ইশতেহার, কথা রাখা না-রাখা

আসিফ নজরুল
আসিফ নজরুল

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ওয়েব পাতায় একটি লক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। তা আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি নিয়ে। ২০০৮ সালে দলটির নির্বাচনী ইশতেহার মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। এরপর ১০ বছর ধরে ক্ষমতায় রয়েছে দলটি। এই ১০ বছরে এসব প্রতিশ্রুতির অনেক কিছু পূরণ হয়নি। ঐক্যফ্রন্ট একটা একটা করে প্রতিশ্রুতি আর বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছে। প্রতিটির নিচে লিখেছে, ‘কথা দিয়ে কথা রাখে না আওয়ামী লীগ’।

প্রশ্ন আসতে পারে কে রেখেছে কথা? ঐক্যফ্রন্টের প্রধান শরিক বিএনপি দুবার প্রায় পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় থেকেছে ১৯৯০ সালের পর। তারা কি কথা রেখেছিল? চুলচেরা নিরীক্ষায় না গিয়েই আমরা বলতে পারি, রাখেনি। রাখলে বিএনপি আমলে দুর্নীতি, দলীয়করণ, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, সন্ত্রাসের ঘটনাগুলো ঘটত না। এসব করার কথা বলে তারা ক্ষমতায় আসেনি। এসব বলে ক্ষমতায় আসেনি আওয়ামী লীগও। কিন্তু দুই আমলেই কমবেশি এসব ঘটেছে। এ দেশে প্রকৃত নির্বাচন হলে ক্ষমতা বদল হয় এ কারণেই। এক দলের দুঃশাসনে অতিষ্ঠ হয়ে আরেক দলকে ভোট দেয় মানুষ।

এমন একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নির্বাচনী ইশতেহারের কোনো মূল্য আছে তাহলে? সম্ভবত খুব একটা নেই। তবে একটি জিনিস অন্তত বলা যায়, ইশতেহারে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি লিখিতভাবে থাকে বলে এটি কিছুটা হলেও নৈতিক দায়বদ্ধতা তৈরি করে। ক্রসফায়ার বন্ধ বা কোনো কালো আইন বাতিল করার মতো সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি ইশতেহারে থাকলে প্রশ্ন তোলা যায়, কেন করা হয়নি তা?

উন্নত রাজনৈতিক বিশ্বে ইশতেহারের গুরুত্ব এর চেয়ে অনেক বেশি। সেখানে ইশতেহার মানে অনান্তরিক প্রতিশ্রুতি বা নির্বাচনে জেতার কৌশল না। ইশতেহার মানে পবিত্র প্রতিশ্রুতি, এমনকি প্রতিজ্ঞা অনেক ক্ষেত্রে। এ বিষয়ে পশ্চিমের ১১ জন গবেষকের একটি গবেষণাপত্র (দ্য ফুলফিলমেন্ট অব পার্টিস ইলেকশন প্লেজেস) ২০১৭ সালে আমেরিকান জার্নাল অব পলিটিক্যাল সায়েন্স-এ প্রকাশিত হয়। তাঁরা আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইতালি, কানাডাসহ পশ্চিমের ১২টি দেশের ৫৭টি নির্বাচনের ২০ সহস্রাধিক নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি নিয়ে গবেষণা করেন। তাঁদের অভিমত, এসব দেশের রাজনৈতিক দলগুলো এককভাবে ক্ষমতায় গেলে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির সিংহভাগ বাস্তবায়ন করে থাকে। আমেরিকায় বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে দলগুলো নির্বাচনকালীন প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে।

বাংলাদেশে প্রতিশ্রুতি পালনের এ ধরনের রেওয়াজ নেই। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি এখানে অনেক ক্ষেত্রে থাকে অপরিমেয়, অনির্দিষ্ট এবং অস্পষ্ট। যেমন বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করা হবে—এই প্রতিশ্রুতি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বিভিন্ন সময়ে করেছে। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে মাসদার হোসেন মামলার মানদণ্ড অনুসারে এই স্বাধীনতা অনেকাংশে অর্জিত হয়নি। কিন্তু একতরফা যুক্তি দেখিয়ে এটি অর্জিত হয়েছে, তা নিজ নিজ শাসনামলে বলতে পারে দুটো দলের সরকারই।

অলংকরণ : তুলি
অলংকরণ : তুলি

২.
এত কিছুর পরও এবারের নির্বাচনে ইশতেহারের গুরুত্ব ছিল কিছুটা বেশি। দীর্ঘ ১০ বছর পর একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হচ্ছে এবং এই নির্বাচনে একটি প্রধান পক্ষ বিএনপি এবার অংশ নিচ্ছে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে। ড. কামাল হোসেন দীর্ঘদিন রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় সংস্কার করে জবাবদিহিমূলক, মানবাধিকারবান্ধব ও জনকল্যাণকর একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। তাঁর নেতৃত্বে গড়া জোটের নির্বাচনী ইশতেহারে বিএনপির উপস্থিতিতে এর কতটুকু প্রতিফলন থাকবে, এ নিয়ে কৌতূহল ছিল মানুষের। ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহারে এর উত্তর পাওয়া গেছে। এই ইশতেহারে কামাল হোসেনের চিন্তাধারার বহু প্রতিফলন আছে। আছে সমসাময়িকতাও। এতে রাষ্ট্র মেরামত করা, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, কোটা আন্দোলন ও চাকরির বয়সসীমা নিয়ে তরুণদের আশাবাদী হওয়ার মতো প্রতিশ্রুতি রয়েছে। রয়েছে আমাদের ক্রমাগত বিভাজিত সমাজে সংহতি ও ঐক্য ফিরিয়ে আনার তাগিদও। এই ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার অব্যাহত রাখার ঘোষণাও রয়েছে, যা ভবিষ্যতে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্যও প্রাসঙ্গিক হতে পারে।

