ফাদার ফ্রান্সেসকো: বাংলার বুকে প্রথম খ্রিষ্ট-শহীদ

বড়দিনের সাজে চট্টগ্রামের ক্যাথিড্রাল গির্জা।  ছবি: সৌরভ দাশ
বড়দিনের সাজে চট্টগ্রামের ক্যাথিড্রাল গির্জা। ছবি: সৌরভ দাশ

খ্রিষ্টধর্ম এ দেশে অলৌকিকভাবে গেড়ে বসেনি। যেভাবে দেশে দেশে ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তি বহু রক্তাক্ত মাটি খুঁড়ে তবেই শিকড় ছড়িয়েছে, ঠিক সেভাবেই ভারতবর্ষে খ্রিষ্টধর্মপন্থীদের বিস্তারও বহু ধর্ম-শহীদের রক্তাক্ত ক্রুশের ওপরই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

ষোড়শ শতাব্দীর শুরুর দিকে ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে বহু পর্তুগিজ বণিক  চট্টগ্রামে এসেছিলেন।  তখনকার সেই ব্যবসায়ীদের অনেকেই খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী ছিলেন। কিন্তু পর্তুগিজ সেই সব খ্রিষ্টান তখন বাংলাদেশে প্রথম এলেও, তাঁরা কিন্তু এখানে খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের জন্য আসেননি।

১৫৯৮ খ্রিষ্টাব্দে স্পেনের ধর্মযাজক ফাদার ফ্রান্সেসকো ফার্নান্দেজ ও ফাদার দোমিঙ্গো দ্য সুজা এই দুজন মিশনারি পশ্চিমবঙ্গের হুগলি থেকে খ্রিষ্টের ঐশী বাণী প্রচারের জন্য বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও দিয়াঙে অবতরণ করেন। তখন  চট্টগ্রামের সব শাসনব্যবস্থা আরাকান রাজ্যের অধীনে ছিল। তাই চট্টগ্রামে এসেই তাঁরা আরাকানের রাজদরবারে হাজির হন এ দেশে খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের আরজি নিয়ে। রাজা আনন্দচিত্তে এই রাজ্যে তাঁদের খ্রিষ্টবাণী প্রচারের অনুমতি দেন। গির্জা নির্মাণের জন্য জমি ও প্রয়োজনীয় অর্থও দান করেন। রাজানুকূল্যে তখন ফাদার ফ্রান্সেসকো ১৬০১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে দিয়াঙ, ব্যান্ডেল ও জামালখানে একটি করে গির্জা নির্মাণ করেন। এরও আগে তখনকার বারো ভূঁইয়াদের অন্যতম যশোর-চান্দিনার রাজা প্রতাপাদিত্যের আমন্ত্রণে ওই এলাকায় খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ঈশ্বরীপুরে ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দের ১ জানুয়ারি বাংলাদেশের প্রথম গির্জাও ফাদার ফ্রান্সেসকোর তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয়। এভাবেই বাংলাদেশের খ্রিষ্টমণ্ডলীর ইতিহাস-ঐতিহ্যের সৃষ্টি হয়েছে ফাদার ফ্রান্সেসকোর উদ্যোগে। আর উভয় বাংলায় খ্রিষ্টের সম্মান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বহু পর্তুগিজ বণিকের আগমনে।

