বিদ্যালয়গুলো কবে সংবেদনশীল হবে

অল্প কদিন আগে বেশ বড় একটা অপারেশন হয়েছে আমার পাঁচ বছর বয়সী শিশুসন্তানের। বিশ্রাম নেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকায় সে স্কুলে যেতে পারছে না। বিষয়টি স্কুল কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। তবু একদিন শ্রেণিশিক্ষিকার ফোন এল। ভাবছিলাম, তিনি নিশ্চয়ই তাঁর ছাত্রের স্বাস্থ্য বিষয়ে জানার জন্য ফোন করেছেন। কিন্তু তিনি বললেন, আগামী দুই দিনের মধ্যেই বাৎসরিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার জন্য নির্ধারিত ফি স্কুলে জমা দিতে হবে। আমি তাঁকে আশ্বস্ত করলাম, নির্ধারিত সময়েই তা করা হবে। তিনি কথা শেষ করলেন, কিন্তু একটিবারও জিজ্ঞেস করলেন না, তাঁর খুদে ছাত্রটি 

কেমন আছে।

মনে পড়ে না, শেষ কবে আমার সন্তানদের সম্পর্কে স্কুল থেকে ইতিবাচক কথা শুনেছি। প্রতিটি প্যারেন্টস মিটিংয়ের আগের রাত যেন আমার কাছে পরীক্ষার আগের রাত। নির্ধারিত দিনে দুরুদুরু বক্ষে হাজির হই স্কুলে। শুনি ওদের নামে একগাদা নতুন অভিযোগের ফিরিস্তি।

ওদের যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো আমাদের চোখে গুণাবলি, অনেক ক্ষেত্রে সেগুলোর জন্যই ওরা অভিযুক্ত। শিশুরা যেন দম দেওয়া কলের পুতুল, কিংবা রোবট শিশু। স্কুলের প্রত্যাশা, রোবট শিশুরা হবে সব ভুলভ্রান্তির ঊর্ধ্বে, ওদের সব আচার-আচরণ হবে পরিমিত ও নিয়ন্ত্রিত। শহরের তথাকথিত ভালো স্কুলগুলোতে খারাপ ছাত্রের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না।

তাইতো অঙ্কে ৮০ শতাংশ নম্বর পাওয়ার পরও কোনো কোনো স্কুলে শিক্ষার্থীকে সি গ্রেড দেওয়া হচ্ছে। চার-পাঁচ বছর বয়সী প্লে কিংবা নার্সারিতে পড়ুয়া শিশুদের খাতায় নির্মমভাবে সিল বসানো হয় ‘ইমপ্রুভ ইয়োর হ্যান্ড রাইটিং’ বা ‘হাতের লেখা ভালো করো।’ এই লেখাটুকু কি শিক্ষকদের হাতে লেখার সময় নেই? স্কুল কর্তৃপক্ষ কি একবারও ভেবে দেখে, এ ধরনের সিল চিরস্থায়ীভাবে বসে যায় শিশুর মনোজগতে।

বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় শিশুর আত্মবিশ্বাস ব্যাহত হচ্ছে। তাদের জীবন স্কুলগুলোর প্রত্যাশার ভারে জর্জরিত। সব সময় ভালো ফলাফল করার এই দৌড়ে শিশুদের নাভিশ্বাস। যে শিশুরা এই দৌড়ে পিছিয়ে পড়ছে, তাদের আত্মবিশ্বাস ও সৃজনশীলতা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সন্তানকে প্রতি মুহূর্তে হতাশায় ডুবতে দেখে অনেক অভিভাবক তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারছেন না। তাঁরাও ছুটছেন এবং সন্তানদের হতাশা তাঁদের মধ্যেও সংক্রমিত হচ্ছে। 

শিখতে না পারার দায়ভার শিশুদের ওপর চাপানো সহজ। কিন্তু শেখাতে না পারার দায় স্কুল কর্তৃপক্ষ নেবে না কেন? প্রতিটি শিশু তার শিক্ষককে বিশ্বাস করে, শিক্ষকের যুক্তি বিনা শর্তে মেনে নেয়। শিশুরা শিক্ষককেই রোল মডেল হিসেবে ভাবতে ভালোবাসে। কিন্তু এখন শিক্ষকেরা সেই অবস্থান ধরে রাখতে পারছেন না।

এডুকেশন ওয়াচ রিপোর্ট–২০১৭-এ স্পষ্টভাবে বেরিয়ে এসেছে, দেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থী নৈতিকতার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব বলে মনে করে না। আরও মজার তথ্যটি হলো, প্রায় অর্ধেক শিক্ষক নিজেরাও নিজেদের অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব বলে মনে করেন না। বিশেষ করে, প্রতি মাসে কাঁড়ি কাঁড়ি টিউশন ফি নেওয়া শহরের স্কুলগুলো শিশু শিক্ষার্থীদের জন্য আর আনন্দদায়ক শিক্ষালয় থাকছে না, মানসিক চাপ ও পীড়নের ক্ষেত্র হয়ে উঠছে। এসব স্কুল কর্তৃপক্ষের উচিত শিক্ষকদের গুণগত মানোন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।

গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা বলতে নির্ভুল ইংরেজিতে দ্রুত কথা বলতে পারা পোষ মানা তোতাপাখিকে বোঝায় না। বরং শিক্ষা বলতে বোঝায়, প্রাণের উজ্জীবন, যেখানে শিশুরা হাসবে, গাইবে, কথা বলবে নির্ভয়ে। সত্যিকারের শিক্ষা কখনো শিশুর মনোজগতে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করে না। যেসব স্কুলের পরিবেশ শিশুশিক্ষার্থীদের জন্য আনন্দদায়ক নয়, বরং ভীতিকর ও মানসিক চাপযুক্ত, ভিকারুননিসা নূন স্কুলের শিক্ষার্থী অরিত্রী আত্মহননের মধ্য দিয়ে তাদের বলে গেছে: আপনারা যা করছেন, তা ভুল।

চরম অপমানবোধ আর হতাশা থেকে অরিত্রী ওই পথ বেছে নিয়েছে। আর কোনো শিক্ষার্থী যেন তা না করে, সে জন্য সব বিদ্যালয় ও শিক্ষক-শিক্ষিকাকে স্নেহ–মমতার সঙ্গে শিক্ষাদানের পন্থা অবলম্বন করতে হবে। শিশুদের কাছে মানবিক সংবেদনশীলতার বিকল্প নেই। তাদের কাছে স্নেহশীল শিক্ষকের চেয়ে বড় মানুষ আর হয় না। 

নিশাত সুলতানা লেখক ও গবেষক