পরিবেশ বাঁচানোর কথা কেউ বলল না!

বৈশ্বিক উষ্ণায়ন যদিও একুশ শতকের বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত প্রধান সমস্যা, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিষয়টি আদৌ গুরুত্ব পেয়েছে বলে মনে হয় না। দেশের কোনো রাজনৈতিক দলের ইশতেহারে পরিবেশ রক্ষায় দলের করণীয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো বক্তব্য চোখে পড়ে না। অথচ বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রথম ছয়টি সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্ত দেশের অন্যতম বাংলাদেশ। বিজ্ঞানীদের ধারণা, কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের এক-পঞ্চমাংশ উপকূলীয় মানুষ, অর্থাৎ প্রায় তিন কোটি মানুষ বসতিহারা হবে। অত্যন্ত ঘনবসতির দেশ বাংলাদেশে এ সংখ্যা পৃথিবীর অনেক দেশের মোট জনসংখ্যার চেয়ে অনেক গুণ বেশি। এমন একটি সমস্যা যখন আমাদের তাড়া করছে, তখন রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বিকার ভূমিকা সচেতন নাগরিকদের উদ্বিগ্ন না করে পারে না। সত্যি কথা বলতে কি, প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা বাংলাদেশে এখন প্রাণ ও জীববৈচিত্র্য এবং পরিবেশ সবচেয়ে বড় হুমকির মুখে। কিন্তু দেশের বড় কোনো রাজনৈতিক দলই এ বিষয়ে তাদের কোনো কর্মসূচি প্রকাশ করেনি। বরং পরিবেশবিনাশী প্রকল্প গ্রহণে তাদের আগ্রহ সীমাহীন। রামপাল কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, ফুলবাড়ী প্রকল্প আমাদের এই আশঙ্কার পক্ষে সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত।

নদীমাতৃক বাংলাদেশে এখন পানির হাহাকার সর্বব্যাপী। ক্ষমতাবানেরা নদী, বিল, খাল দখল করেই চলেছে। একুশ শতককে চিহ্নিত করা হচ্ছে পানিযুদ্ধের শতক হিসেবে। পানি নিয়ে সারা দুনিয়া উদ্বিগ্ন। কেবল আমরাই পানি নিয়ে নিরুদ্বেগে দিন কাটাচ্ছি! রিয়েল এস্টেট ব্যবসা এখন ভূমিদস্যুতায় রূপ নিয়েছে। শিল্পবর্জ্যসহ নানা বর্জ্যে দেশে নদী-জলাশয়ের পানিদূষণ ভয়াবহ রকম বেশি। পৃথিবীর সবচেয়ে বসবাস–অযোগ্য শহরের তালিকায় আমাদের রাজধানী ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয় (প্রথম স্থানটি যুদ্ধাক্রান্ত সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কর)। ঢাকাসহ দেশের বায়ু, পানি, মাটি—সবই মারাত্মকভাবে দূষিত। তার সঙ্গে আছে ভয়াবহ রকম শব্দদূষণ। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আদিম স্তরের এবং রাজধানীর সর্বত্র পচাগলা বর্জ্যে নগরবাসীর জীবন ওষ্ঠাগত। এ কারণে ক্যানসারসহ নানা দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে এ দেশের মানুষ। কিন্তু সুচিকিৎসার ন্যূনতম সুবিধাও অনুপস্থিত। স্বাস্থ্যব্যবস্থা কেবল ধনীদের আয়ত্তাধীন এবং গরিব সাধারণ মানুষ হয় বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে, নয়তো অপচিকিৎসার অসহায় শিকার। অথচ এসব সমস্যা সমাধানের কোনো কার্যকর উদ্যোগ দৃষ্টিগোচর নয়।

বিগত তিন দশকে দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন সবার নজর কাড়ে বটে। কিন্তু যথাযথ পরিকল্পনার অভাব এবং ব্যাপক দুর্নীতি এই উন্নয়নের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় আমাদের পরিবেশ ভয়ংকরভাবে দূষিত। কার্বন নিঃসরণ বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। বাড়ছে অন্যান্য দূষণকারী গ্যাস নিঃসরণও। উন্নয়নের পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষায় যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের কোনো তৎপরতা দেখা যায় না। উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে শুধু কাগজে–কলমে। বাস্তবতা হচ্ছে, ক্ষমতাশালীরা সবকিছুই অনায়াসে পেয়ে যাচ্ছে। সুন্দরবন বাংলাদেশের এক প্রাকৃতিক মহাপ্রাচীর। শত শত বছর ধরে সুন্দরবন বাংলাদেশকে প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে চলেছে। রামপাল কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প সুন্দরবনের বিনাশ অনিবার্য করে তুলেছে। যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প ভারতে ছাড়পত্র পায়নি, সেই একই প্রকল্প আমরা দেশের পরিবেশবাদীদের আপত্তি, এমনকি আন্দোলন-সংগ্রাম উপেক্ষা করে রামপালে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। আন্দোলনকারীদের কঠোরভাবে দমন করতেও শাসকগোষ্ঠীর বাধেনি।

বনভূমি ধ্বংস করা চলছে বাধাহীনভাবে। বনভূমি ধ্বংসে বন কর্মকর্তাদের অপার আগ্রহ। শুধু সুন্দরবন নয়, ভাওয়াল-মধুপুর জাতীয় বনভূমি, বরেন্দ্র, সিলেট ও পার্বত্য বনভূমি এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। জাতীয় সম্পদের এমন বেপরোয়া বিনাশ গোটা বাংলাদেশের অস্তিত্ব সংকটের কারণ হতে পারে।

একদিকে জাতীয় নির্বাচনে পরিবেশ রক্ষায় দলগুলো কোনো অঙ্গীকার করছে না, করণীয় নির্ধারণ করছে না, অন্যদিকে নির্বাচনপ্রক্রিয়া পরিবেশ বিনাশে ভূমিকা পালন করছে। আধুনিক যুগে পরিবেশবান্ধব নির্বাচনী প্রচার সহজলভ্য হলেও আমরা সেদিকে তাকাচ্ছি না। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে নির্বাচন উপলক্ষে এত পোস্টার, ব্যানার, লিফলেট ছাপা, সাঁটানো বা বিতরণ করা হয় না। কয়েক বছর আগে আইন করে নির্বাচনী দেয়াললিখন বন্ধ করা গেছে। কিন্তু পোস্টার, লিফলেট, মাইক বন্ধ করা হয়নি। আনুষ্ঠানিক নির্বাচনী প্রচার শুরুর আগেই গোটা দেশে সম্ভাব্য প্রার্থীদের পোস্টার, ব্যানার, প্যানাসাইন, ফ্লেক্সিসাইনে ভরা ছিল। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল সর্বত্র। এ খাতে অপচয় করা হয়েছে কোটি কোটি টাকা। কিন্তু দেশের কোনো রাজনৈতিক দলই তার প্রতিবাদ করেনি। কেননা, সুযোগ পেলে তারাও একই কর্মে শামিল হতো। আমার এক ভারতীয় বন্ধু বলছিলেন, শুধু এবারের নির্বাচনের আগে বাংলাদেশে যে পরিমাণ ফ্লেক্সিসাইন দেখা গেছে, গোটা ভারতে এক বছরেও এত ফ্লেক্সিসাইন ব্যবহার করা হয় না!

ডিজিটাল বাংলাদেশে ডিজিটাল প্রচারাভিযানই কাঙ্ক্ষিত ছিল। কিন্তু প্রচার–প্রচারণা চলছে সেকেলে কায়দায় পোস্টার, ব্যানার, লিফলেট আর মাইকিং করে। অথচ সহজেই এখন ইলেকট্রনিক মাধ্যম ব্যবহার করে প্রত্যেক প্রার্থী প্রত্যেক ভোটারের কাছে সহজে পৌঁছে যেতে পারেন। সেটি করা গেলে মাইকের উৎকট অত্যাচার, পোস্টার নিয়ে হানাহানি বন্ধ করা সম্ভব ছিল।

এবারের নির্বাচনে নজিরবিহীন সহিংসতার ঘটনায় গোটা জাতি উদ্বিগ্ন। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনী প্রচারে নামতেই পারছে না। পেশি শক্তির এমন নগ্ন প্রকাশ অতীতে কখনো দেখা যায়নি। এমতাবস্থায় নির্বাচনী প্রচারের ভিন্ন উপায় খুঁজে বের করা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে, যেখানে যেকোনো দল বা প্রার্থী স্বাধীনভাবে নির্বাচনী প্রচার চালাতে পারে।

আশা করি, প্রথাগত নির্বাচনী প্রচারাভিযান বন্ধে নতুন উপায় উদ্ভাবনে দেশের সব রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন কমিশন ভেবে দেখবে। সনাতন নির্বাচনী প্রচারের মাধ্যমে এবারের জাতীয় নির্বাচনই হোক বাংলাদেশের শেষ নির্বাচন। আগামী সব স্থানীয় নির্বাচনে সনাতনী পোস্টার, লিফলেট, মাইক ব্যবহারের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে মোবাইলে খুদে বার্তাসহ কেবল ইলেকট্রনিক প্রচার ব্যবস্থায় উত্তরণ ঘটিয়ে আমরা দেশের নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় নতুন দিক উন্মোচন করতে পারি। তাতে পরিবেশ উন্নত হবে, ব্যয় সাশ্রয় ঘটবে, হানাহানি, সন্ত্রাসের লাগাম টানা সহজ হবে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে নির্বাচনী প্রচার করার জন্য আইন করা দরকার। সে ক্ষেত্রে কী কী বিধিনিষেধ আরোপ করা প্রয়োজন, তাও ভেবে দেখার সময় এসেছে। আশা করি, নতুন সরকার এবং নির্বাচন কমিশন এ বিষয়ে উদ্যোগী হবে।

এভাবে আমরা পারি ক্রমে পরিবেশবান্ধব একটি ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে। রাজনৈতিক দলগুলো পরিবেশবান্ধব কর্মসূচি ঘোষণা করে এক অনিবার্য ধ্বংসের হাত থেকে জাতিকে রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে নতুন প্রজন্ম আশা করে।

আমিরুল আলম খান: যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান।
[email protected]