গণতন্ত্রের বিজয় এখনো সম্ভব

ইউরোপে উগ্র জাতীয়তাবাদীদের উত্থান ঘটেছে। ব্রাসেলস, বেলজিয়াম। ছবি: রয়টার্স
ইউরোপে উগ্র জাতীয়তাবাদীদের উত্থান ঘটেছে। ব্রাসেলস, বেলজিয়াম। ছবি: রয়টার্স

রোম যখন পুড়ছিল, নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল। এখন সময় বদলেছে, রাষ্ট্রপ্রধানেরা এখন আর বাঁশি বাজান না, তাঁরা টুইট করেন। যেমন মার্কিন প্রেসিডন্টে ডোনাল্ড ট্রাম্প। গত ২২ ডিসেম্বর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকারের চাকা বন্ধ, আর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে বসে একের পর এক টুইট করে যাচ্ছেন। ২০১৮ সালের জন্য এর চেয়ে অধিক তাৎপর্যপূর্ণ সমাপ্তি ভাবা কঠিন। গত দুই বছরে ট্রাম্প আমেরিকার রাজনীতি যেভাবে ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে দিয়েছেন, তাতে আমেরিকার তো বটেই, পৃথিবীর সুস্থাবস্থা নিয়ে উদ্বিগ্ন না হয়ে উপায় নেই। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর গত ৭০ বছর যে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, ট্রাম্প কার্যত একাই তা উল্টে দিতে চাইছেন। এই বিশ্বব্যবস্থার কেন্দ্রে রয়েছে সাধারণভাবে সম্মত আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ ব্যবস্থা। যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে ও নেতৃত্বেই এই ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র এই বিশ্বব্যবস্থার শিরোমণি। ট্রাম্প এটা থেকে মুখ ফিরিয়ে ‘ঘরে ফেরা’র আওয়াজ তুলেছেন। তাঁর স্লোগান, আমেরিকা ফার্স্ট। ২০১৮ সালে সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ভাষণে তিনি বিশ্বের অন্য নেতৃবৃন্দকেও পরামর্শ দিলেন, ‘আপনারাও নিজ নিজ দেশের কথা ভাবুন। আমার মতো আপনারাও “জাতীয়তাবাদী” হোন।’

জাতীয় স্বার্থের যুক্তি তুলেই আমেরিকা দেড় বছর আগে জাতিসংঘের ‘জলবায়ু চুক্তি’ থেকে বেরিয়ে এসেছে। আমরা জানি, বিশ্বের দেশগুলো যদি সম্মিলিত চেষ্টায় ভূমণ্ডলের ক্রমবর্ধমান উষ্ণতা কমাতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সবাই এক অনিবার্য বিপর্যয়ে নিক্ষিপ্ত হব। ছোট-বড় কোনো দেশ রেহাই পাবে না। বছর শেষে এক প্রতিবেদনে বিশ্বের বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এই বিপর্যয় ঠেকাতে আমাদের হাতে আছে মোটে ১৫ বছর।

যে জাতীয় স্বার্থের ধুয়া তুলে ট্রাম্প পৃথিবীকে এমন বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিতে প্রস্তুত, তার রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতটি মাথায় রাখা প্রয়োজন। গত এক দশকে ইউরোপে—এবং পরবর্তী সময়ে উত্তর আমেরিকায়—যে জাতীয়তাবাদী হাওয়া বইছে, তার কেন্দ্রে রয়েছে অভিবাসনবিরোধী প্রবণতা। এসব দেশের সাদা মানুষেরা বলছে, কালো ও বাদামি মানুষের আগমনে তাদের শ্বেতাঙ্গ খ্রিষ্টীয় সভ্যতা আক্রান্ত। একে রক্ষা করতে হলে দরজায় খিল দিতে হবে, কালো ও বাদামি মানুষদের আগমন ঠেকাতে হবে। 

এই জাতীয়তাবাদী প্রবণতার মূল সুরটি একান্তই বর্ণবাদী। ট্রাম্প তো স্পষ্টই বলেছেন, অভিবাসনে তাঁর আপত্তি নেই, কিন্তু তিনি আফ্রিকা বা ক্যারিবীয় দেশগুলো থেকে কাউকে চান না। তাঁর পছন্দ নরওয়ের মতো দেশ, যে দেশের ৯৪ শতাংশ মানুষ শ্বেতাঙ্গ। ইউরোপেও বর্ণবাদী জাতীয়তাবাদ ছড়িয়ে পড়েছে। যুক্তরাজ্য অভিবাসীদের ঠেকাতে  ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে বেরিয়ে যেতে চাইছে। অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স, হাঙ্গেরি, এমনকি উদারনৈতিক সুইডেনেও বর্ণবাদী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।

বর্ণবাদী জাতীয়তাবাদের সমান্তরালভাবেই উত্থান ঘটেছে কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক নেতৃত্বের। একদিকে ভীতি, অন্যদিকে নির্জলা মিথ্যাকে ব্যবহার করে ক্ষমতা দখল করে বসেছেন এমন একদল নেতা, যাঁদের বিগত শতকে নির্দ্বিধায় ‘একনায়ক’ বলতাম। শুধু ইউরোপ বা উত্তর আমেরিকা নয়, কর্তৃত্ববাদী শাসকদের খপ্পরে এখন এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোও। যেমন ভারতে মোদি, তুরস্কে এরদোয়ান। ইউরোপে বর্ণবাদ হচ্ছে রাজনীতির ট্রাম্পকার্ড, আর এসব দেশে ব্যবহার হচ্ছে ধর্মের নামে বিভক্তি। আরেক দল কর্তৃত্ববাদী নেতা ক্ষমতা আঁকড়ে আছেন সব প্রতিপক্ষকে ‘শত্রু’ হিসেবে চিহ্নিত করে। যেমন রাশিয়ার পুতিন, নিকারাগুয়ার ওর্তেগা। প্রতিবেশী মিয়ানমারেও রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক বিভক্তি।   

