আমরা আশায় থাকব

অলংকরণ: আরাফাত করিম
অলংকরণ: আরাফাত করিম

২০১৮ সালে বছরজুড়ে বাংলাদেশে জন–আলোচনায় ছিল রাজনীতি। সবাই রাজনীতি করেন না। তবু  মানুষের কৌতূহল, চাওয়া, না–পাওয়া ও ক্ষোভ—সবই রাজনীতিকে ঘিরে।

২০১৮ সালে বেশ কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ও প্রক্রিয়ার সাক্ষী আমরা। শুরুতে নিয়মিত সংবাদ শিরোনাম হয়েছিল বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মামলা এবং আদালতে তাঁর দৌড়াদৌড়ি। একপর্যায়ে তাঁর সাজা হলো। তিনি গ্রেপ্তার হলেন। তাঁর রাজনৈতিক উত্তরসূরি তারেক রহমান ভিন্ন মামলায় আগেই দণ্ডিত হয়েছিলেন। আইনের ভাষায় তিনি ‘ফেরার’। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার প্রাথমিক রায়ে তাঁর হলো আজীবন কারাদণ্ড।

১০ বছর আগে ‘মাইনাস টু’ ছিল আলোচনার কেন্দ্রে। বিচারিক প্রক্রিয়ায় এটি ভালোভাবেই কার্যকর হলো বিএনপিতে। অভাবনীয় কিছু না ঘটলে রাজনীতিতে তাঁদের ফিরে আসা কঠিন। বলা চলে, বিএনপিতে খালেদা-তারেক যুগের অবসান হয়েছে। পরিবারতন্ত্রের প্রতি আনুগত্য ও আবেগ সরিয়ে রেখে এ উপলব্ধি যত শিগগির আসবে, বিএনপি তত নতুনভাবে সংগঠিত হওয়ার সুযোগটি কাজে লাগাতে পারবে।

২০১৮ ছিল নির্বাচনের বছর। আগস্ট মাসে কয়েকটি সিটি করপোরেশনে দলীয় প্রতীকে প্রথমবারের মতো নির্বাচন হওয়ায় জাতীয় নির্বাচনের একটি মহড়া হয়ে যায়। বিরোধীপক্ষ কারচুপির অভিযোগ তুলেছিল। এ ছিল ‘শান্তিপূর্ণ কারচুপির’ একটি নমুনা। সরকারপক্ষ বলেছে, ভালো নির্বাচন হয়েছে এবং জাতীয় নির্বাচন এ রকমই হবে।

পাঁচ সদস্যের নির্বাচন কমিশন সারা বছরই আলোচনার কেন্দ্রে ছিল। গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়ে কমিশনাররা একমত হননি। মাঝেমধ্যে তাঁরা প্রকাশ্য বিরোধে জড়িয়েছেন। জাতীয় রাজনীতির বিভাজন নির্বাচন কমিশনের মধ্যেও দেখা গেছে। বিশেষ করে নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার এবং সেনা মোতায়েনকে কেন্দ্র করে একেক সময় একেক রকম কথা বলে তাঁরা অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। অনেক সময় তাঁদের অতিকথন দৃষ্টিকটু মনে হয়েছে।

১৯৯০-এর দশকে শুরু হওয়া দ্বিদলীয় রাজনীতির দ্বন্দ্ব এ বছরে হয়েছে তীব্রতম। সমন্বয় ও সহাবস্থানের সম্ভাবনা প্রায় নিঃশেষিত। এই দ্বন্দ্বের সর্বগ্রাসী থাবা বিস্তারিত হয়েছে সমাজের সব অংশে। সব পেশাজীবী সংগঠন এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে।

বছরটি শেষ হয়েছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। এবারের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সবচেয়ে বেশি দল ও মনোনয়নপ্রত্যাশী প্রার্থীজট নিয়ে মুখরোচক আলোচনা ছিল। ৯৬ জন স্বতন্ত্র প্রার্থীসহ মোট প্রার্থী ছিলেন ১ হাজার ৮৪১ জন। তাঁদের অনেকেই পরে নিয়মের বেড়াজালে পড়ে বাদ পড়েছেন। হলফনামায় দেখা গেছে, ফৌজদারি মামলা আছে এমন প্রার্থীর ছড়াছড়ি। আইনের ফাঁকফোকর ডিঙিয়ে অনেকেই পার পেয়ে গেছেন।

নির্বাচনে সমতল মাঠ নিয়ে আলোচনা ও অভিযোগ ছিল বিভিন্ন মহলে। এ নিয়ে নির্বাচন কমিশনের চেয়ে সরকারকেই বেশি তৎপর হতে দেখা গেছে। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিভিন্ন দল ও জোটের আলোচনা হয়েছে নির্বাচন–সংক্রান্ত নানা বিষয় নিয়ে। এটি প্রাক-নির্বাচনী সংলাপ হিসেবে গণমাধ্যমে গুরুত্ব পেয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতৃত্বের এ ধরনের সরাসরি ও মুখোমুখি বসা ও আলোচনা এর আগে দেখা যায়নি।

নির্বাচন ঘিরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট আরও বিস্তৃত হয়েছে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে একদা শত্রুশিবিরের বিকল্পধারা বাংলাদেশ। অন্যদিকে বিএনপির সঙ্গে সমঝোতায় গেছেন একদা আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকা কয়েকজন। তৈরি হয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। একসময় তৃতীয় শক্তি বা বিকল্প হিসেবে যাঁরা দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ গেছেন ধানের শীষে, কেউ কেউ সওয়ার হয়েছেন নৌকায়।