কিন্তু ১৬০২ খ্রিষ্টাব্দে সন্দ্বীপের ঐতিহ্য দখল ও আধিপত্য বিস্তারের জন্য আরাকানি সৈন্য ও পর্তুগিজদের মধ্যে এক যুদ্ধ বাধে। ওই বছরের ৮ নভেম্বরের যুদ্ধে আরাকানি সৈন্যরা স্থানীয় খ্রিষ্টানদের ওপর অত্যাচার চালায় ও তাদের ঘরবাড়ি এবং গির্জায় আগুন দেয়।  তারা সেখানকার বহু শিশুকে ক্রীতদাস হিসেবে ব্যবহারের জন্য বন্দী করে নিয়ে যেতে চাইলে ফাদার ফ্রান্সেসকো তাতে বাধা দেন। ক্ষুব্ধ সৈন্যরা তখন শিশুদের সঙ্গে তাঁকেও বন্দী করে নিয়ে যায়। এরপর আরাকান দরবারের অন্ধকার কারাগারে তাঁকে নিষ্ঠুরভাবে লাথি, চড়-থাপ্পড় ও চাবুক মেরে  এবং শরীরে জ্বলন্ত লোহার ছ্যাঁকা দিয়ে সর্বাঙ্গ ক্ষতবিক্ষত করে একটি চোখ উপড়ে ফেলা হয়। এমন সব ভয়াবহ নিপীড়নের পর ফাদারের হাতে-পায়ে-গলায় লোহার কড়া পরিয়ে, শেষমেশ তাঁকে একটি  কূপে নিক্ষেপ করা হয়। প্রতিদিনের অমানবিক নির্যাতন আর অনাহারের অসহনীয় যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে সেখানে চার দিন পর তাঁর মৃত্যু হয় তাঁর। এভাবেই এ দেশে খ্রিষ্টধর্ম ও ঈশ্বরের বিশ্বাস প্রতিষ্ঠার জন্য প্রথম একজন গির্জার পাল-পুরোহিতকে জীবন দিতে হয়েছে। তিনিই এ দেশের প্রথম মিশনারি ধর্ম-শহীদ ।

ফাদার ফ্রান্সেসকো ফার্নান্দেজ ১৫৫০ খ্রিষ্টাব্দে স্পেনের তলেদো শহরের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা-মাতা ছিলেন সেই অঞ্চলের ধনী ও অভিজাত খ্রিষ্টভক্ত। প্রায় শৈশব থেকেই ফ্রান্সেসকো ছিলেন সহজ-সরল ধর্ম–অন্তঃপ্রাণ তপস্বী। বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজ দেশের প্লাসেন্সিয়ার সেমিনারিতে ধর্মতত্ত্ব ও সুসমাচার পাঠের মাধ্যমে  মিশনারি হয়ে খ্রিষ্টের বাণী প্রচারের নিমিত্তে উন্নত আদর্শের পথ খুঁজে পান। এরপর ১৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে মাত্র ২০ বছর বয়সে তিনি স্পেনের আলকালাতে জেসুইট ধর্মসংঘের নবিসিয়েটে প্রবেশ করেন এবং  সেই সংঘের একজন সন্ন্যাসব্রতী হন।

এভাবেই ফ্রান্সেসকো নিজেকে ঈশ্বরের উদ্দেশে নিবেদিত হওয়ার লক্ষ্যে প্রথমেই তিনি ভারতবর্ষে মিশনারি হয়ে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। এরপর তাঁর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জেসুইট সংঘের সুপিরিয়র সভার সিদ্ধান্তে তিনি ১৫৭৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম ভারতের গোয়া অঞ্চলে মিশনারি কাজের জন্য আসেন। 

এরপর তিনি সহকারী ফাদার দোমিঙ্গোকে সঙ্গে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের হুগলি বন্দরে যান। তারপর যান পূর্ব বাংলার দিয়াঙ ও চট্টগ্রামে।

আরাকানি সৈন্যদের হাতে মৃত্যুর পর তখন তাঁরই সঙ্গে বন্দী আরেক সঙ্গী ফাদার আন্দ্রে বভ আরাকান অধিপতির কাছ থেকে ফাদার ফ্রান্সেসকোর শবদেহ আনার অনুমতি পেয়ে তাঁকে চট্টগ্রামে নিয়ে আসেন । এখানে তাঁরই হাতে নির্মিত প্রথম গির্জার ধ্বংসস্তূপের মাটিতে, বাংলার বুকে প্রথম খ্রিষ্ট-শহীদ হিসেবে ফাদার ফ্রান্সেসকোর মৃতদেহ সমাহিত করা হয়। পরে  কর্ণফুলীর তীরে বিধ্বস্ত সেই গির্জাস্থলেই নির্মাণ করা হয় ‘জপমালা রানির গির্জা’। বর্তমানে চট্টগ্রামে এটি ‘ক্যাথিড্রাল গির্জা’ হিসেবে অধিক পরিচিত।  এখানেই রয়েছে বাংলার ক্যাথলিক খ্রিষ্টমণ্ডলীর প্রথম খ্রিষ্ট-শহীদ ফাদার ফ্রান্সেসকো ফার্নান্দেজের স্মৃতিসৌধ।

হেনরী স্বপন, কবি ও সম্পাদক, জীবনানন্দ