আও (প্রতিবাদ) করার কাইও নাই বাহে!

দেশে ভোট হোক আর না হোক—সরকার হয়, এমপি হয়। নয়া নয়া রাজা হয়। অবৈধ বালুমহালের মালিক বদল হয়, হাটঘাটের নয়া ইজারাদার হয়, স্কুল-কলেজ কমিটির সভাপতি বদলায়, নয়া নয়া দেওয়ানি-মাতব্বর হয় আর জনগণের ওপর নিত্যনতুন জুলুম কায়েম হয়। কিন্তু ব্রহ্মপুত্রের বাণ্ডালের চরের মমেনা বেটির বেটি-জামাই আর ফেরে না। বাঁশপাতা চরের কৃষক বাদশা মিয়ার ২ মণ পাট চিলমারীর হাটে দেড় মণ হয়ে যায় ঠিকই। হাট খাজনা, ঘাট খাজনা বছর বছর বাড়তেই থাকে। কুড়িগ্রাম-রংপুর-লালমনিরহাটের রাস্তার মোড়ে মোড়ে অটো-রিকশা-জেএসের টোল—পৌরসভা, সিটি করপোরেশন ও সমিতিগুলোকে দিতে দিতে জনগণ অস্থির। বুকের বেদনা বুকে বলক দিয়ে উঠে বুকেই নিভে যায়। আরেক দিকে দেশে ভোট ছাড়া সরকার হয় বলে মনে হয়, দেশ থেকে জনগণের নাম কাটা গেছে।

ব্রহ্মপুত্রের ডান তীর ধরে কাইম এলাকায় বিশাল বিশাল লুটের বালুর পাহাড়। রাস্তায় ধুলা উড়িয়ে সেই বালু শত শত ট্রাকে জেলায় জেলায় চলে যায়, ড্রেজার মেশিনের ঘড়ঘড় শব্দে চর ভেঙে মুহূর্তে নাই হয়ে যায়, কৃষক জমি হারায়, মাছ-কাছিম-পাখি আবাস হারায়। এই লুটপাটে জড়িত এমপি প্রার্থীদের ভাই-ভাস্তে, কখনো এমপি নিজে। ২০০৯ সালের এমপি তো নির্বাচনে জিতে এসেই চিলমারীর ব্যাঙমারা ঘাটের কিনারেই ড্রেজার বসালেন, আর সেই বছরের বর্ষাতেই কয়েক কিমি এলাকার কয়েকটি গ্রাম নিমেষেই ব্রহ্মপুত্রের পেটে চলে গেল। তারপর শুরু ড্রেজারে বালু তোলার উৎসব। এখন শুধু চিলমারীতেই ৩০ টি ড্রেজারে বালু তোলা হয়। হেন পুকুর-নালা নাই, বালু দিয়ে ভরাট হচ্ছে না। চিলমারীর বাতাসে এখন শুধু বালু আর বালু। স্বাস্থ্যকর স্থান কুড়িগ্রাম এখন বালুময়। অন্যদিকে তেলের দাম বাড়ুক না বাড়ুক, ছয় মাস অন্তর নৌকা ভাড়া বাড়বেই চিলমারী-রৌমারী রুটে। চিলমারী বন্দর চালু হলে ফেরিতে যাতায়াত করতে পারতেন গরিব মানুষেরা, কিন্তু জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মামলা দিয়ে আটকে রেখেছেন বন্দরের কাজ। হাজার হাজার বছর পর জাতিসংঘ স্বীকার করে মানুষেরও অধিকার আছে, কিন্তু দেশের মানুষ বোঝে প্রকৃতির দান নতুন সরকারগুলা কেড়ে নেয়। এমনকি আগে মানুষ রাস্তায় দাঁড়ায়ে কথা বলতে পারত, এখন অনুমতি লাগে। গত বছর নভেম্বরে গণকমিটি কুড়িগ্রামে দারিদ্র্যের অভিশাপ নিয়ে সমাবেশ করতে চেয়েছিল, এ বছর কুড়িগ্রামে ফুলবাড়ী দিবস নিয়া আনু মুহাম্মদকে সভা করতে দেওয়া হয়নি। এত দিনে জনগণ বুঝলেন, সংবিধানে বাক-সভা-সমাবেশের অধিকার নিরঙ্কুশ নয়, আইনের অধীন। আইনের শাসনে ওরা মোদের মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায় আর রংপুরে এরশাদ জনগণের ভোট নিয়া খেলে! কোনো প্রার্থীই ভবিষ্যতের আইনপ্রণেতা হিসেবে আইন নিয়ে আলোচনা করেন না, যেন তাঁরা স্থানীয় সরকারের বড় তরফের প্রতিনিধি ছাড়া অন্য কিছু নন।

