শান্তিপূর্ণ ভোট গ্রহণ, কিন্তু...

চট্টগ্রাম কাপাসগোলা বালিকা বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিয়ে এসে বাইরে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছিলেন চার অধ্যাপক। তাঁদের দুজন চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট), একজন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও একজন ঢাকা ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল (ইউল্যাব) আর্টসের শিক্ষক। চট্টগ্রাম-৯ আসনটিতে ভোট গ্রহণ হচ্ছে ইভিএম পদ্ধতিতে। এই চার শিক্ষকই একমত হয়ে জানালেন, ‘ইভিএম পদ্ধতিতে ভোটে কারচুপির সুযোগ কম। আগামীতে সারা দেশেই এই পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণ করা উচিত।’ কিন্তু এই পদ্ধতিতে ভোট দিতে গিয়ে নিজের বিড়ম্বনার কথা জানালেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকজন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। কলেজ রোড এলাকায় সরকারি উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিতে গিয়ে তিনি দেখেন ভোট দেওয়ার গোপন কক্ষে দাঁড়িয়ে আছেন আওয়ামী লীগ দলের নির্বাচনী এজেন্ট। তিনি তাঁর সামনে ভোট দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বেরিয়ে আসেন। এ বিষয়টা নিয়ে পোলিং এজেন্টের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে বেশ কজন দলীয় কর্মী তাঁকে ভোট না দিয়ে চলে যেতে বলেন। বিষয়টি প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে জানানোর পর শেষ পর্যন্ত তিনি একান্তে ভোট দিতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু তাঁর বক্তব্য, সবাই তো আর এত ঝক্কি–ঝামেলা সয়ে ভোট দিতে চাইবেন না!

বোঝা গেল পদ্ধতিটাই বড় কথা নয়, তাকে সুষ্ঠু, নিরাপদ ও কার্যকর রাখার ওপরই নির্ভর করছে অনেক কিছু।

চট্টগ্রাম-৫ (হাটহাজারী), চট্টগ্রাম-৮ (ডবলমুরিং-হালিশহর), চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালি, বাকলিয়া) ও চট্টগ্রাম-১০ (চান্দগাঁও-বোয়ালখালী)–সহ অন্তত ২০টি কেন্দ্রে ঘুরে দেখা গেল ভোট গ্রহণ চলছে ‘শান্তিপূর্ণ’ভাবে। কোথাও ভোটারদের দীর্ঘ সারি, কোথাও উপস্থিতি তুলনামূলক কম। কিন্তু অধিকাংশ কেন্দ্রে নৌকা তো বটেই, হাতপাখা, মোমবাতি, মই বা সিংহ প্রতীকের এজেন্ট থাকলেও ধানের শীষের প্রার্থীর এজেন্ট নেই। সব কটি কেন্দ্রের নির্দিষ্ট দূরত্বে নৌকার প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী ক্যাম্প থাকলেও, ধানের শীষের প্রার্থীর নির্বাচনী ক্যাম্প তো দূরের কথা, এই প্রতীকের ব্যাজ লাগানো কোনো কর্মী–সমর্থককেও দেখা গেল না।

নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে আসা কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল চট্টগ্রাম শিশু একাডেমী কেন্দ্রে। তাঁরা বিএনপির কর্মীদের হাল ছেড়ে দেওয়ার ঘটনায় বিস্মিত। ধরপাকড়, গ্রেপ্তার–আতঙ্ক তো আছেই, প্রতিপক্ষের হামলার ভয়ও আছে। কিন্তু এত বড় দলের কর্মীদের চোখে পড়ার মতো সামান্য তৎপরতাও থাকবে না এটা বিস্ময়কর বলে মনে করেন তাঁরা। সাংবাদিকদের এসব আলাপচারিতা পাশে দাঁড়িয়ে শুনছিলেন নাসিম (৫২) নামের একজন। তাঁকে বিএনপি সমর্থক বলেই মনে হলো। নিচু গলায় তিনি বললেন, ‘ধানের শীষের সমর্থকেরা হইচই করছে না এটা এক দিক থেকে ভালো। নীরবে নিজের ভোটটা দিয়ে চলে যেতে চাই।’ কিছুক্ষণ পর ‘নীরবে’ ভোট দিয়ে ওই ভোটারকে হাসিমুখে বেরিয়ে যেতে দেখে মনে হলো লোকটা বিচক্ষণ।

পূর্ব নাসিরাবাদ এ জলিল সরকারি প্রাইমারি স্কুল কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেল যথারীতি ধানের শীষের কোনো এজেন্ট নেই। আপেল প্রতীকের পক্ষে একজন এজেন্ট ছিলেন, তিনিও চলে গেছেন। এটি মহিলা ভোটারদের কেন্দ্র। পোলিং এজেন্ট থেকে শুরু করে নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে জড়িত সবাই বললেন, শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু ভোট হচ্ছে। কিন্তু দোতলায় আফরোজা আফরিন (২৪) নামের এক তরুণীকে দেখলাম ভোটার নম্বর নিয়ে এই বুথ থেকে ওই বুথে ঘোরাঘুরি করছেন, ভোট দিতে পারছেন না। কর্মকর্তার কাছে আফরোজার ভোট দিতে সমস্যা কী জানতে চাইলে তিনি জানালেন, ব্যালট শেষ হয়ে গেছে, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে।

মুরাদপুর মূক ও বধির বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি কম। কেন্দ্রের বাইরে আওয়ামী লীগদলীয় কর্মীরা মাঝেমধ্যেই অকারণে ‘ধর ধর’ বলে দৌড়াদৌড়ি করছেন। এ ব্যাপারে এ দলের নেতা গোছের একজনকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, ‘এসব বখাটে ছেলেপেলে, দলের কেউ না।’ কেন্দ্রে উপস্থিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদেরও এ ব্যাপারে নির্বিকার দেখা গেল। তবে বগারবিল পঁচিশ কামলা মাদ্রাসা রহমান কেন্দ্রটি ঐতিহ্যগতভাবে বিএনপি সমর্থক এলাকা হিসেবে পরিচিত। কিন্তু এখানে সরকারদলীয় কর্মী-সমর্থকেরা ভোটারদের মধ্যে ভীতি-আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা করেননি। নৌকা, ধানের শীষসহ সব প্রতীকের এজেন্টই ছিলেন কেন্দ্রে। মহিউদ্দিন (৩৮) নামের একজন গাড়িচালক নিজের ভোট দিতে এসে তাঁর সন্তুষ্টির কথা জানালেন, ‘মেশিনে ভোট দিয়েছি, কোনো অসুবিধা হয়নি।’

পশ্চিম ষোলশহর কাউন্সিলর কার্যালয় কেন্দ্রটি নারী ভোটারদের। এখানে ভোটারদের দীর্ঘ সারি থাকলেও ভোট গ্রহণ খুবই ধীরগতিতে চলছে বলে জানালেন ভোটাররা। এই কেন্দ্রের বিভিন্ন বুথে গিয়ে পুরুষদের উপস্থিতি দেখে প্রিসাইডিং কর্মকর্তার কাছে এর কারণ জানতে চাইলে তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে পুলিশ সদস্যদের ডেকে সব পুরুষকে বের করে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন।

পশ্চিম শহীদ নগর প্রফেসর হুমায়ুন ইসলামি কিন্ডারগার্টেনে নৌকা, ধানের শীষ ও হাতপাখা (ইসলামী আন্দোলন) প্রতীকের পক্ষে এজেন্ট ছিলেন। কেন্দ্রের বাইরে ভোটারদের দীর্ঘ সারি দেখা গেল। কিন্তু ভোটারদের অভিযোগ, ইচ্ছাকৃতভাবে ভোট গ্রহণ বিলম্বিত করা হচ্ছে।

একই চিত্র দেখা গেল কুলগাঁও সিটি করপোরেশন উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে। বিদ্যালয়ের বিরাট মাঠজুড়ে ভোটারদের একাধিক দীর্ঘ সারি। এখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে লাঙ্গল ও ধানের শীষের মধ্যে। ভোট দিতে আসা আফজাল হোসেন (৫৬) ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন, ‘এখানে ২০টি ভোট নিতে সময় লাগছে এক ঘণ্টা।’ ভোট গ্রহণে এই ধীরগতির উদ্দেশ্য তাৎক্ষণিকভাবে বোঝা গেল না।

এই কেন্দ্রে ধানের শীষ প্রতীকের এজেন্টের কাছে নির্বাচনের পরিবেশ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘এখনো ঠিকঠাক আছে। তবে বলা যায় না যেকোনো মুহূর্তে পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যেতে পারে।’ দুপুর ১২টার দিকে এই কেন্দ্র পরিদর্শন করে এসেছিলাম। বেলা তিনটার দিকে শোনা গেল এই আসনের ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থী কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন।

চট্টগ্রাম নগর ও আশপাশের আরও তিনটি আসনের বিভিন্ন কেন্দ্র ঘুরে আপাত শান্তিপূর্ণ একটি পরিবেশ লক্ষ করা গেছে। এমনকি দলেবলে এসে কেন্দ্র দখল করে নেওয়ার মতো ঘটনাও চোখে পড়ল না। কিন্তু ভোটারদের অনেকের ভোট দিতে না পারার ক্ষোভ, ভিন্নমতাবলম্বী কর্মী-সমর্থকদের সরব উপস্থিতির অভাবে উৎসবের আনন্দটা যেন পরিপূর্ণ হয়ে উঠল না। 

বিশ্বজিৎ চৌধুরী, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি ও সাহিত্যিক
[email protected]