় নির্বাচন দেশে একটি উৎসবের উপলক্ষ। আমরা যদি বিগত তিনটি ‘পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য’ নির্বাচনের কথা বিবেচনা করি, তার সব কটিতেই ভোটার উপস্থিতির হার ছিল ৭০ শতাংশের ওপরে। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল ৭৪ শতাংশ, ২০০১-এ ৭৪ দশমিক ৮৮ শতাংশ এবং ২০০৮-এর নির্বাচনে ৮৭ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে দেশের ‘রাজনীতি-সচেতন’ ভোটারদের সাধুবাদ দেওয়া যেতে পারে। তবে পাশাপাশি মনে রাখতে হবে, অন্তত এই একটি দিন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাহীন ভোটাররা নিজেদের ‘ক্ষমতাধর’ ভাবতে পারেন। প্রার্থীরা এসে তাঁদের সঙ্গে হাত মেলান। খুব কমসংখ্যক ভোটার এ উপলক্ষ হাতছাড়া করতে চান।

এটা কি আমাদের আশান্বিত করতে পারে? নিশ্চিতভাবেই পারে। এবারই প্রথম সব নিবন্ধিত দল এমন এক জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি হয়েছে, যার পদ্ধতি ঠিক করে দিয়েছে ক্ষমতাসীন দল। এটি ঘুরে দাঁড়ানোর একটি সুযোগ এনে দিতে পারে। নচেৎ নির্বাচনের পর দেশ আগের অবস্থায় ফিরে যাবে। সহিংসতা না হলেও আরেক দফায় আমাদের অনমনীয় রাজনীতির মুখোমুখি হতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে কেবল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকেই প্রবোধ পাওয়া যেতে পারে, ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ।’

আসুন, আমরা দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক উৎসবকে স্বাগত জানাই!

ইমতিয়াজ আহমেদ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এবং সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক

*এই লেখার এবং নির্বাচন বিষয়ে প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় এ পর্যন্ত প্রকাশিত মন্তব্য-কলামগুলোতে প্রকাশিত সব অভিমত লেখকদের নিজস্ব