টেলিভিশন-পত্রিকার লেখা থেকে এলাকাবাসী জেনেছেন, ব্রহ্মপুত্রের বালুতে ছোট ছোট পাথরের মতো যে টুকরাগুলা দেখা যায়, এগুলো খুব মূল্যবান। আর কাচের মতো চিকচিক করে যেগুলো, তা দিয়ে নাকি কাচ তৈরি করা যায়। তারা ভাবেন, কাচের কারখানা হলেও তো রুটি-রুজির জন্য ঢাকা-চিটাগাং যাওয়া লাগত না বউ-বাচ্চা ফেলে। নদীর কিনারে দাঁড়িয়ে যে আসাম-মেঘালয় রাজ্য দেখা যায়, ফুলবাড়ীর দিকে কোচবিহার; সেখানেও তো মাল রপ্তানি করা যায়। ঢাকা থেকে স্থলপথে ওপাশে রৌমারী পর্যন্ত গ্যাস ও রেললাইন বসিয়ে সাভারের মতো ইপিজেড করে ভারতের তিন রাজ্যে মাল সাপ্লাই দেওয়ার কথা কেউ কল্পনাও করে না। সবাই খালি করিডরের কথা কয়। ভারতের পশ্চিম বাংলা থেকে আসাম বরাবর রাস্তা বানিয়ে বাংলাদেশের কী লাভ, এলাকার মানুষের উপলব্ধিতে আসে না। গত ১০-১৫ বছরে সব সাংসদ করিডর চেয়েছেন, শিল্পায়ন চাননি। নিন্দুকেরা বলেন, আমাদের এমপিরা কি পাশের দেশের সুপারিশে মনোনয়ন পান?

সারা দেশে নাকি গরিব মানুষের সংখ্যা ৩০ ভাগ থেকে ২৪ ভাগ হয়েছে, আর উত্তরে উল্টো ঘটনা ঘটেছে। কুড়িগ্রামে তো ৬৩.৬৭ থেকে ৭০.৮৭ ভাগে আর চিলমারীতে ৭৭ ভাগে বাড়তি হয়েছে। এটা সরকারি প্রতিষ্ঠানেরই রিপোর্ট। আর সেই রিপোর্ট সংসদে তুলে ধরার মতো যাঁরা, তাঁদের কাছেই ঘেঁষা যায় না। কারণ, এই নেতারা ঢাকায় থেকে নির্বাচিত হন। জাতীয় পার্টি না আওয়ামী লীগ; জামায়াত না বিএনপি—কোন দল থেকে সাংসদ হবেন, তাও ঠিক হয় রাজাদের রাজধানীতে। দয়া হলে জনগণকে ভোটটা দিতে দেন, নইলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কেউ একজন হয়ে যান। গতবার জাতীয় পার্টির মরহুম তাজুল চৌধুরী এলাকার লোকজনকে বলেছিলেন, ‘তোমার ভোটত মুই হইচং?’ তার মানে তিনি এলাকার জনগণকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছেন। আর বামপন্থী নামে কাস্তে-হাতুড়ি-মই মার্কার যাঁরা আছেন, তাঁরা নিজেদের ভোটটাও নিজেদের দেন না। রংপুর বিভাগের বেশ কয়েকটি আসনে বাম গণতান্ত্রিক জোটের ২-৩ জন করে প্রার্থী দাঁড়িয়েছেন। চলতি বছর মাদ্রাসার হুজুররা গ্রামে গ্রামে, চরে চরে চাঁদা ওঠান রোহিঙ্গাদের জন্য। কিন্তু মানুষ যখন ট্রেনের জন্য, নদীভাঙন ও বালু তোলা ঠেকানোর জন্য আন্দোলন করেছেন, কর্মসংস্থানের জন্য ইপিজেড, শিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় আর তাপশক্তির সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রের দাবি তুলেছেন; তখন কেউ ছিলেন না জনগণ ছাড়া। বরং একটি ধর্মীয় সংগঠন উলিপুরে ‘চিলমারী টু ঢাকা রুটে ভাওয়াইয়া এক্সপ্রেস চাই’ লেখা দেয়াল লিখন মুছে দিয়ে ‘নেতা নয়, নীতির বদল চাই’ লিখেছে!

ঢাকা থেকে কৃষি উপকরণ কুড়িগ্রাম-গাইবান্ধার চরাঞ্চল পর্যন্ত আসতে আসতে সবচেয়ে বেশি দামে কৃষককে কিনতে হয়। তেমনি কালাই, বাদাম, ভুট্টা ও ধানের দামও বেচার বেলায় সবচেয়ে কম পান তাঁরা। মানে কেনার বেলায়ও চরম ঠকা, বেচার বেলায়ও তা-ই। এদিকে বেচার সময় ওজনে বেশি দেওয়া ও কেনার সময় ওজনে কম পাওয়ার ঘটনা তো আছেই। চিলমারীর প্রতিটি দোকানের জ্বালানি তেলের বাটখারায় এই কারচুপি আছে। ধরার কেউ নাই। এবারে মনোনয়ন ক্রয়ে শীর্ষে ছিল কুড়িগ্রাম জেলা। শুধু আওয়ামী লীগেরই মনোনয়ন কিনেছেন ৫৯ জন। শীর্ষ গরিব জেলা মনোনয়ন ক্রয়ে শীর্ষে থাকা এক আশ্চর্য বৈপরীত্য। এবার রংপুর বিভাগের আসনগুলোতে উল্লেখযোগ্য স্বতন্ত্র প্রার্থী দাঁড়িয়েছেন। তাঁদের মধ্যে চমক জাগিয়েছেন গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার। এলাকার সংকট নিয়ে তিনি ইশতেহারও ঘোষণা করেছেন, কেউ কথা রাখেননি, তিনি কি রাখবেন? চিলমারী নদীবন্দরের রহিম মুন্সীর (৬৫) আক্ষেপ যথার্থই, এত নেতা তাও হামার আও করার কাইও নাই বাহে!

লেখক: সভাপতি, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ, রেল-নৌ যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি।
[email protected]