নির্বাচন ও সাংবাদিকতা

নিউইয়র্কভিত্তিক সংস্থা কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস গত বুধবার তাদের ২০১৮ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছর বৈশ্বিক পরিসরে সাংবাদিকদের নিরাপত্তাহীনতার মাত্রা উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গেছে। এ বছর পৃথিবীতে মোট ৫৩ জন সাংবাদিক হত্যার শিকার হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৩৪ জনকে হত্যা করা হয়েছে ‘সিঙ্গেল আউট’ করে, অর্থাৎ বেছে বেছে। এই সাংবাদিকেরা তাঁদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের ফলে প্রতিহিংসার শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। সংখ্যাটি আগের বছরের প্রায় দ্বিগুণ: ২০১৭ সালে ১৮ জন সাংবাদিক প্রতিহিংসাজনিত হত্যার শিকার হয়েছিলেন।

হত্যার ঝুঁকি সাংবাদিকদের নিরাপত্তাহীনতার সর্বোচ্চ মাত্রা। স্বাধীন ও দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার পথে এর চেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা আর নেই। বিশ্বজুড়ে এটাই এখন সংবাদমাধ্যমের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা। দেশে দেশে এই সমস্যার মাত্রাগত তারতম্য আছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, পাকিস্তান–আফগানিস্তানে সাংবাদিকেরা উগ্রপন্থী ধর্মীয় গোষ্ঠীসহ নানা মহলের টার্গেট হয়ে প্রাণ হারাচ্ছেন, দেশ ত্যাগ করতে, এমনকি পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছেন। নিরাপত্তাহীনতার প্রবল ঝুঁকি এমন আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে, যেখানে সাংবাদিকদের ‘স্কেয়ারিং ইনটু সাইলেন্স’ বা ভয় পাইয়ে দিয়ে কণ্ঠ রুদ্ধ করার চেষ্টা চলছে।

বাংলাদেশের পরিস্থিতি সে রকম নয় বটে, তবে এ দেশেও ভয়ভীতি ও প্রভাবের ঊর্ধ্বে থেকে স্বাধীনভাবে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ ও মতামত প্রকাশের পরিবেশের গুরুতর অবনতি ঘটেছে। এ দেশে স্থানীয় পর্যায়ে সাংবাদিকেরা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তি–গোষ্ঠীসহ নানা মহলের ভয়ভীতি ও আক্রমণের শিকার হন। জাতীয় পর্যায়ে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীন ও বস্তুনিষ্ঠ অবস্থানের প্রতি ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালীদের অসহিষ্ণু মনোভাব ক্রমশ বেড়েছে। উপরন্তু তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার ব্যাপক অপব্যবহার ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কয়েকটি ধারায় অত্যন্ত কঠোর বিধান গ্রহণের ফলে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য এমন এক বৈরী পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, যেটাকে ‘স্কেয়ারিং ইনটু সাইলেন্স’ বললে অত্যুক্তি হবে না। সাংবাদিক মহল ও সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলোর একটা অংশের বিরুদ্ধে পক্ষপাতহীন অবস্থান হারানোর যে অভিযোগ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উচ্চারিত হচ্ছে, তার জন্য এই ‘স্কেয়ারিং ইনটু সাইলেন্স’–এর মতো পরিবেশ দায়ী কি না, তা ভেবে দেখা উচিত।

সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য এমন প্রতিকূল পরিবেশে আমরা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। সংবাদপত্র, সরকারি–বেসরকারি বেতার–টিভি ও অনলাইন সংবাদমাধ্যমের মনোযোগের কেন্দ্রে এখন নির্বাচন। ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের প্রচারণাপর্বের অর্ধেকটা ইতিমধ্যে অতিক্রান্ত হয়েছে; স্বাভাবিকভাবেই সংবাদমাধ্যমের অধিকাংশ জায়গা দখল করে আছে নির্বাচন–সম্পর্কিত খবরাখবর, আলোচনা, বিশ্লেষণ ইত্যাদি।

জনসাধারণ সব সময় সংবাদমাধ্যমের বস্তুনিষ্ঠ ও পক্ষপাতহীন ভূমিকা প্রত্যাশা করে; নির্বাচনের সময় এই প্রত্যাশা অনেক বেড়ে যায়। তাই সংবাদমাধ্যমের জন্য এটা একটা বড় পরীক্ষার সময়। পরীক্ষাটা সংবাদমাধ্যমকেই পাস করতে হয়, তবে পরীক্ষায় সে কেমন করবে, তা সম্পূর্ণভাবে তার একার ওপর নির্ভর করে না। ওপরে যে প্রতিকূল পরিবেশের কথা বলা হলো, তার কোনো হেরফের ঘটেনি। তবে নির্বাচনকালে যেহেতু নির্বাচন কমিশনের কর্তৃত্বই প্রধান হয়ে ওঠে, যা সুষ্ঠু, পক্ষপাতহীন ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য অপরিহার্য। তাই আমরা আশা করব, কমিশন নির্বাচনকে সার্থক করার কাজে সংবাদমাধ্যমকে সহযোগী হিসেবে বিবেচনা করবে।

সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে পক্ষপাতহীন ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনের সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলো কোনো না কোনো পক্ষ; শুধু সংবাদমাধ্যমই নিরপেক্ষ। এদিক থেকে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের মিল—উভয়ের লক্ষ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে শতভাগ নিরপেক্ষতা বা পক্ষপাতহীনতা নিশ্চিত করা। তাই নির্বাচন কমিশনকে এমন উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে সংবাদকর্মীরা নির্বাচনকালে পেশাগত দায়িত্ব পালনে সব ধরনের সহযোগিতা পান; পুলিশি বা প্রশাসনিক বাধাবিপত্তির মুখোমুখি না হন।