পছন্দের দলের মনোনয়ন না পেয়ে বেশ কয়েকজন দল পাল্টে প্রতিপক্ষ শিবিরে ঢুকে পড়েছেন। আদর্শের রাজনীতির চিরচেনা চাদরটি তাঁরা অবলীলায় ছুড়ে ফেলে দিয়েছেন। ব্যাপারটি দৃষ্টিকটু হলেও এ নিয়ে তেমন মাতম হয়নি। কারণ দুই জোটের ক্ষেত্রেই এটি হয়েছে, কম আর বেশি।

একাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোট িদতে অপেক্ষমাণ ভোটারদের একাংশ
একাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোট িদতে অপেক্ষমাণ ভোটারদের একাংশ

প্রধান প্রধান দল ও জোট ডিসেম্বরের শেষার্ধে নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করেছে। আওয়ামী লীগ টানা ১০ বছর ক্ষমতায় আছে। দলটি বলছে, ‘একটি আধুনিক, প্রযুক্তিনির্ভর, দক্ষ দুর্নীতিমুক্ত দেশপ্রেমিক গণমুখী প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজ অব্যাহত থাকবে।’ তাদের মুখ্য স্লোগান হলো উন্নয়ন। অন্যদিকে বিএনপি ক্ষমতার বৃত্তের বাইরে আছে ১২ বছর। তারা জোর গলায় ‘সুশাসনের’ কথা বলছে, ‘কর্তৃত্ববাদী’ ও ‘কেন্দ্রীভূত’ ক্ষমতার পুনর্বিন্যাসের লক্ষ্যে কিছু সাংবিধানিক সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছে। দুটো ইশতেহারেই জন–আকাঙ্ক্ষার কম–বেশি প্রতিফলন হয়েছে। তবে অগ্রাধিকার পাবে কোনটি, তা দুই প্রধান দলের প্রস্তাবে স্পষ্ট।

দলীয় মনোনয়নে দুই শিবিরেই পুরোনো মুখের ছড়াছড়ি। তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধেই দুর্বৃত্তায়নের অভিযোগ আছে। নতুন জাতীয় সংসদের গুণগত মান পুরোনো সাংসদদের নিয়ে কেমন হবে, তা নিয়ে কৌতূহল ও শঙ্কা থেকেই যাবে। দলের শীর্ষ নেতৃত্বে নারী থাকলেও দলীয় মনোনয়নে তাঁরা অপাঙ্‌ক্তেয় থেকে গেলেন।

বিগত বছরগুলোতে আর্থসামাজিক খাতে দৃশ্যমান উন্নয়ন হয়েছে অনেক। সবাই চান, এই ধারা অব্যাহত থাকুক। সুশাসনের দাবিটি মৌলিক নাগরিক অধিকারের পর্যায়ে পড়ে। এটি এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। ভবিষ্যতে এ দুইয়ের মধ্যে সমন্বয় ও ভারসাম্যের চ্যালেঞ্জটি বড় হয়ে দেখা দেবে।

দলীয় সরকারের অধীনে অতীতে সব নির্বাচনে ক্ষমতাসীনেরাই জয়ী হয়েছেন। এবারও সে রকম পূর্বাভাস ছিল। ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তা সত্য হলো: একচেটিয়া ভোটে বিপুল বিজয় ঘটেছে আওয়ামী লীগের। বিপরীতে বিএনপির এতটা খারাপ ফলাফল ভাবনাতীত ছিল। আশঙ্কা থেকে যাবে বিরোধী দলবিহীন একটি অকার্যকর সংসদের।

মনে করা হয়েছিল যে এই নির্বাচন বিএনপির জন্য হবে সংসদীয় রাজনীতিতে ফিরে আসার লড়াই। কিন্তু সংসদে তাদের উপস্থিতি এবার জাতীয় পার্টিরও পেছনে চলে গেল। আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয় ও বিএনপির ভরাডুবির ফলে বাংলাদেশে আপাতদৃষ্টিতে বিএনপি যুগের সমাপ্তি ঘটল বলে মনে হয়। আর জামায়াতে ইসলামীর সাংগঠনিক অস্তিত্ব বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিঃশেষিত হচ্ছে। আওয়ামী লীগের বৃত্তের বাইরে একটি বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির চাহিদা ও উপযোগিতা থেকেই যাবে। নতুন কোনো রূপে এ ধরনের শক্তি জন্ম নিতে পারে। আওয়ামী লীগের সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ হবে একক শক্তিতে গণতন্ত্রায়ণের পথটি মসৃণ করে কর্তৃত্ববাদী রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসা।

জনযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হওয়া দেশটি এখনো সব নাগরিকের রাষ্ট্র হয়ে ওঠেনি। একের পর এক প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দলতন্ত্র। কর্তৃত্ববাদী রাজনীতির অনুষঙ্গ হিসেবে কেউ বলেন গণতন্ত্র দেবেন, কেউ বলেন উন্নয়ন। গণতন্ত্র মানুষের জন্মগত অধিকার, এটি কেউ কাউকে দিতে পারে না, বরং কেড়ে নেয়। আর উন্নয়ন কারও দয়ার দান নয়। এটি সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। গণতন্ত্রের অবাধ অনুশীলন ও দায়িত্বশীলতার অনুঘটক হবে রাষ্ট্র, এটাই সবার চাওয়া। ১৯৭০ সালে জয় বাংলা নামে একটি চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত একটি গানের লাইন ছিল: ‘নতুন সূর্য ওঠার এই তো সময়’।

আমরা আশায় থাকব, এবার উঠবে নতুন সূর্য।