ইশতেহারের প্রতিশ্রুতি ও পাতালরেল

শুধু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নয়, প্রতিটি বড় দল বা জোটের নির্বাচনী ইশতেহারে উন্নয়ন প্রশ্নে কিছু ‘কমন’ বা সমজাতীয় প্রতিশ্রুতি থাকা উচিত ছিল। কারণ, উন্নয়নের কোনো দলীয় জাত নেই। ক্ষমতায় গেলে রাজন্যবর্গ প্রতিশ্রুতি কতটা রাখেন, সেটা বাঙালির অজানা নয়। কিন্তু এই তথ্য জানার যুগে সম্ভাব্য শাসকেরাও কোনো ওয়াদা করার আগে তিনবার ভাবেন—পরে মানুষ তো বলতে ছাড়বে না। তাই সব দলই ইশতেহার তৈরির আগে যথেষ্ট ‘হোমওয়ার্ক’ করছে। এটা ভালো দিক। শূন্যে ওড়া পাখির মতো একজন প্রবাসী বাঙালির চোখ দিয়ে যে বাংলাদেশকে দেখি, সেখানে অপার সম্ভাবনা যেমন সত্য, তেমনি সত্য এই সম্ভাবনাগুলো নস্যাৎ হয়ে যাওয়ার দুরাশা। এ ক্ষেত্রে নির্বাচনী কথায় তিনটি বিষয়ের ওপর নজর দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই: অবকাঠামো, সামর্থ্যমূলক (উদ্ভট নয়) স্বচ্ছ পরিকল্পনা এবং সবশেষে নীতি ও প্রতিষ্ঠানগুলো (এককথায় ইনস্টিটিউশনস) ঠিক করা। রাজনৈতিক ভাষণের অর্ধেকজুড়ে রাস্তাঘাট ও সেতুর কথা থাকলেও এই অঞ্চলে বাংলাদেশই অবকাঠামোর পেছনে সবচেয়ে কম খরচ করে। এ দেশে এটি মোট জাতীয় আয় বা জিডিপির ২ দশমিক ৮ শতাংশ, যা ভারতে ৫ শতাংশ ও ভিয়েতনামে ১০ শতাংশ।

আমাদের খরচের আবার অর্ধেক পয়মাল হয়। রাস্তা নির্মাণে মাইলপ্রতি খরচে আমরাই আজ চ্যাম্পিয়ন। পদ্মা সেতু নির্মাণেও তার বাতাস লেগেছে। তবে পদ্মা সেতু নির্মাণে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর এগিয়ে যাওয়ার দৃঢ়তা ও দুঃসাহস আমাদের শিখিয়েছে—শুধু উন্নয়নের নামে বাজেটের এক-তৃতীয়াংশ খরচ করাই বড় কথা নয়। তার চেয়েও বড় কথা অবকাঠামোর অগ্রাধিকার ঠিক করা। ‘পদ্মা’ নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার পর ‘বড় মাপের নির্মাণ’ চিন্তায় একটা শূন্যতা দেখা দিয়েছে। নির্বাচনী প্রতিজ্ঞায় অন্তত একটি প্রকল্প যদি স্থান পাওয়ার থাকে, তাহলে তা হওয়া উচিত ছিল ঢাকার জন্য পাতালরেল। এটি ছাড়া কোনোভাবেই বাঁচানো যাবে না এই দুঃসহ রাজধানীকে।

পুলিশ রাস্তা যানমুক্ত করে দেওয়ায় ঢাকা কারও জন্য হয়তো তিলোত্তমা। কিন্তু তাঁরাও ফুসফুসের রোগ থেকে মুক্তি পাবেন না। বাকি দুই কোটি মানুষের কী হবে? দেশের অর্থনীতিতে ঢাকার অবদান এক-তৃতীয়াংশের বেশি। ওই এক-তৃতীয়াংশ আবার বাকি দুই-তৃতীয়াংশের নির্ধারক—ঠিক যেমন স্বল্প আয়তনের মগজ পুরো শরীরটা চালায়। ভবিষ্যৎ আরও ভয়ানক। কারণ, ১০ বছরের বিচারে ঢাকার জন প্রবৃদ্ধি ৫০ শতাংশের বেশি, যা বিশ্বে রেকর্ড। গিনেস বুকে আমাদের আরেকটি রেকর্ড উঠল বলে! সেটি হলো, এত জনগোষ্ঠীর এক দ্রুত বর্ধমান মহানগরে পাতালরেল নেই। এর সমান্তরাল কোনো দৃষ্টান্ত ইহ ধরাধামে নেই।

কলকাতার কর্তারা মাটির নিচ দিয়ে যাত্রী চলাচলের স্বপ্ন দেখেছেন ৫০ বছর আগে। আজ ওই পাতালরেলই কলকাতার রক্ত সঞ্চালনব্যবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাঁচিয়ে রেখেছে কোটি নগরবাসীকে। একই বাঙালি হয়ে আমরা বোধ হয় স্বপ্ন দেখতেও জানি না। স্বপ্ন যে একেবারে দেখছি না, তা ঠিক নয়। আপাতত মেট্রোরেল আমাদের নেতা ও ভাবুকদের চোখে ঠুলি পরিয়ে রেখেছে। দুধের স্বাদ ঘোলে মিটবে না। প্রথম প্রথম এটি যাত্রীচাপ কিছু কমাবে। তারপর এর অবস্থা হবে অকার্যকর ফ্লাইওভারগুলোর মতো। পৃথিবীর জনবহুল আধুনিক মহানগরগুলোতে যখন ‘সাবফেস ট্রেন’ বাতিল হয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখন আমরা এক ‘ব্যাকডেটেড প্রজেক্ট’ নিয়ে মাতামাতি করছি। ভাবছি না যে এটি নানা দিকে দ্রুত বর্ধনযোগ্য নয়।

ইতিমধ্যে ‘ক্ষমতাধরদের আপত্তি’ ও মামলার ভয়ে সামান্য একটি মেট্রো লাইন বানাতে কয়েকবার রুট পরিবর্তন করা হয়েছে। পাতালরেলে সে সমস্যা নেই। সেখানে ভূমিদস্যুরা এখনো ঢোকেনি, পুরোটাই সরকারের। মাকড়সার জালের মতো সব দিকে ‘সাবওয়ে মেট্রো নেটওয়ার্ক’ ছড়িয়ে দেওয়া যাবে এবং ছড়িয়ে দিতে হবেও। এ ছাড়া ঢাকাকে বাঁচানো যাবে না। এখনো বাংলাদেশের ঋণ-জিডিপির অনুপাত ৪০ ভাগের নিচে, দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম। ড. আতিউর রহমান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর থাকার সময় আমার সুযোগ হয়েছিল পাতালরেলের সম্ভাব্যতা নিয়ে একটি সেমিনার আয়োজন করার। এসেছিলেন ক্যালিফোর্নিয়াপ্রবাসী বাঙালি প্রকৌশলীদের কয়েকজন, যাঁদের সাবওয়ে মেট্রো নির্মাণের অভিজ্ঞতা আছে।

ড. আতিউর কথা দিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রীকে রাজি করিয়ে এগিয়ে যাবেন। প্রকৌশলীদের ‘ফিজিবিলিটি স্টাডি’ শুরু করতে বলেছিলেন। দুর্ভাগ্য! তাঁকে যেতে হলো। প্রকৌশলীরা বলেছিলেন, ৪ বিলিয়ন ডলার দিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে মতিঝিল পর্যন্ত একটা প্রাথমিক লাইন করা যায়। ‘পদ্মা’ই তো প্রায় ৪ বিলিয়ন ঠেকাল। ১৩ বিলিয়নের রূপপুরের তুলনায় এ অঙ্ক তো অনেক কম। অথচ পাতালরেল প্রতিবছর অর্থনীতিতে কমপক্ষে ২ বিলিয়ন ডলার যুক্ত করবে, প্রবৃদ্ধি বাড়বে প্রায় ১ শতাংশ। উচ্চ মধ্যম–আয়ের দেশ হতে গেলে প্রবৃদ্ধি না বাড়িয়ে উপায় নেই। আর উন্নত দেশ হতে গেলে প্রবৃদ্ধি ও ন্যায্যতার সব পথ ধরতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রার উচ্চ রিজার্ভ থেকে একবার সার্বভৌম সম্পদ তহবিল বানানোর খেয়াল চাপল অর্থ মন্ত্রণালয়ের। একজন সদস্য হিসেবে প্রস্তাব করলাম যে রাষ্ট্রীয় স্বার্থমূলক একটা বড় কাজে এই তহবিল নিবেদিত হওয়া উচিত এবং তা হোক পাতালরেল। তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আমার বিদায়ঘণ্টা বেজে উঠেছে। ভালো কথা বললেও এ ওর মুখের দিকে চায়। কখনো মুচকি হাসে। কিছুদিন পর শুনলাম তহবিল চিন্তার অকালমৃত্যু হয়েছে। তবে পাতালরেল চিন্তা রয়েই গেল।

এরপর সুযোগ পেলেই টক শো বা সেমিনারে এতবার পাতালরেলের কথা বলেছি যে কেউ কেউ আমাকে কোনো সাবওয়ে কনস্ট্রাকশন ফার্মের এজেন্ট মনে করত। কেউ বলত, ঢাকার মাটি উপযোগী নয়। ভারতে শহরের পর শহরে পাতালরেল নির্মিত হচ্ছে। আধুনিক বোরিং প্রযুক্তিতে ঢাকাবাসীর কষ্ট বরং কলকাতাবাসীর চেয়ে কম হবে। ওখানে ‘ওপেন কাট’ নাগরিকদের দুর্ভোগ দিয়েছে। বোরিং টেকনিক ইঁদুরের মতো তলে তলে খুঁড়ে যায়, দেখাও যায় না।

পাতালরেল বর্তমানে নির্মিতব্য সারফেস মেট্রোর সতিন হবে না—বরং হবে শক্ত পরিপূরক। অজস্র গগনচুম্বী ভবনের আগ্রাসনে একদিন ভূপৃষ্ঠের মেট্রো বন্ধ করে দিতে হবে। পরিবেশ, শব্দদূষণ ও দৃশ্যগত নান্দনিকতার স্বার্থে যেখানে-সেখানে উড়ালসড়ক ও মেট্রোরেল করা যাবে না। এসবের চেয়ে ১০ গুণ শক্তিশালী হয়ে বাড়তে থাকবে পাতালরেল, ছুঁয়ে যাবে আমাদের উন্নত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নকে।

ইতিহাস থেকে যদি সত্যিই শিক্ষা নিতে হয়, তাহলে ঢাকার ইতিহাসও আর দশটি মহানগরীর নির্মাণ ধারাক্রম অনুসরণ করবে। পাতালরেল একদিন হবেই। এখন কোনো দল এটিকে নির্বাচনী প্রতিজ্ঞায় ধারণ করবে, নাকি ক্ষমতায় এসে তা করার উদ্যোগ নেবে, সেটিই আধুনিকতা ও দূরদৃষ্টির বিষয়।

ড. বিরূপাক্ষ পাল স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক অ্যাট কোর্টল্যান্ডের অর্থনীতির অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