ভোটের উত্তরটা কে জানতে পারে?

চাচা বললেন, ‘কাঁই (যে) জেতে জিতুক। হামার কী তাতে? হামার কথা কাঁই কইবে? হামরা আগোতো (আগেও) কাম করি খাচি, এলাও কাম করি খাই।’

চাচার কথায় বললাম, ‘আগে তো শিনডার (পাটখড়ির) বেড়া আর শণের চাল ছিল, এখন তো টিনের বাড়ি।’ চাচার সঙ্গে আরও দুজন আলোচনায় যোগ দিলেন। চাচার পাশ থেকে এক যুবক বললেন, ‘এনজিওর থাকি লোন করি টিনের ঘর বানাছি। বানোত (বন্যায়) বাড়ি ভাঙি নদীত গেইচে। এক টাকাও পাই নাই। সরকার কাঁই হয় হউক।’

বিত্তহীন কিংবা নিম্নবিত্ত মানুষের কাছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন এখনো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি৷ তবুও নির্বাচন এলে তাঁরাও চান একটা সুষ্ঠু নির্বাচন হোক।

চলতি সপ্তাহে রংপুরের পার্কমোড় এলাকায় একদল কৃষিশ্রমিকের সঙ্গে কথা হয়। রাত তখন প্রায় ১১টা। তাদের হাতে ছোট ছোট পুঁটলি। কারও পরনে প্যান্ট-শার্ট, কারও লুঙ্গি-শার্ট। পোশাকের ভাষা আর মলিন মুখের নীরবতার ভাষা যেন একই। এই দৃশ্য বছরে দুই মৌসুমে দেখা যায়। বগুড়া, টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন এলাকায় কাজের সন্ধানে যান এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষ। কেউ কেউ শীতে একটু কাঁপছেন। বয়স্ক একজনের সঙ্গে কথা শুরু করি। জানতে পারলাম, ২০ বছর থেকে তিনি বগুড়ায় যান কাজের সন্ধানে। এবারে কাজ তেমন পাননি। কয়েক বছর ধরে দৈনিক ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা পেলেও এবার দৈনিক ৩০০ টাকা পেয়েছেন। কাজও কম। মাত্র চার দিন থেকে ফিরেছেন। পার্কমোড়ে তাঁরা কুড়িগ্রাম যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কোনো ট্রাক পেলে ছাদে যেতে চান। নির্বাচনের প্রসঙ্গে খুবই নিরুৎসাহিত।

সাধারণ কৃষিশ্রমিক কিংবা কারখানার শ্রমিক জানেনও না তাঁদের শ্রমের ওপর রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন টিকে আছে। ইতিহাসের ভেতর দিয়ে হেঁটে আসা শ্রমজীবী মানুষ আজও বুঝতে শেখেননি তাঁরাই সমাজ পরিবর্তনের কারিগর। তাঁদের রাষ্ট্র সেই সত্য বুঝতেও দেয় না। ১৭৫৭ সালে যখন ব্রিটিশরা বাংলার দখল নেয়, তখন বাংলার সাধারণ মানুষ নির্বাক দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। কৃষক ও দেশীয় সামন্তরা যত দিনে প্রতিবাদী হলো, তত দিনে দেশ বেদখল। তা ছাড়া ঠকে ঠকে তারা শিখেছে ক্ষমতার পালাবদল মানে ছিল রাজায়–রাজায় লড়াই। প্রজার যেন কিছুই করার নেই৷ শুধু তা–ই কেন, ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিপ্লবের সঙ্গে সাধারণ মানুষ সম্পৃক্ত হলে ব্রিটিশ–বিদায় তখনই হতো। এসব না হওয়ার মূলে ছিল জাতীয়তাবোধের অভাব।

২০১৮ সালে এসে সরকার নির্বাচনে অধিকাংশ নিম্নবিত্ত কিংবা বিত্তহীনেরা একধরনের নীরবতার আশ্রয় নিয়েছে। সহজে মুখ খুলতে চাইছে না। সবাই যে একই কাজ করছেন, তা না। তবে অধিকাংশই এ কাজ করছেন।

দেশের উন্নয়ন যতই হোক না কেন, রংপুরের শ্রমজীবীদের ভাগ্যের পরিবর্তন তেমনটা হয়নি।

রংপুর সিটি মাছের বাজারের পাশেই ব্যাগের দোকান। দোকানির সঙ্গে একজন ক্রেতার কথোপকথন কানে পড়ল। দোকানি বলছেন, ‘ভোটের কী হইবে আল্লাহই জানে। ভোট গতবারের মতোই হয় নাকি এলা।’

বাসে বগুড়া যাচ্ছিলাম। পাশের সিটে বসেছেন বয়স্ক ভদ্রলোক। তিনিই ভোটের প্রসঙ্গ তুললেন। অনেক কথার মধ্যে জানালেন, তিনি ভোট দিতে যাবেন না। কারণ, গন্ডগোল হলে তিনি দৌড়াতে পারবেন না।

২০১৪ সালের মতো ভয়াবহতা এবারেও নেমে আসে কি না, সেই শঙ্কা মানুষের কেটে গেছে। তবে ভোটে পক্ষপাতের আশঙ্কা অমূলক নয়। সেই সঙ্গে অনেকেরই ভীতি, ভোটের দিন কেন্দ্র নিরাপদ থাকে কি না।

সাধারণ মানুষের ধারণা, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। অনেকের সঙ্গে কথা বলে এমনটাই পেয়েছি। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব ছিল জনমনের ভীতি দূর করা। নির্বাচন কমিশনকে সেই দায়িত্ব পালন করতে দেখা যাচ্ছে না। বরং কমিশনকে গত বছরের মতোই মনে হচ্ছে। সরকারকে ক্ষমতায় রেখে ভালো নির্বাচন করতে হলে নির্বাচন কমিশনকে অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি দায়িত্বশীল হওয়া জরুরি। সরকারের আজ্ঞাবহ কমিশন না হয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষেত্র কমিশনকেই প্রস্তুত করতে হবে। নিরপেক্ষতার পরীক্ষায় কমিশনকে আগে জয়ী হতে হবে। তারপর নির্বাচনের জয়-পরাজয়। ক্ষমতায় যে দলই যাক, আমরা চাই নির্বাচন জয়ী হোক।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এমন একটি দল, যে দলের নেতৃত্বে বাংলাদেশে স্বাধীন হয়েছে। সেই দল অনাস্থার দলে পরিণত হবে, এটা কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়। দলটি যদি সাময়িক ক্ষমতার জন্য দীর্ঘ মেয়াদে গ্রহণযোগ্যতা হারায়, তার পরিণতি দলের জন্য ভালো হবে না৷ দলগুলো নিজেদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল রাখার স্বার্থে যখন ভালো কাজ করবে, তখন দেশবাসী লাভবান হবে। জনগণের রায়ের প্রতি সম্মান জানানোর সংস্কৃতি কবে চালু হবে কে জানে? বিদ্যমান দলগুলো যদি সেই চেষ্টা না করে, তাহলে আমরা কোন অনাগত সময়ের দিকে চেয়ে থাকব?

দুদিন আগে রিকশায় করে যাচ্ছিলাম। রিকশা থেকে নামার সময় রিকশাচালক আমার কাছে জানতে চান,‘ভাই, কন তো ভোট কি ভালো হইবে?’ এ কথার জবাব তো আমি জানি না। আপনারা কি জানেন?

তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
[email protected]