একাদশ সংসদ নির্বাচন

অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলো, কিন্তু তা প্রত্যাশা পূরণ করতে পারল না। সব দলের অংশগ্রহণ সত্ত্বেও এটি একতরফা নির্বাচনের মেজাজই বজায় রেখেছে। নির্বাচনী প্রচারাভিযানে হামলা-মামলার ঘাটতি ছিল না। কিন্তু প্রধান বিরোধী দলের নেতারাও ধারণা দিয়েছিলেন যে ভোটের দিনে পরিস্থিতির বিরাট পরিবর্তন ঘটবে। উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বিশেষ করে এই নির্বাচনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল আড়াই কোটি তরুণ ভোটারের প্রথমবারের মতো অংশ নেওয়া। কিন্তু তাঁদেরও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। নির্বাচনী প্রচারাভিযানে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বহু স্থানে বিরোধী দলের অস্তিত্ব চোখে পড়েনি। আর দেশজুড়ে ভোটের দিনের অভিন্ন চিত্র হচ্ছে, কেন্দ্রগুলোতে ধানের শীষের প্রার্থীর কোনো এজেন্ট নেই।

উপরন্তু নির্বাচনে যে সহিংসতা হয়েছে, তাকেও খাটো করে দেখা যাবে না। অন্তত ১৭ ব্যক্তি নিহত হওয়াসহ বিচ্ছিন্ন সহিংসতা ঘটেছে। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন মানেই প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন। আর যত বেশি প্রতিযোগিতা, তত বেশি তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা—এই ধারণা অমূলক প্রমাণিত হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়েছে। নির্বাচনী মাঠ যে সমতল ছিল না, তা শুরু থেকেই আমরা বলে এসেছি। গতকাল নির্বাচনের দিন সেটা আরও প্রকটভাবে টের পাওয়া গেল। প্রধান নির্বাচন কমিশনার যদিও বলেছেন, ‘ধানের শীষের এজেন্টরা কেন্দ্রে না আসলে কী করার? তাঁরা কেন্দ্রে কেন আসেননি বা কেন কোনো এজেন্ট নেই, সেটা প্রার্থীর নির্ধারিত এজেন্টরাই বলতে পারবেন।’ এই যুক্তি দুর্বল ও নিজের দায়িত্বকে অস্বীকার কারা ছাড়া আর কিছু নয়। গত ১০ বছর নির্বাচন কমিশন পরিচালিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ফলাফল প্রমাণ করে যে বিএনপিই দেশের বৃহত্তম বিরোধী দল। প্রচণ্ড বৈরী পরিবেশেও বিএনপির নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্ট তিন শ আসনে প্রাথমিকভাবে একাধিক প্রার্থী দিতে সক্ষম হয়েছিল। এ রকম একটি সংগঠনের নির্বাচনী এজেন্টই থাকবে না বা তারা দিতে পারবে না, তা কোনোভাবেই স্বাভাবিক হতে পারে না।

সিইসির এই দুর্ভাগ্যজনক মন্তব্য আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, ২০১৪ সালে ১৫৪টি আসনে একক প্রার্থীর জয়যুক্ত হওয়ার পর ইসির তরফে দেওয়া একই ধরনের যুক্তি। এবারের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনটি নিষ্প্রাণ। জাতীয় নির্বাচন তার চিরচেনা জৌলুশ হারিয়েছে। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া নির্বাচন ছিল উৎসবমুখর। কিন্তু তঁার এই দাবি ধোপে টিকবে না। কারণ, দুই বড় দলের দুর্গনির্বিশেষে উল্লেখযোগ্য নির্বাচনী এলাকাগুলোর সর্বত্রই একটা অস্বাভাবিক পরিবেশ লক্ষ করা গেছে।

ঐক্যফ্রন্ট অভিযোগ করেছে, পাইকারি ধরপাকড় ছাড়াও বহু স্থানে ব্যালট বাক্স আগের রাতেই ভরে ফেলা হয়েছে। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন বাতিল করে পুনরায় তফসিল ঘোষণা করার দাবি জানিয়েছে তারা। তারা বলেছে, এটা নজিরবিহীন ভোট ডাকাতির নির্বাচন। বিএনপি নির্দিষ্টভাবে ২২১টি আসনে অনিয়মের অভিযোগ এনেছে। দলটির মহাসচিব বলেছেন, এই নির্বাচনে তাঁদের প্রতিপক্ষ ছিল রাষ্ট্রযন্ত্র। এর বাস্তবতা থাকতে পারে কিন্তু বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে তাদের নেতৃত্বের সমস্যা ও সাংগঠনিক দুর্বলতার বিষয়গুলোকেও বিবেচনায় নিতে হবে।

প্রশ্ন হচ্ছে এই নির্বাচন একটি বহুত্ববাদী সমাজ গঠন এবং বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় কী অবদান রাখবে এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে কোথায় নিয়ে যাবে? এই নির্বাচন কি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা আমাদের গণতান্ত্রিক ঘাটতির ব্যবধান ঘোচাতে সহায়ক হবে, নাকি তা আরও দূরত্ব তৈরি করবে? অধিকতর পরমতসহিষ্ণুতা এবং বাক্‌স্বাধীনতার প্রতি এই রাষ্ট্র কি আরও শ্রদ্ধাশীল হবে? অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করার পর আমাদের সম্ভবত এসব প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। এটা অনস্বীকার্য যে উন্নয়ন অবশ্যই লাগবে। কিন্তু গণতন্ত্রের ঘাটতি বাড়িয়ে উন্নয়নকে কোনোভাবেই টেকসই করা সম্ভব নয়।