তবু মানুষ ভোট দিতে পারুক

গত কয়েক দিনে ঢাকা শহরের চিত্র ছিল ঈদের সময়ের মতোই ফাঁকা। দুই ঈদে মানুষ গ্রামে যান স্বজনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে। কিন্তু গত কয়েক দিনে যে লাখ লাখ মানুষ ঢাকা ছেড়েছেন, তাঁদের উদ্দেশ্য পছন্দসই প্রার্থীকে একটি ভোট দেওয়া। ঢাকায় মোটামুটি স্থায়ী এমন অনেকেই গ্রামে ভোটার হয়েছেন ‘আপন মানুষকে’ ভোট দিতে।

আমরা এক অদ্ভুত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু করেছি। ৩০০ আসনে যাঁরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, তাঁদের বেশির ভাগই ঢাকা বা অন্য কোনো বড় শহরের বাসিন্দা। জীবিকার জন্য শহরে আসা মানুষ ভোট দিতে গ্রামে যান, আর আমাদের জনপ্রতিনিধিরা ভোট শেষ হলেই নির্বাচনী এলাকা ছেড়ে শহরে চলে আসেন। তাঁরা শহরে থেকেই গ্রামের মানুষের জনপ্রতিনিধি হন। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে এমনটি হয় না।

ঢাকা শহরে ভোটের আমেজ না হলেও ছুটির আমেজ পুরোপুরি টের পাওয়া যাচ্ছে। রাস্তায় লোকজন কম। গাড়ি চলাচল আরও কম। ভোটের দিন প্রাইভেট গাড়ি চলবে না, ভোটের আগে ও পরে মিলিয়ে চার দিন মোটরবাইক বন্ধ থাকবে। রিকশাই একমাত্র ভরসা। কিন্তু সমস্যা হলো, যে গরিব মানুষগুলো ঢাকা শহরে রিকশা চালান, তাঁদেরও একাংশ গ্রামে ভোট দিতে চলে গেছেন। বাদ যায়নি পাড়ার খুদে দোকানদার, গাড়ির চালক, হোটেল-রেস্তোরাঁর কর্মচারীও।

এই যে লাখ লাখ শ্রমজীবী মানুষ, যাঁরা একটি ভোট দেওয়ার জন্য গ্রামে গিয়েছেন, তাঁরা জানেন, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তাঁদের জন্য তেমন কিছু করবেন না। ভোটের পর অনেকের টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যাবে না। ভোটের আগে দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলোও তাঁরা ভুলে যাবেন। শ্রমজীবী মানুষেরা ভালো করেই জানেন যে তাঁদের ভাত-কাপড়ের সমস্যা তাঁদেরই সমাধান করতে হবে। তারপরও তাঁরা ভোটটি দিতে চান। অনেক প্রবাসীও দেশে এসেছেন ভোট দেওয়ার জন্য। যে প্রবাসী লাখ টাকা বিমান ভাড়া দিয়ে ভোট দেওয়ার দেশে এসেছেন, তিনিও মনে করেন না যে রাজনৈতিক দলগুলো তাঁদের কল্যাণে বড় কিছু কিছু করবে। তারপরও তাঁরা ভোট দেওয়ার অধিকারটুকু প্রতিষ্ঠা করতে চান। জনপ্রতিনিধি বাছাই এবং সরকার গঠনে ভূমিকা রাখতে চান। ভোটের অধিকার নিশ্চিত করাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।

এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মোট ভোটারের সংখ্যা ১০ কোটি ৪২ লাখ ৩৮ হাজার ৬৭৩ জন। এর মধ্যে তরুণ ভোটার প্রায় এক-চতুর্থাংশ, যাঁরা ভবিষ্যতের বাংলাদেশ নির্মাতা। কিন্তু কোনো দলের ইশতেহারে তাঁদের কর্মসংস্থান, তাঁদের সমস্যা সমাধানে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার কথা নেই। শুধু ফাঁকা আওয়াজ—ঘরে ঘরে চাকরি দেওয়া হবে। যে তরুণেরা কোটা সংস্কারের জন্য কিংবা নিরাপদ সড়কের জন্য রাস্তায় নেমেছিলেন, ক্ষমতার রাজনীতি তাঁদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেনি। তারপরও তরুণেরা ভোট দিয়ে তঁাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে চান।

এবার নির্বাচনে ভোট গ্রহণের দায়িত্ব পালন করবেন ৪০ হাজার ১৮৩ জন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, ১ লাখ ৯৫ হাজার ৩১৬ জন সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা এবং ৩ লাখ ৯০ হাজার ৬৩২ জন পোলিং কর্মকর্তা। প্রতিটি কেন্দ্রে ১ থেকে ২ জন পুলিশ ও ১২ জন আনসার সদস্য নিয়োজিত থাকবেন। এ ছাড়া নির্বাচনের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মোতায়েন থাকবেন বিজিবি ও র‍্যাব সদস্য। থাকবে সেনাবাহিনী। প্রতিটি কেন্দ্রের প্রতিটি বুথে প্রার্থীদের পোলিং এজেন্ট থাকবেন, যাঁরা দেখবেন ভোটটি ঠিকভাবে হচ্ছে কি না। একজনের ভোট আরেকজন দিচ্ছেন কি না।

সবকিছু মিলিয়ে জাতীয় নির্বাচন একটি মহাযজ্ঞ।

পাকিস্তান আমলে আমরা বহু আন্দোলন–সংগ্রাম করে ‘এক মাথা এক ভোট’ অর্থাৎ সর্বজনীন ভোটাধিকার আদায় করেছিলাম। আর সেই অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলে সত্তরে বাঙালি ভোট দিয়েই স্বাধীনতার পথ সুগম করেছিল। কিন্তু আজ আমরা গণতন্ত্র রক্ষা করতে পারব না কেন?

নির্বাচনের তিনটি পর্ব থাকে, প্রাক্–ভোট, ভোটের সময় এবং ভোট পরবর্তী। প্রাক্‌–ভোট অর্থাৎ প্রচারপর্বে নির্বাচন কমিশনের যে দায়িত্ব ছিল, তা পালন করতে তারা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। এবারের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ নিবন্ধিত ৩৯টি রাজনৈতিক দল অংশ নিচ্ছে। কিন্তু ভোটের মাঠে ছিল শুধু আওয়ামী লীগের দাপট। অন্যরা টিকতেই পারেনি। দেশের প্রায় অর্ধেক আসনে সংঘাত–সংঘর্ষ হয়েছে, বহু হামলা-মামলার ঘটনা ঘটেছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা করেছে। ১৭ জন প্রার্থী আক্রান্ত হয়েছেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশন ছিল নির্বিকার।

আগের নির্বাচনগুলোতে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে একটি স্লোগান দেওয়া হতো—‘আমার ভোট আমি দেব, দেখে শুনে বুঝে দেব’। আর এখনকার স্লোগান হলো, ‘আমার ভোট যেন ছিনতাই না হয়ে যায়। ভোটকেন্দ্রে গিয়ে যেন আমি আমার ভোটটি দিতে পারি’।

নির্বাচনের সময় একটি সরকার থাকে। জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা থাকেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা থাকেন। প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর সমর্থকেরা থাকেন। নির্বাচনে সবার ভূমিকা থাকলেও নির্বাচনের মূল ভূমিকা নিতে হয় নির্বাচন কমিশনকেই। একটি ভালো নির্বাচন করলে যেমন তারা সাধুবাদ পাবে, তেমনি একটি মন্দ নির্বাচন করলে নিন্দিত হতে হবে। কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন এ পর্যন্ত এমন কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি, যা নিয়ে তারা গর্ব করতে পারে। বরং পদে পদে তারা ব্যর্থ হয়েছে। সমালোচিত হয়েছে।

বিএনপি অভিযোগ করেছে, মানুষ আতঙ্কে আছেন, তাঁদের পোলিং এজেন্টরা বাড়িতে থাকতে পারছেন না। কেন্দ্রে যেতে পারবেন না। এ অবস্থায় সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না। জবাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা বলেছেন, মানুষ উৎসবমুখর পরিবেশে ভোটকেন্দ্রে যাবেন। বিএনপির আশঙ্কা ভুল প্রমাণিত হবে। দেশের মানুষও চান বিএনপির আশঙ্কা ভুল প্রমাণিত হোক। ঘুম থেকে উঠে দেশের মানুষ দেখুক অন্য এক বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশ তিন সপ্তাহ ধরে ছিল, সেই বাংলাদেশ নয়। নিজের ভোট নিজে দেওয়ার পরিবেশ হোক।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার এর আগে যত কথা দিয়েছিলেন, একটিও রাখতে পারেননি। অন্তত এই কথাটি রাখুন। মানুষ সত্যি সত্যি উৎসবমুখর পরিবেশে ভোটকেন্দ্রে যাক, ভোট দিক এবং নিরাপদে বাড়িতে ফিরে আসুক। বিএনপিসহ সব দলের পোলিং এজেন্টরা ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত কেন্দ্রে থাকুক। কেউ তাঁকে বাধা দেবে না। ধাওয়া করবে না। আজ ভোটের দিন নির্বাচন কমিশন এটুকু নিশ্চয়তা দিতে পারলে তাদের অতীত গ্লানি, ব্যর্থতা—সব ঘুচে যাবে।

আমরা কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি, অন্তত মানুষ ভোট দিতে পারুক।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি