আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী পদক্ষেপ কী?

এই মুহূর্তে জালমে খলিলজাদ সম্ভবত সুখী মানুষ নন। আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের এই বিশেষ দূত এখন এক জরুরি মিশনে আছেন। আর সেটা হচ্ছে তালেবানের সঙ্গে শান্তি–প্রক্রিয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। কেননা, প্রায় ১৭ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র–সমর্থিত আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে তালেবানের যুদ্ধ শেষ করতে চান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

খলিলজাদ এ ব্যাপারে বেশ কিছুটা এগিয়েছিলেন। তিনি তালেবান প্রতিনিধি ও মার্কিন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে বেশ কয়েকটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠকের আয়োজন করেছিলেন। গত ডিসেম্বর মাসের গোড়ার দিকে এ ব্যাপারে সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই) অনুষ্ঠিত বৈঠকে আলোচনায় ব্যাপক অগ্রগতি হয়।

ইউএইতে বৈঠকের পর আফগান টিভি স্টেশন টোলো নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে খলিলজাদ তালেবানের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘তারা আমাকে বলেছে, আমরা আপনাদের পরাজিত করতে পারব না।’ তারা বলেছে, তারা প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় বসবে, এরপর আফগানদের সঙ্গে বসবে এবং রাজনৈতিক উপায়ে এ সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু ট্রাম্পের হঠাৎ করে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা খলিলজাদের কাছে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত খলিলজাদের কাজকে কঠিন করে তুলেছে। তবে সৌভাগ্যক্রমে ওয়াশিংটনের কাছে বিকল্প আছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট তালেবানদের তা–ই দিয়েছেন, যা তারা দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছিল—আর সেটা হচ্ছে সৈন্য প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি—আর এর বিনিময়ে তাদের কিছুই দিতে হবে না। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সেনা প্রত্যাহারের এ ঘোষণা তালেবানদের জন্য বেহেশত থেকে পাওয়া মান্নার (সুখাদ্য) মতো। তবে মার্কিন আলোচকদের কাছে এটা তাদের পেটে মুষ্ট্যাঘাতের মতো।

ট্রাম্পের সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের আগে তালেবানদের আলোচনায় বসতে রাজি করানোটা ছিল কঠিন একটি ব্যাপার। ২০০১ সালে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে তালেবান জঙ্গিরা আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে লড়াই চালিয়ে আসছে। গত তিন বছরে তালেবান বিদ্রোহীরা তাদের অবস্থান আরও শক্তিশালী করেছে। দেশটির একটি বড় অংশ এখন তাদের নিয়ন্ত্রণে। তাই তাদের পক্ষ থেকে লড়াই বন্ধ করার কোনো কারণই নেই।

তবে তালেবানরা আগে বলেছিল যে তারা যুদ্ধ শেষ করার ব্যাপারে আফগান সরকারের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনায় বসতে পারে, যদি ওয়াশিংটন সেনা প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি দেয়। এখন সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা তো এল। কিন্তু তালেবানরা আফগান সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।

২০০১ সালে মার্কিন বাহিনী আফগানিস্তানে তালেবানকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকে যত সরকার আফগানিস্তানের ক্ষমতায় এসেছে, তাদের তালেবান অবৈধ ও ওয়াশিংটনের আজ্ঞাবহ বলে অভিহিত করেছে। ২০১৪ সালে আফগানিস্তানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনিশ্চায়কভাবে শেষ হওয়ার পর তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিকে কাবুলে পাঠানো হয়। সেখানে তিনি সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া দুজন প্রার্থী আশরাফ ঘানি ও আবদুল্লাহ আবদুল্লাহর মধ্যে ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে একটি চুক্তি করেন। এই দুজন এখন বর্তমান আফগান সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

 কাজেই যখন তালেবানদের বিবৃতিতে বলা হয় যে আফগান সরকার আমেরিকানদের দ্বারা স্থাপিত, তখন আর সেটা তাদের অহেতুক প্রলাপ বলে মনে হয় না। মনে হচ্ছে, সেনা প্রত্যাহারের ট্রাম্পের একতরফা সিদ্ধান্ত ওয়াশিংটনকে তালেবানের সঙ্গে আফগান সরকারের শান্তি আলোচনা শুরুর তারিখ ঘোষণা করার সুযোগকে ভেস্তে দিল। তাহলে এখন ওয়াশিংটনের সামনে বিকল্প কী? আদর্শিকভাবে, ট্রাম্পের উচিত হবে সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা এবং কূটনৈতিক তৎপরতা চালানোর জন্য খলিলজাদকে আরও সময় দেওয়া।

কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ট্রাম্প তাঁর এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবেন না। কারণ, তিনি কখনোই আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাদের উপস্থিতিতে স্বস্তি বোধ করেননি। ১৭ বছরের আফগান যুদ্ধে ২ হাজার ৪০০ মার্কিন সেনার মৃত্যু হয়েছে। ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্তে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস ম্যাটিস পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। কূটনৈতিক শান্তি কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ম্যাটিস আফগানিস্তানে মার্কিন সেনার শক্ত উপস্থিতি চেয়েছিলেন। এ ছাড়া হোয়াইট হাউসের আরও বেশ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা আফগানিস্তানে মার্কিন সেনার উপস্থিতির পক্ষে। তাঁরা চেষ্টা করছেন, এ ব্যাপারে ট্রাম্পের মত পরিবর্তন করতে অথবা সেনা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া ধীরে করতে। ট্রাম্প হয়তো শিগগিরই আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই সব মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিতে পারেন।

এ ক্ষেত্রে ওয়াশিংটন যেসব পদক্ষেপ নিতে পারে, সেগুলো হচ্ছে প্রথমেই ক্ষতি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেওয়া। শীর্ষ মার্কিন কর্মকর্তাদের উচিত হবে কাবুলকে এই নিশ্চয়তা দেওয়া যে যদিও সেনা প্রত্যাহার করা হচ্ছে, কিন্তু তারা আফগানিস্তানকে পরিত্যাগ করছেন না। ওয়াশিংটনকে এটা বলতে হবে যে তারা আফগান নিরাপত্তা বাহিনীকে অর্থায়ন করা এবং আফগান বিশেষ বাহিনীকে সহায়তা দেওয়া অব্যাহত রাখবে। এই পদক্ষেপ আফগানদের উদ্বেগকে প্রশমিত করবে এবং মার্কিন সেনাদের বিদায়ের পর তালেবান জঙ্গিদের সম্ভাব্য আগ্রাসনকে সীমিত করবে।

দ্বিতীয়ত, ওয়াশিংটনকে তালেবানের ওপর নজর রাখতে হবে। তালেবান যাতে আল-কায়েদার সংস্রব ত্যাগ করে, তা নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, মার্কিন সেনারা চলে গেলে আফগানিস্তান আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের অভয়ারণ্যে পরিণত হবে।

তৃতীয়ত, ওয়াশিংটনকে চলতি বছরে অনুষ্ঠেয় আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সম্পূর্ণরূপে সমর্থন দিতে হবে। নির্বাচনের সময় নিরাপত্তা এবং অন্যান্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহায়তা দিতে হবে। আফগান নেতৃত্বের অধীনে যদি একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে হয়তো তালেবানরা তাদের সঙ্গে ভবিষ্যতে আনুষ্ঠানিক আলোচনায় বসতে পারে।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

মাইকেল কুগেলম্যান ওয়াশিংটনের উড্রো উইলসন সেন্টারের এশিয়া প্রোগ্রামের উপপরিচালক