কর্তৃত্ববাদ জিতছে, পিছু হটছে গণতন্ত্র। ২০১৮ সালের এটাই ছিল প্রধান বৈশিষ্ট্য।

অবিশ্বাস্য মনে হবে, কিন্তু এই প্রবণতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এসেছে তৃতীয় বিশ্বের কিছু দেশ থেকে। মালয়েশিয়া বা ক্ষুদ্র মালদ্বীপের কথা ভাবুন। যখন কর্তৃত্ববাদ ও দুর্নীতিতন্ত্র মালয়েশিয়ায় জেঁকে বসেছে, ঠিক তখনই সে দেশের মানুষ ক্ষমতা থেকে টেনে নামাল প্রধানমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাককে, পতন হলো ৬১ বছর ধরে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা রাজনৈতিক দলটির। মালদ্বীপে প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিনকে হটানো সম্ভব, আমরা বাইরের কেউই ভাবিনি। সে দেশের মানুষ সেই কথা মিথ্যা প্রমাণ করে বিরোধী ডেমোক্রেটিক পার্টির ইব্রাহিম সালিহকে বিজয়ী করে এনেছে। 

গণতন্ত্রের পক্ষে বিজয় এখনো সম্ভব, যদি জনগণ এককাট্টা হয়। ২০১৮ সালের এটিও একটি শিক্ষা।

২০১৮ সালের অন্য আরেক বৈশিষ্ট্য চীনের উত্থান। একুশ শতকের শুরু থেকেই বিশ্বের দ্বিতীয় প্রধান অর্থনীতি হিসেবে চীনের উত্থান। কিন্তু সদ্য বিগত বছরেই চীন আমেরিকার এক নম্বর প্রতিপক্ষ হয়ে উঠল। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ভাষায়, আমেরিকার জন্য রাশিয়ার চেয়েও বড় শত্রু চীন। আমেরিকার প্রতি চীনের মূল চ্যালেঞ্জ অর্থনৈতিক। আমেরিকা আর আগের মতো সামরিক বা অর্থনৈতিক, কোনো দিকেই সর্বক্ষমতাধর নয়। আমেরিকা বহু বছর বিশ্বজুড়ে সামরিক আখড়া ও একই সঙ্গে তিন ফ্রন্টে যুদ্ধ জিইয়ে রেখে তার নিজের শক্তি খুইয়ে ফেলেছে। অন্যদিকে, চীন হয়ে উঠেছে নিঃশব্দে উঠে আসা এক পরাশক্তি। নিউইয়র্ক টাইমস বছর শেষে চীন বিষয়ে এক দীর্ঘ প্রতিবেদনে লিখেছে, এক নম্বর দেশকে টেক্কা দিয়েই দুই নম্বরের জায়গাটা দখল করেছে চীন।

চীনের এই সাফল্য এসেছে তার নিজস্ব নিয়মে, কমিউনিস্ট পার্টির কর্তৃত্ববাদী চরিত্র টিকিয়ে রেখে। একুশ শতকের গোড়া থেকে শুরু হয় চীনের সমুদ্রভিত্তিক সামরিক সম্প্রসারণ। তার লক্ষ্য অবশ্য সারা বিশ্ব নয়, শুধু এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল। আমেরিকার চোখে চীনের এই অবস্থান সরাসরি হুমকি। চীনকে ঠেকাতে ট্রাম্পের আমেরিকা প্রকাশ্য বাণিজ্যযুদ্ধে শুরু করেছে। ভবিষ্যতে এই চীন–মার্কিন প্রতিযোগিতা বিশ্বরাজনীতিকে সংজ্ঞায়িত করবে।

২০১৮ সালের আরেক বৈশিষ্ট্য সাইবার প্রযুক্তির অভাবিত সম্প্রসারণ। কয়েক বছর আগেও ভাবা হচ্ছিল তথ্যপ্রযুক্তি পৃথিবীকে বদলে দেবে, ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য কমাতে হবে এক ম্যাজিক হাতিয়ার। কিন্তু গত এক বছরে উপলব্ধি করা গেছে এই হাতিয়ার কতটা বিধ্বংসী হতে পারে। ‘ফেক নিউজ’ কথাটা ডোনাল্ড ট্রাম্প হয়তো জনপ্রিয় করেছেন, কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক বিজয়ের পেছনে যে সাইবারভিত্তিক ফেক নিউজ বড় সহায়ক ছিল, এখন সে কথা আমরা জানি। শুধু মিথ্যা প্রচারই নয়; পৃথিবীর ছোট-বড় সব দেশই এখন সাইবার প্রযুক্তি ব্যবহার করছে নিজের নাগরিকদের ওপর নজরদারি করতে। জর্জ অরওয়েল একসময় যে ‘বিগ ব্রাদার’-এর কথা বলেছিলেন, সেই ব্রিগ ব্রাদার এখন এই সাইবার ক্যামেরা। ভবিষ্যতে এর ব্যবহার বাড়বে, কমবে না। সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে সাইবার প্রযুক্তির ওপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ।