চায়ে সুদিন

আঁকাবাঁকা টিলাবেষ্টিত এলাকায় ‘একটি কুঁড়ি দুটি পাতা’র যে মনোরম পরিবেশ তৈরি হয়েছে; যে চা-শিল্প নিয়ে জাতি আজ গর্ব করে, তার পেছনে রয়েছে এক করুণ ইতিহাস। ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন রাজ্য থেকে ছিন্নমূল মানুষকে ক্রীতদাস হিসেবে এনে এই দেশে চা-শ্রমিক বানানো হয়েছিল। সেই দাস-শ্রমিকদের রক্ত পানি করা শ্রমের মধ্য দিয়ে চা-শিল্পের ভিত্তি দাঁড়িয়েছিল। সেই শিল্প আজ বিকশিত হয়েছে। এ শিল্পের নেপথ্য মানুষগুলোর ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি।

 টিআইবির এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের চা-বাগানগুলোয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে শ্রম আইন লঙ্ঘিত হচ্ছে। চা-বাগানের একজন স্থায়ী শ্রমিকের দৈনিক মজুরি ১০২ টাকা। এর বাইরে রেশন, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাড়িভাড়া ইত্যাদির মাধ্যমে বাগানমালিকেরা যে সুবিধা দেন, তার সম্মিলিত মূল্য দাঁড়ায় মাসে ৫ হাজার ২৩১ টাকা। অস্থায়ী শ্রমিকদের মজুরি আরও কম। ৬৪টি বাগানের ওপর করা জরিপে দেখা গেছে, সেগুলোর কোনো বাগান মুনাফার ভাগ শ্রমিককে দেয় না। কোনো বাগানে গোষ্ঠীবিমা নেই। কোনো বাগান সময়মতো শ্রমিককে স্থায়ী করে না। ৯৩ শতাংশ বাগানে শ্রমিকদের নিয়োগসংক্রান্ত কোনো নথিই দেওয়া হয় না।

অতিরিক্ত পাতা তোলা ও অতিরিক্ত কর্মঘণ্টার জন্য দ্বিগুণ মজুরি দেওয়ার নিয়ম থাকলেও কোনো বাগানেই তা দেওয়া হয় না। পাতা মাপার ক্ষেত্রে ওজনেও কারচুপি করা হয়। অঙ্গহানির ক্ষেত্রে ঠিকমতো ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় না। বাগান থেকে যে রেশন দেওয়া হয়, তা দিয়ে প্রয়োজন মেটে না। শ্রমিকের বসবাসের জন্য বাগান কর্তৃপক্ষ যে ঘর বরাদ্দ দেয়, তার ৯১ শতাংশে মাঝ-বরাবর কোনো বেড়া নেই। ফলে বাবা-মা, ছেলেমেয়ে, ছেলের স্ত্রী ও গরু-ছাগল নিয়ে একসঙ্গে বসবাস করতে হয়।

কোনো মানদণ্ডেই এটিকে আধুনিক ও মানবিক ব্যবস্থাপনা বলা যায় না। টিআইবির জরিপ অনুযায়ী, দেশে ২২৯টি মূল ও ফাঁড়ি চা-বাগানে প্রায় ১ লাখ ২৩ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। এই শ্রমিকেরা জাতীয় অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু প্রতিদানে তাঁরা কী পাচ্ছেন, তা ভাবার সময় এসেছে। বেশির ভাগ বাগান কর্তৃপক্ষ ক্ষমতা ও রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তির কারণে খুব একটা জবাবদিহির মধ্যে পড়ে না। যাদের তদারকি করার কথা, তাদের বিরুদ্ধে আছে ঘুষ–দুর্নীতির অভিযোগ।

সম্প্রতি বাংলাদেশ চা বোর্ড জানিয়েছে, এ বছর চায়ের উৎপাদন অনেক বেড়েছে। নভেম্বর পর্যন্ত ৭ কোটি ৬০ লাখ কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। শুধু উৎপাদন নয়, আন্তর্জাতিক বাজারে দামও ভালো যাচ্ছে। উৎপাদন ও বাজারদরে সুখবর এলেও শ্রমিকের ভাগ্যে কোনো সুখবর মেলেনি। তঁাদের জন্য কোনো প্রণোদনার কথা জানা যায়নি। জাতির জন্য এটি লজ্জার। এই লজ্জা মোচন ও জাতীয় অর্থনীতির স্বার্থই এই অবস্থার অবসান দরকার। শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে।