বন্ধ করা অ্যাকাউন্ট বিষয়ে সরকার কী ব্যবস্থা নেবে

বিভ্রান্তিকর তথ্য এবং ফেক বা ভুয়া নিউজ প্রচার করছে এমন ধরনের সন্দেহের কারণে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের অভ্যন্তরের ৬টি অ্যাকাউন্ট এবং ৯টি পেজ বন্ধ করে দেওয়ার পরপরই টুইটারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ১৫টি টুইটার অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।

বলা হচ্ছে, এসব অ্যাকাউন্ট ‘সমন্বিতভাবে এই প্ল্যাটফর্মকে তাদের স্বার্থে অপব্যবহার করার চেষ্টা করছিল’। উভয় কর্তৃপক্ষ বলেছে, এসব অ্যাকাউন্ট নিয়ে তাদের তদন্ত অব্যাহত আছে। সংখ্যার বিবেচনায় এগুলো অত্যন্ত কম, কিন্তু এগুলোই যে সব আমরা তা কখনোই নিশ্চিত হতে পারব না। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে, উভয় ক্ষেত্রেই এই অ্যাকাউন্টগুলোর পেছনে রাষ্ট্রীয় মদদের কথাই বলা হয়েছে। ইংরেজিতে ব্যবহৃত বিশেষণগুলো হচ্ছে ‘লিঙ্কড টু স্টেট অ্যাক্টরস’ ও ‘স্টেট-স্পনসরড’। এটিকে কেবল কতিপয় অত্যুৎসাহী সরকার সমর্থকের কাজ বলে যে ফেসবুক এবং টুইটার মনে করছে না, সেটা কোনো অবস্থাতেই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই।

কিন্তু সরকার সেই বিষয়ে মনোযোগ না দিয়ে উল্টো ফেসবুক কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্য নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে। বাংলাদেশ পুলিশের সিআইডির সাইবার তদন্ত বিভাগের প্রধান মোল্লা নজরুল ইসলাম বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ফেসবুকের বক্তব্যের সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। এতে করে সরকারের যে দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে ওঠে, তা ইতিবাচক মনে করার কারণ নেই।

গত কয়েক বছরে পৃথিবীজুড়েই গণতন্ত্র এবং সামাজিক মাধ্যমের সম্পর্ক বিষয়ে গবেষণা ও আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। ২০১০ সালে ‘আরব বসন্তের’ সময় এমন ধারণা করা হচ্ছিল যে স্বৈরতান্ত্রিক সরকারগুলোর বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সামাজিক মাধ্যমের ভূমিকা ইতিবাচক। সরকার যখন সব ধরনের গণমাধ্যমের ওপর তার কর্তৃত্ব স্থাপন করেছে, সেই সময়ে সামাজিক মাধ্যমের সূত্রে জনগণ যথাযথ তথ্য লাভ করবে এবং তা গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। গোড়াতে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক আন্দোলনে সেই সম্ভাবনার বাস্তবায়ন হলেও দেশে দেশে তা ক্রমাগতভাবে ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা রক্ষার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। অথবা তা ব্যবহৃত হয়েছে লোকরঞ্জনবাদী বা পপুলিস্ট নেতাদের উত্থানে। ২০১৪ সালে ভারতে নরেন্দ্র মোদির উত্থানে টুইটারের ভূমিকা এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ে সামাজিক মাধ্যমের ভূমিকা স্মরণ করা যেতে পারে।

চীনে এসব মিডিয়ার ওপরে সরকারের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ সর্বজনবিদিত। রাশিয়ায় ২০১৪ সালে সে দেশের সবচেয়ে বড় সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মটি সরকার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। রাশিয়ার নিজস্ব সার্চ ইঞ্জিন ইয়ানডেক্স কেবল সরকারের সাহায্যপুষ্টই নয়, তার সঙ্গে রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার যোগাযোগ আছে। এরাই ইউক্রেনে মিথ্যা প্রচার এবং সাইবার যুদ্ধ চালিয়েছে।

২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের একটা উপায় হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া। এই নিয়ে এখন ব্যাপক তদন্ত চলছে। কিন্তু এই বছরের জানুয়ারি মাসে মার্কিন কংগ্রেসকে দেওয়া তথ্যে মার্ক জাকারবার্গ স্বীকার করেছেন, মার্কিন নির্বাচনের সময়ে রাশিয়ার হয়ে কর্মরত প্রতিষ্ঠানগুলো ট্রাম্পের সমর্থনে ৩ হাজার বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। ক্রেমলিনের সঙ্গে যুক্ত ইন্টারনেট রিসার্চ এজেন্সি নামের একটি প্রতিষ্ঠান যেসব খবর ফেসবুক এবং ইনস্টাগ্রামের সূত্রে ছড়িয়েছিল, তা প্রায় ১৪ কোটি ৬০ লাখ থেকে ১৫ কোটি লোকের কাছে পৌঁছেছিল। এই তথ্যগুলো বলার কারণ হচ্ছে, মার্কিন নির্বাচনের বিবেচনায় ৩ হাজার বিজ্ঞাপন কিছুই না। কিন্তু তা সত্ত্বেও এগুলো জনসাধারণের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে। ফলে সংখ্যাই যে সব সময় নির্ধারক, তা নয়। তদুপরি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে মাত্র ১৫টি অ্যাকাউন্ট এ ধরনের কাজে জড়িত তা মনে করার কারণ নেই, অবস্থাদৃষ্টে তা মনে হয় না। যা গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, তাতে সরকারের মদদ থাকার বিষয়। এটা যে সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য একটা বাধা, তা অস্বীকারের উপায় নেই।

বাংলাদেশে সরকার সমর্থকদের বিভিন্ন ওয়েবসাইট, কথিত নিউজ পোর্টাল এবং ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে বছর কয়েক ধরেই ফেক নিউজ প্রচারের বিভিন্ন উদাহরণ আছে। এসব কথিত নিউজ পোর্টালের বড় ধরনের ভোক্তা বা সেগুলোর আবেদন না থাকলেও সরকারবিরোধী এবং ভিন্ন মতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা প্রচারণা, অবমাননা এবং মানহানিকর বিষয় প্রচারিত হয়, যা সংবাদ হিসেবে ফেসবুক, টুইটার এবং ইনস্টাগ্রামের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। দুর্ভাগ্যজনক যে এ ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটছে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, কোনো ধরনের ভিন্নমতকে শায়েস্তা করা।

এ ধরনের ওয়েবসাইটের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার বদলে সরকার যখনই ব্যবস্থা নিচ্ছে, তখন তার অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিকার হচ্ছে ভিন্নমতের মাধ্যমগুলো। সাম্প্রতিককালেও যখন প্রায় ৫৪টি সাইট বন্ধ করে দেওয়া হয়, তখনো একই প্রবণতা লক্ষণীয়। অতীতে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময়ে ‘গুজব’ ছড়ানোর অভিযোগে অনেককে আটকের ঘটনাও ঘটেছে। সরকার একাদিক্রমে কঠোর আইনের মাধ্যমে সাইবার স্পেসের ওপরে তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে এবং এখন দেখা যাচ্ছে ‘সমন্বিতভাবে এই প্ল্যাটফর্মকে তাদের স্বার্থে অপব্যবহার করার চেষ্টা’র সঙ্গেও যুক্ত আছে। 
নির্বাচনের আগে সামাজিক মাধ্যমের ওপর নজরদারি বাড়ানোর জন্য ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশন একটি মনিটরিং টিম করেছে। তাতে প্রধান হিসেবে রয়েছেন জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম; এ ছাড়া পুলিশের সদর দপ্তর, পুলিশের বিশেষ শাখা, র‍্যাব, বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি), বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এবং ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) থেকে একজন করে প্রতিনিধি এবং নির্বাচন কমিশনের ঊর্ধ্বতন মেইনটেন্যান্স প্রকৌশলী। বলা হচ্ছে, তাঁরা এসব বিষয় দেখবেন। কিন্তু এই টিমে নির্বাচন পর্যবেক্ষক, মানবাধিকার সংগঠন বা কনটেন্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ না থাকায় আসলে তাঁরা কী বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নেবেন, সে নিয়ে সংশয় তৈরি হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, ফেসবুক বা টুইটার কর্তৃপক্ষ যে ধরনের অ্যাকাউন্টের ব্যাপারে মনোযোগ আকর্ষণ করেছে, সেগুলোর ব্যাপারে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে?

লেখক: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর
লেখাটিতে প্রকাশিত বক্তব্য লেখকের নিজস্ব