আমার বড়দিনের উৎসব

শিল্পীর কল্পনায় মা মেরির কোলে শিশু িযশু। ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
শিল্পীর কল্পনায় মা মেরির কোলে শিশু িযশু। ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

২৫ ডিসেম্বরের দিনটা আসলে দৈর্ঘ্যে ততটা বড় নয়, বরং রাতটাই বেশ দীর্ঘ ও বড়। কিন্তু বাংলাদেশের খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীরা এই দিনকে ‘বড়দিন’ বলে; তার কারণ এই দিনে যিশুখ্রিষ্ট জন্ম নিয়েছিলেন। তাই যিশুর দর্শনে বিশ্বাসী মানুষের কাছে এটি বিশেষ দিন ও বড়দিন। যিশু ধ্যান ও সাধনার মধ্য দিয়ে মানবমুক্তির বার্তা দিয়েছেন। পবিত্র গ্রন্থ বাইবেলে তাঁর একটি কথা আমাকে বেশ অনুপ্রাণিত করছে, তা হলো, ‘তোমার এক গালে কেউ যদি চড় মারে অন্য গালটি পাতিয়া দিয়ো।’ তিনি যুদ্ধবিরোধী ও শান্তিপ্রিয় মানুষ ছিলেন। মানুষের সকল কষ্টের মুক্তির পথ দেখিয়েছেন প্রেম ও অহিংসার মধ্য দিয়ে।  অহিংসার প্রমাণ দিয়েছেন ক্রুশবিদ্ধ হয়ে। যিশুর জীবন পৃথিবীর জন্য, মানুষের জন্য একটি বার্তা। তাই যিশু আমার কাছে ‘শান্তির চেতনা’। এমন একজন মানুষের জন্মতিথিতে তাঁকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

আমার শৈশবের সবচেয়ে স্মরণীয় বড়দিন কেটেছে আমি যখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি। বাংলাদেশ টেলিভিশনে বড়দিন উপলক্ষে একটি নাটকে আমার অভিনয়ের সুযোগ হয়। মায়ের হাত ধরে বিটিভিতে যাই আর পা ফেলি অভিনয়জীবনে। জীবনে প্রথমবার ক্যামেরার সামনে দাঁড়াই। আমি ছিলাম নাটকের মূল চরিত্র। সেই বড়দিনে সারা দিন আমার মূল উত্তেজনা ছিল কখন নাটকের সম্প্রচার শুরু হবে। রাতের বেলা পরিবারের সবাই মিলে আমরা নাটকটি দেখলাম। তারপর বেশ কয়েক দিন পর্যন্ত আমাকে বাসার সবাই ওই নাটকের চরিত্রটির নাম ধরে ডাকত। এই স্মৃতি এখনো আমাকে অনেক আনন্দ দেয়। কারণ, ওই বড়দিন থেকেই আমার অভিনয়জীবনের পথচলা শুরু।

ছোটবেলায় বড়দিন মানেই নতুন জামা ও জুতা পরে সকালবেলায় গির্জায় যাওয়া, বাড়ি ফিরে বড়দিনের বিশেষ কেক খাওয়া, ক্রিসমাস ট্রির সামনে রাখা গিফট বক্স কখন খুলব সেই উত্তেজনা। গির্জার অনুষ্ঠানে সান্তা ক্লজ থাকত একটা বিশেষ চমক! যখন সান্তা ক্লজ তাঁর উপহারের ঝুলি নিয়ে ঢুকতেন, আমি বিশ্বাস করতাম সত্যি সত্যিই বোধ হয় আকাশ থেকে তিনি নেমে এসেছেন।

বড়দিনের কারণেই আমার গ্রামের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে। বাবা-মা পরিবারের সঙ্গে একবার বড়দিন করতে গিয়েছিলাম গ্রামের বাড়িতে। শীতকাল, তাই চারদিকে ছিল বড়দিনের উৎসবকে ঘিরে বিভিন্ন পিঠা তৈরির আয়োজন ও সঙ্গে খেজুরের রস, এসবই আমার জন্য ছিল নতুন অভিজ্ঞতা। গ্রামীণ পরিবেশে অন্য ধরনের আমেজে কেটেছে সেবারের বড়দিন।

একটু বড় হওয়ার পর বড়দিন মানেই ছিল কীর্তন গানের প্রস্তুতি। ১০-১২ দিন ধরে চলত রিহার্সাল। ডিসেম্বরের ২৩ ও ২৪ তারিখ রাতে আমরা সবাই মিলে বাসে করে ঘুরে ঘুরে এর বাড়ি, তার বাড়ি যেতাম। প্রায় সব বাড়িতে রাত জেগে গাওয়া হতো কীর্তন গান, চলত ভোর অবধি। গান পরিবেশনের পরে হইচই করে প্রতিটি বাড়িতে হতো খাওয়াদাওয়া—সে এক মহা আনন্দ উৎসব।

বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়ি, আমার সব বন্ধু গির্জায় যাওয়ার বায়না ধরত। তখন বন্ধুদের নিয়ে ২৪ ডিসেম্বর রাত ১১টায় হাজির হয়ে যেতাম গির্জায়, বেশির ভাগ বন্ধু ভিন্ন ধর্মাবলম্বী তাই ওরা খুব আগ্রহ আর কৌতূহল নিয়ে বড়দিনের আচার-অনুষ্ঠান দেখত। বন্ধুদের এই আগ্রহ আর উদ্দীপনা আমার খুব ভালো লাগত। আসলেই ধর্ম যার যার কিন্তু উৎসব সবার।

চার-পাঁচ বছর ধরে আমি এই উৎসবগুলো খুব মিস করছি। শুটিং আর কাজের ব্যস্ততায় এখন আর সেই আগের মতো এত কিছু করা হয়ে ওঠে না। দেখা যায় বড়দিনের দিনও শুটিং করতে হচ্ছে। তবে এবারের বড়দিন আমি কাটাব আমার তিন বোনের সঙ্গে। সঙ্গে থাকবে আমার একমাত্র ভাগনে।

যিশু শান্তি ও নিরাময়ের বার্তা নিয়ে এসেছিলেন এই জগতে। সহনশীলতা ও গ্রহণ করার ক্ষমতা ভালোবাসার আরেক নাম। এই সময়টায় জগতের জন্য শান্তি ও নিরাময় অনেক বেশি প্রয়োজনীয়, তাই এই বড়দিনে আমি জগতের সব মানুষের, সব প্রাণের, সব আত্মার শান্তি ও নিরাময় প্রার্থনা করি। সবাইকে শান্তিময় বড়দিনের শুভেচ্ছা।

দীপান্বিতা মার্টিন, অভিনয়শিল্পী