একজন বড় মাপের নেতার জন্য আক্ষেপ

চট্টগ্রাম–১২ (পটিয়া) নির্বাচনী এলাকায় তিন প্রার্থীর পাশাপাশি ব্যানার
চট্টগ্রাম–১২ (পটিয়া) নির্বাচনী এলাকায় তিন প্রার্থীর পাশাপাশি ব্যানার

দেশের মহকুমা শহরগুলো সব জেলায় উন্নীত হয়েছে। কিন্তু পটিয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঘটেছে ঠিক উল্টো। এককালের শিক্ষা-সংস্কৃতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ দক্ষিণ চট্টগ্রামের এ অঞ্চলটি ক্রমান্বয়ে গুরুত্ব হারিয়েছে। এরশাদ সরকারের আমলে মহকুমা থেকে উপজেলায় নেমে এসেছিল। পরবর্তী কালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এসে উপজেলা পদ্ধতি বাতিল করলে আরও এক ধাপ নেমে একটি থানায় পরিণত হয়েছিল পটিয়া। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে উপজেলা পদ্ধতি পুনঃপ্রবর্তিত হওয়ায় এখন পটিয়া আবার উপজেলার পরিচয় পেয়েছে বটে, কিন্তু এখানকার মানুষের মন থেকে এই ‘অমর্যাদা’র ক্ষোভ ও গ্লানি দূর হয়নি।

পটিয়ার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে এখানকার মানুষের এই গভীর হতাশার কথা জানা গেল। একসময় জেলা বাস্তবায়নের দাবিতে অনেক আন্দোলন–সংগ্রাম হয়েছে। এখন সাধারণ মানুষও যেন বুঝে গেছে এটা আর হওয়ার নয়। তাই নির্বাচন সামনে রেখেও এই দাবি আর জোরালো হয়ে উঠছে না। আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা যে এ বিষয়ে কোনো প্রতিশ্রুতি দেবেন, সেই মুখও তাঁদের নেই। কারণ, অতীতে নানা সময়ে এরশাদ, খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা প্রকাশ্য জনসভায় পটিয়াকে জেলা ঘোষণার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কেউ কথা রাখেননি। তবে শীর্ষ নেতাদের ওপর যতটা না ক্ষোভ, তার চেয়েও মানুষের বেশি আক্ষেপ, পটিয়ায় কখনো নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্রে প্রভাব রাখার মতো গুরুত্বপূর্ণ নেতা গড়ে ওঠেনি। এই নেতৃত্বশূন্যতাই পটিয়ার বঞ্চনার কারণ।

অবশ্য বঞ্চনার বোধ থাকলেও নির্বাচনী উত্তাপ যে সঞ্চারিত হয়েছে মানুষের মনে, তা টের পাওয়া গেল থানার মোড় এলাকার একটি রেস্তোরাঁয় বসে। নির্বাচনের সম্ভাব্য ফলাফল নিয়ে প্রবীণ একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে এক তরুণের বাহাসে রীতিমতো বিতর্ক প্রতিযোগিতার আসর হয়ে উঠল যেন রেস্তোরাঁটি। শ্বেত শ্মশ্রুমণ্ডিত অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী আবদুল মতিন (৭০) বললেন, ‘গত দুই টার্মে শামসুল হক (আওয়ামী লীগের প্রার্থী) যত কাজ করেছেন, আগের ২০ বছরেও তা হয়নি। এবার কনফার্ম নৌকা জিতবে।’

কাউন্টারে বসা সাখাওয়াত হোসেন (২৩) বললেন, ‘উন্নয়ন কী হয়েছে থানার মোড় এলাকাটি দেখলেই তো বোঝা যায়। এক বছর ধরে রাস্তা আর নালা মেরামত চলছে। হাঁটাচলার উপায় নেই, ধুলা উড়ছে সারা দিন, নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়।’

নিজের মত প্রকাশের পাশাপাশি এবার আমাদেরও সাক্ষী মানলেন সাখাওয়াত, ‘আপনারা নিজের চোখে কী দেখলেন?’

স্বীকার করতেই হলো অবস্থাটা সত্যি খুব খারাপ। এবার জনপ্রতিনিধির পক্ষ নিয়েই যেন জবাবদিহি করলেন আবদুল মতিন, ‘এখানকার মার্কেটের ব্যবসায়ীদের মামলার কারণে এই রাস্তার কাজটা সময়মতো শেষ করা যায়নি। তবে গ্রামের ভেতর যান, দেখবেন যেখানে হেঁটে যাওয়ার উপায় ছিল না, সেখানে এখন পাকা রাস্তায় গাড়ি চলছে।’ এবার তরুণের উদ্দেশে পাল্টা প্রশ্ন করলেন মতিন সাহেব, ‘বিএনপির আমলের মতো এখন চুরি-ছিনতাই-চাঁদাবাজি এসব আছে?’

সাখাওয়াত স্বীকার করলেন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। কিন্তু সেখানেও একটা প্রশ্ন আছে তাঁর, ‘চুরি-ছিনতাই-চাঁদাবাজি নেই, তবু লোকজনকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে কেন?’

বুঝলাম এ বিতর্ক সহজে শেষ হওয়ার নয়। গ্রেপ্তার প্রসঙ্গটা যখন এলই, একবার পটিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) সঙ্গে আলাপ করা দরকার ভেবে রওনা দিলাম থানা ভবনের দিকে। মাত্র এক দিন আগে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে পটিয়ায় বিএনপির প্রার্থী এনামুল হক অভিযোগ করেছেন, তাঁর কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, থানায় অভিযোগ করা সত্ত্বেও এর বিহিত করছে না পুলিশ।

থানায় গিয়ে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ নেয়ামতউল্লাহর কাছে জানতে চাইলাম বিএনপি প্রার্থীর অভিযোগ সম্পর্কে। তিনি তাঁর কক্ষের সিসিটিভির মনিটর দেখিয়ে বললেন, ‘এই দেখেন, থানার প্রবেশপথ থেকে শুরু করে আশপাশের এলাকা এই মনিটরে দেখা যায়। আপনি গত তিন মাসের ফুটেজ দেখেন। যেকোনো দিন-তারিখের ফুটেজ দেখেন। যদি দেখাতে পারেন যে এনামুল হক সাহেব বা তাঁর দলের কোনো নেতা-কর্মী থানায় অভিযোগ করতে এসেছিলেন, তাহলে আমি চাকরি ছেড়ে চলে যাব।’

বুঝলাম উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন তরুণ পুলিশ কর্মকর্তা। বললাম, ‘ধরে নিলাম এনাম সাহেব অভিযোগ করতে আসেননি। কিন্তু ধরপাকড় যে চলছে এটা তো ঠিক?’

‘হ্যাঁ। ওনার বাড়ি থেকে ভোর পৌনে চারটায় আন্তজেলা ডাকাত দলের সরদার কুদ্দুসকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এখন এনাম সাহেব অস্বীকার করুক কুদ্দুস ডাকাত দলের সরদার নয়, বলুক কুদ্দুস তাঁর দলের কর্মী। বলতে পারবেন?’

এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা নেই বলে বেরিয়ে এলাম থানা ভবন থেকে। রওনা দিলাম কমল মুন্সীর হাটের দিকে। পথে চোখে পড়ল সুপরিসর একটি বাস টার্মিনাল। কিন্তু পথে পথে এলোপাতাড়ি রাখা হয়েছে বাস, সে তুলনায় বাস টার্মিনাল প্রায় ফাঁকা। এই মুহূর্তে পরিবহন সমস্যা পটিয়ার সবচেয়ে বড় সমস্যা বলে উল্লেখ করলেন সুমন দাশ (৩৮) নামের একজন ব্যবসায়ী। তাঁর মতে, শহর থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটারের দূরত্ব হলেও দুবার গাড়ি বদলাতে হয়, সরাসরি যাতায়াতের জন্য গণপরিবহন নেই। দ্বিতীয় কর্ণফুলী সেতুর এপার পর্যন্ত গণপরিবহনের চলাচল। সংখ্যাও অপ্রতুল। এখানকার বাস মালিক সমিতির কারণে অনেক চেষ্টা করেও সরাসরি গণপরিবহন চালু করা যায়নি। বাস মালিক সমিতির নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন আছেন বলেই সাধারণ যাত্রীরা তাঁদের কাছে জিম্মি বলে মন্তব্য করলেন সুমন।