ইশতেহারে স্পষ্টভাবে খারাপ থাকে না আসলে কিছুই। দেশের দুটো প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ইশতেহার প্রকাশিত হয়েছে। একঝলক দেখে সেখানেও মন্দ কিছু খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে আমার কাছে মনে হয়েছে, বিএনপির ইশতেহারে নাগরিক অধিকার এবং অবাধ তথ্যপ্রবাহের ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগেরটি বেশি উন্নয়ন ভাবনাকেন্দ্রিক।

ঐক্যফ্রন্টের মতো বিএনপির ইশতেহারে ক্ষমতাকাঠামোতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের কথাও বলা আছে। যেমন প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা, দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী না থাকা, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার ও বিভিন্ন সংসদীয় কমিটির প্রধানকে নিয়োগ, ৭০ অনুচ্ছেদের সংস্কার, উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি। এসব খুব চিত্তাকর্ষক হলেও অতীতে ক্ষমতায় থেকেও কেন করা হয়নি, এ প্রশ্ন মানুষের মনে থাকবে।

আওয়ামী লীগের ইশতেহারে বিএনপির উল্লিখিত বিষয়গুলো সম্পর্কে কিছু বলা নেই, যদিও এসব বিষয়ে একসময় বেশি সোচ্চার ছিল তারাই। তাদের ইশতেহারে সামাজিক নিরাপত্তাবলয় সম্প্রসারণ, দারিদ্র্য দূরীকরণ, মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়ন, টেকসই উন্নয়ন ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এতে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দায়সারা গোছের যেসব কথাবার্তা আছে, তা কোনোভাবেই এসব বিষয়ে ক্ষমতাসীন দলটির বর্তমান অবস্থান পরিবর্তনের ইঙ্গিত প্রদান করে না। যেমন এখানে বলা আছে: বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংরক্ষণ ও মর্যাদা সমুন্নত রাখা হবে। সংরক্ষণ করা হয় ইতিমধ্যে অর্জিত বিষয়কে। প্রশ্ন আসে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কি ইতিমধ্যে অর্জিত হয়ে গেছে? আবার ২০০৮ সালের ইশতেহারে সুস্পষ্টভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিচারের প্রতিশ্রুতি দিলেও আওয়ামী লীগ এবার এ নিয়ে কিছু বলেনি। সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও মাদক দমনের কথা বলে দলটির শাসনামলে এ ধরনের প্রচুর হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। এবার ইশতেহারে বরং এসবের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স অব্যাহত রাখার কথা বলে হয়েছে।

৩.
ইশতেহার নিয়ে ভবিষ্যতে আরও আলোচনা হয়তো হবে। হয়তো আরও বাদানুবাদও। কিন্তু ইশতেহার নিয়ে এসব আলোচনা আরও অর্থবহ হতো দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ থাকলে, দুই পক্ষের অংশগ্রহণের সমান সুযোগ থাকলে। এমন অবস্থা এখনো দেশে তৈরি হয়নি। ইতিমধ্যে উচ্চ আদালতের মাধ্যমে সাত-আটটি আসনে ঐক্যজোটের প্রার্থিতা বাতিল হয়েছে, গ্রেপ্তারকৃত প্রায় ১৪ জন প্রার্থীও জামিন নামঞ্জুর হওয়ায় বন্দী হয়ে আছেন। ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপির প্রার্থিতা বাতিল ও বন্দী হওয়ার সংখ্যা আরও বাড়তে পারে, উল্লেখযোগ্য আসনে নির্বাচন হতে পারে সম্পূর্ণ একতরফা। বাকি আসনগুলোতে বিরোধী দলের প্রার্থী ও তাদের কর্মীদের ওপর হামলা, হুমকি ও গ্রেপ্তার আতঙ্ক অব্যাহত রয়েছে। প্রশাসন ও পুলিশের একপেশে ভূমিকার কারণে অনেক এলাকায় এসব প্রার্থীর কোনো পোস্টার পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।

নির্বাচন এমন একতরফা হলে ইশতেহার বাস্তবায়নের সুযোগ থাকবে কেবল একটি দলের। কিন্তু একতরফা নির্বাচনে সংসদে কার্যকর বিরোধী দল থাকে না বলে সেই তাগিদও চলে যায় একতরফাভাবে জিতে আসা দলটির। আমাদের সবার সবচেয়ে বড় ইশতেহার তাই হওয়া উচিত সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অবাধভাবে আগামী নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত করা।

আসিফ নজরুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক