শক্তির প্রয়োগ নৈতিক বৈধতা দিতে পারে না

আলী রীয়াজ
আলী রীয়াজ

আগামীকাল নির্বাচন। প্রশ্ন হচ্ছে, কী ধরনের নির্বাচন হবে আগামীকাল? এই নির্বাচন অভূতপূর্ব নির্বাচনের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে বিভিন্ন কারণে: এই প্রথম ক্ষমতাসীন দল ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতাসীন হওয়ার জন্য প্রার্থী হয়েছেন; প্রায় চার দশকে এই প্রথমবারের মতো কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হচ্ছে, যেখানে সব রাজনৈতিক দল অংশ নিচ্ছে; সমাজের বিভিন্ন স্তরে ছড়িয়েছে ভীতি, আর এই আশঙ্কা সর্বব্যাপ্ত যে আদৌ ভোটাররা নির্ভয়ে ভোট দিতে পারবেন কি না। অথচ কোনো দেশ যখন নিজেকে গণতান্ত্রিক বলে দাবি করে, তখন নাগরিকদের এই মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তাকে বিবেচনা করা হয় ন্যূনতম বলে। এর বাইরেও আছে আরও অনেক নতুন বৈশিষ্ট্য: এমন সব জোট তৈরি হয়েছে, যা প্রচলিত ধারণার বাইরে; কোনো কোনো রাজনীতিবিদ আপাতত হলেও চোখের আড়ালে চলে গেছেন; সর্বাধিকসংখ্যক নতুন ভোটার এখন ভোটার তালিকাভুক্ত। এসব ছাড়াও আছে বিরোধী প্রার্থী ও নেতা-কর্মী-সমর্থকদের ওপর নির্যাতন, তাঁদের কারাবন্দিত্ব।

বাংলাদেশের ইতিহাসে বিভিন্ন ধরনের নির্বাচন হয়েছে: অংশগ্রহণমূলক ও একপক্ষীয়; জালিয়াতির নির্বাচন ও সুষ্ঠু নির্বাচন; আগে থেকেই সাজানো নির্বাচন ও স্বতঃস্ফূর্ত নির্বাচন। কোনো নির্বাচনের ফলাফল ছিল আগে থেকেই জানা, কোনো নির্বাচনে ভোটাররা সব ধরনের পূর্বাভাস ভুল প্রমাণ করেছেন। যদিও এটা হচ্ছে একাদশ সংসদ নির্বাচন, তবু গত কয়েক সপ্তাহে ঘুরেফিরে সব আলোচনায় ও তুলনায় উঠে এসেছে ১৯৯১-পরবর্তী পঞ্চম সংসদ নির্বাচন। এতে এটাই স্বীকৃত হয়েছে যে এর আগের চারটি নির্বাচন নিয়ে আমাদের গর্ব করার মতো কিছু নেই। এর কারণ হচ্ছে বিশ্বাসযোগ্য এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ন্যূনতম মাপকাঠি এগুলো উতরাতে পারেনি। এগুলোকে জালিয়াতির নির্বাচন বলছেন, না ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন বলছেন—তাতে কিছুই যায়-আসে না।

এসব নির্বাচন, পৃথিবীর আর দশটা নির্বাচনের মতোই, উপহার দিয়েছে একটি বিজয়ী দল, আরেকটি পরাজিত দল। এসব নির্বাচন উপহার দিয়েছে নতুন সরকার: মেয়াদ স্বল্প বা তুলনামূলকভাবে দীর্ঘ, যা-ই হোক না কেন। কিন্তু এখন আমরা জানি, কেবল ইতিহাসবিদেরা বলেছেন বলে নয় কিংবা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা সেইভাবে ব্যাখ্যা করেন বলে নয়, ঘটনা-পরবর্তী বোধোদয়, যাকে ইংরেজিতে বলে হাইন্ডসাইট, সে কারণেও নয়, ওই সব নির্বাচনের কোনো নৈতিক বৈধতা ছিল না। আমরা তা ওই নির্বাচনের সময়েও জানতাম। নৈতিক বৈধতা, যা শাসনের একটি অপরিহার্য উপাদান, তারই অভাব ছিল এই সব নির্বাচনের। নির্বাচনের কাজ হচ্ছে শাসনের একটি ম্যান্ডেট দেওয়া, ক্ষমতা প্রয়োগের উন্মুক্ত লাইসেন্স নয়। ওই সব নির্বাচনে যাঁরা বিজয়ী হয়েছিলেন, তাঁরা প্রায়ই এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারেননি কিংবা চাননি।

১৯৯১ সালের পরে অনুষ্ঠিত সব নির্বাচন যে বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পেরেছে, তা নয়। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি ও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একপক্ষীয় নির্বাচনগুলো এই পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ। অন্য যে চারটি নির্বাচন হয়েছে—১৯৯১,১৯৯৬ (জুন), ২০০১ ও ২০০৮ সালে—সেগুলোতে পরাজিতরা নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ করেছেন, সূক্ষ্ম কিংবা মোটা দাগে। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারের কাছে এই সব নির্বাচন বৈধ বলেই মনে হয়েছে। নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য হতে হলে দরকার হয় আইনি ও সাংবিধানিক বৈধতা থাকা, কিন্তু সেগুলো মোটেই যথেষ্ট নয়। কেবল নৈতিক বৈধতাই একটি নির্বাচিত সরকারকে ঘিরে নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ করে, আর নাগরিকেরা ক্ষমতাসীনদের তাঁদের প্রকৃত প্রতিনিধি বলে বিবেচনা করে। এই নৈতিক বৈধতা এমন কোনো নির্বাচনের মধ্য দিয়ে অর্জন সম্ভব নয়, যার সততা প্রশ্নবিদ্ধ বা অনুপস্থিত। নৈতিক বৈধতা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব নয়।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা যুগ যুগ ধরে ন্যূনতম গণতন্ত্রকে এমন এক ব্যবস্থা বলে বর্ণনা করেছেন, যেখানে নাগরিকেরা নিজেদের শাসক হিসেবে কাউকে গ্রহণ বা বর্জন করতে পারে; সেই গ্রহণ বা বর্জনের পথ হচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন। ফলে নির্বাচন হচ্ছে সেই উপায়, যার দ্বারা তাঁরা নির্ধারণ করেন, কে বা কারা তাঁদের প্রতিনিধিত্ব করবেন, কারা তাঁদের জন্য আইন প্রণয়ন করবেন। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে যে নির্বাচন মানে কেবল কে বিজয়ী হলেন, তা নয়, কীভাবে তিনি নির্বাচিত হলেন, সেটাও সমধিক গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনের প্রক্রিয়াই বৈধতার ব্যাপ্তি ও গভীরতা কিংবা তার অনুপস্থিতি নির্ধারণ করে দেয়। সে কারণেই কোনো কোনো বিজয় হয় অন্তঃসারশূন্য। সারা পৃথিবীতে এই ধরনের নির্বাচনের উদাহরণ আছে, বাংলাদেশের ইতিহাসেও আছে। ১৯৯১ সালের আগে অনুষ্ঠিত সব নির্বাচনই নৈতিক বৈধতার সংকটে থেকেছে; ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি এবং ২০১৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনও একই কাতারভুক্ত।

কিন্তু এসবই হচ্ছে ইতিহাস; আমরা এখন দাঁড়িয়ে আছি ভবিষ্যতের মুখে। আরেকটি নির্বাচনের ঠিক আগের মুহূর্তে সে কারণেই প্রশ্ন ওঠে, কী ধরনের নির্বাচন হবে? নির্বাচন কমিশন ও ক্ষমতাসীনেরা কী ধরনের নির্বাচন উপহার দিতে চান? গত কয়েক সপ্তাহের ঘটনাপ্রবাহ, যা নির্বাচনের সততার ব্যাপারে বড় রকমের প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে এবং যা একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের সম্ভাবনাকে প্রায় তিরোহিত করেছে, তা সত্ত্বেও বলা যায় যে সবকিছু এখনো চূড়ান্তভাবে নির্ধারিত হয়ে যায়নি। এখনো একটি ঐতিহাসিক নির্বাচনের সুযোগ নির্বাচন কমিশন ও ক্ষমতাসীনদের কাছেই আছে, যদি তাঁরা এখনো এমন ব্যবস্থা করেন, যাতে কোটি কোটি ভোটার নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে তাঁদের পছন্দমতো প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন এবং তাঁদের ভোট যথাযথভাবে গণনা করা হয়। ভোটাররা যে ভোট দিতে আগ্রহী, তা বললে অতিরঞ্জন হবে না। যখনই ভোট দেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন, বাংলাদেশের ভোটাররা তাতে অংশ নিয়েছেন আরও বেশি আগ্রহের সঙ্গে। নির্ধারিত সময়ের দুই বছর পর ২০০৮ সালে যখন নির্বাচন হয়েছে, সেখানে প্রদত্ত ভোটের হার ২০০১ সালের তুলনায় ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল।

ভোটারদের ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিন, তাঁদের কথা বলতে দিন, তাঁদের কণ্ঠস্বর শোনার উপায় তৈরি করুন; এখনো সেই সময় শেষ হয়ে যায়নি। এমন এক ভোটের দিন তৈরি করুন, যা এত দিনকার সব প্রশ্ন পেছনে ফেলে এই নির্বাচনকে প্রশ্নের ঊর্ধ্বে তুলতে পারে—তার ফলাফল যা-ই হোক না কেন। একই কথা ভোটারদের জন্যও প্রযোজ্য, আপনারা ১০ কোটি মানুষ, আপনারা যদি আপনাদের রায় দিতে এগিয়ে আসেন, তবেই এই নির্বাচন হবে বিশ্বাসযোগ্য। ভবিষ্যৎ পূর্বনির্ধারিত নয়, আজকের ভূমিকা আগামী দিনকে অনেকভাবেই তৈরি করে।

আমাদের বিস্মৃত হওয়ার সুযোগ নেই, ইতিহাস সব ঘটনার সাক্ষী; ইতিহাস কেবল সাক্ষীই নয়, ঘটনার ক্রীড়নকদের বিচারের ভারও তার ওপর। কিন্তু সেই বিচারের জন্য সব সময়ই যে ‘পথ চেয়ে আর কাল গুনে’ বসে থাকতে হয়, তা নয়, তা সমকালেও ঘটতে পারে।

লেখক: অধ্যাপক, ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র