কমল মুন্সীর হাটে গিয়ে মাত্র ৫০ গজের ব্যবধানে নৌকা ও ধানের শীষ প্রার্থীর দুটি নির্বাচনী ক্যাম্প দেখা গেল। কিন্তু নৌকার ক্যাম্পটি সাজানো–গোছানো, ধানের শীষের ক্যাম্পটি ভাঙা। এ ক্যাম্পটি কারা ভাঙল, জানতে চাইলে ডেকোরেটর প্রতিষ্ঠানের মালিক মফিজুর রহমান (৫৫) বললেন, ‘গভীর রাতে কে বা কারা এসে ভেঙে দিয়েছে, আমরা জানি না। আপনারা বুঝে নেন।’ বুঝে নিয়ে আমরা আবার রওনা দিলাম পটিয়া রেলস্টেশনের দিকে। সেখানে যাত্রীর জন্য অপেক্ষমাণ বেশ কয়েকজন অটোরিকশাচালকের সঙ্গে আলাপ হলো। চালকদের একজন আজিজুর রহমান (৩৫) বললেন, ‘পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ। এই দ্যাখেন দুইজনের ব্যানার পাশাপাশি ঝুলছে।’

রেলস্টেশনে ঢোকার মুখে পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রার্থীর দুটি ব্যানার দেখা গেল। এই দুজনের মধ্যে কে জিতবেন—জানতে চাইলে আজিজুর রহমান উত্তর দিতে নারাজ। বেলায়েত হোসেন (৫৪) নামের একজন চালককে তুলনামূলক বুদ্ধিমান মনে হলো। তিনি বললেন, ‘আমাদের বর্তমান এমপি (আওয়ামী লীগ প্রার্থী) বিপদে-আপদে পাশে থাকেন। আবার এনাম সাহেব (বিএনপির প্রার্থী) দলের জন্য অনেক খেটেছেন, মাঠে পড়ে আছেন অনেক দিন ধরে। দুজনই ভালো। তবে ধানের শীষ জিতবে বলে মনে হয়।’

রেলস্টেশনের পাশেই চায়ের দোকান নজরুল ইসলামের (৪৫)। তিনি বললেন, ‘নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ আছে। মারামারি-কাটাকাটি নেই। ইসলামী ফ্রন্টের প্রার্থী এম এ মতিনের সঙ্গে বিএনপির প্রার্থীর ভোট ভাগাভাগি হবে। নৌকা জিতে যাবে।’

থানার মোড়েই দেখা হয়ে গেল দক্ষিণ জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি শামসুল আলম মাস্টারের সঙ্গে। তাঁর গাড়িতে নৌকা প্রতীকের পোস্টার দেখে বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলাম, ‘এ আসনে আপনাদের প্রার্থী আছে, আপনি লাঙ্গল বাদ দিয়ে নৌকার পক্ষে কাজ করছেন?’ শামসুল আলম বললেন, ‘এখানে আমরা মহাজোট প্রার্থীর পক্ষে। নুরুচ্ছাফা তালুকদারকে (লাঙ্গল) এখানে অবাঞ্ছিত করা হয়েছে। আমরা কেন্দ্রীয় নেতাদের এ কথা জানিয়ে দিয়েছি।’

শহরে ফেরার সময় পথে পথে দেখা গেল বিভিন্ন প্রার্থীর পক্ষে মাইকিং চলছে। নির্বাচনী ক্যাম্পগুলোও জমজমাট। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ বা বিএনপির প্রার্থীর মধ্যে জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। যে কেউ একজন বিজয়ী হবেন। কিন্তু একজন বড় মাপের নেতার জন্য এলাকাবাসীর আক্ষেপটা বোধ হয় থেকেই গেল। পটিয়া কি ফিরে পাবে তার হৃত গৌরব?

বিশ্বজিৎ চৌধুরী প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি ও সাহিত্যিক