পরিকল্পনা কমিশন চালাবেন কারা?

সরকার ইকোনমিক ক্যাডার ভেঙে দিয়ে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে একীভূত করেছে। এরপর নিয়োগ হবে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারেই। এতে ক্যাডারের সংখ্যা ২৭ থেকে কমে হলো ২৬। ইকোনমিক ক্যাডার গঠিত হয়েছিল ১৯৮৫ সালে। এখন এর জনবল ৪৬৪ জন। তাঁদের পদবি সহকারী প্রধান, সিনিয়র সহকারী প্রধান, উপপ্রধান, যুগ্ম প্রধান ও বিভাগীয় প্রধান নামে। এগুলো যথাক্রমে সহকারী সচিব, সিনিয়র সহকারী সচিব, উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিবের সমান্তরাল পদবি। সুযোগ-সুবিধা কাছাকাছিই ছিল। তবে পদোন্নতিতে কিছুটা পিছিয়ে ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।

এখন পদবি ও কর্মক্ষেত্র একই হয়ে গেল। ইকোনমিক ক্যাডারের অপেক্ষাকৃত তরুণ কর্মকর্তাদের মাঠ প্রশাসনে কাজ করারও সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। তেমনি পরিকল্পনা কমিশনেও কাজ করতে পারবেন সচিবালয়ের কর্মকর্তারা। সেখানে সদস্যের অধীনে অতিরিক্ত, যুগ্ম, উপ ও সহকারী সচিবেরা থাকবেন। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়েরও পরিকল্পনা কোষে ইকোনমিক ক্যাডারের কর্মকর্তারা কাজ করছেন। এখন তাঁদের পদবি পরিবর্তনের পাশাপাশি তাঁরা অন্য শাখা, অধিশাখা কিংবা অনুবিভাগে কাজের অধিকার পেলেন। পারস্পরিক বদলিযোগ্য হয়ে গেল পদগুলো। জানা গেছে, দুই ক্যাডারের কর্মকর্তাদের আগ্রহে এ সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়েছে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত সরকার নিতেই পারে। তবে এটা যথাযথভাবে পর্যালোচনা করা হয়েছে কি না, এ বিষয়ে সংশয় রয়েছে। নতুন ক্যাডার সৃজন বা একাধিক ক্যাডারের একীভূতকরণ সরকারের আওতাধীন কাজ। তবে চাকরির শর্তাবলি পরিবর্তিত হচ্ছে বিধায় সরকারি কর্ম কমিশনের মতামত সাংবিধানিকভাবে আবশ্যক।

সিদ্ধান্তটি সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন ও সংশয় সামনে আসে। প্রথমত, সচিবালয়ের সচিব থেকে সহকারী সচিবের পদগুলো নির্বিচারে প্রশাসন ক্যাডারের নয়। সহকারী সচিব পদে পদোন্নতির মাধ্যমেও কিছু নিয়োগের ব্যবস্থা আছে। আর উপসচিব ও যুগ্ম সচিব পদে যথাক্রমে ২৫ ও ৩০ শতাংশ পদ সংরক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে প্রশাসন ক্যাডার ব্যতীত অন্য ক্যাডারগুলোর জন্য। সেখানে ইকোনমিক ক্যাডারের কিছু কর্মকর্তাও কাজ করছেন। অবশ্য গত কয়েক বছরে মঞ্জুরীকৃত পদসংখ্যার অনেক বেশি সংখ্যায় পদোন্নতি দেওয়ায় সে অনুপাত রক্ষা করা গেছে বলে মনে হয় না। কিন্তু এখন সচিব পদে অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তা আছেন বেশ কয়েকজন। থাকাই যথার্থ। জানা যায়, মূল ক্ষোভটা ছিল একই সময়ে ইকোনমিক ক্যাডারের লাইন পদে পদোন্নতি না হওয়া নিয়ে। বিসিএসের সব ক্যাডারে একসঙ্গে একই ব্যাচের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি হয় না। মেধাক্রমও একটি মুখ্য বিবেচ্য বিষয় থাকে। তবে সচিবালয়ে সাম্প্রতিক কালে পদবিহীন পদোন্নতিগুলো এসব প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসার সুযোগ করে দিয়েছে। ইতিমধ্যে পুলিশেও এ ধরনের পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। দাবি আরও আসতে থাকবে। সেই রাস্তা খোলা হয়েছে সচিবালয় থেকেই। এখন ইকোনমিক ক্যাডার বিলুপ্তির পর পরিকল্পনা কমিশনের পদগুলোও হিসাবে আসবে। সেখানে এক বিভাগীয় প্রধানের স্থানে তিনজন অতিরিক্ত সচিব পদায়ন করা হলে বিস্মিত হব না। প্রশ্ন হলো, প্রকল্প দলিল কারা বানাবেন আর কারাই বা করবেন এর পর্যালোচনা ও চূড়ান্ত রূপ দেওয়ার কাজ।

প্রকল্প দলিল মূলত সংশ্লিষ্ট সংস্থা থেকে খসড়া করা হয়। এটার প্রয়োজনীয় পরিমার্জন হয় মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা কোষে। আর তৃতীয় নেত্রে দেখা হয় পরিকল্পনা কমিশনে। সেখানেই এটা হয় চূড়ান্ত। কমিশনের সদস্য পদে কখনো কখনো ইকোনমিক ক্যাডারের কেউ ছিলেন। তবে এখন পর্যন্ত পদগুলো উন্মুক্ত। সচিবদের থেকেই কিংবা চুক্তিতে এ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাঁরা একেকটি বিভাগের নেতৃত্বে থাকেন। সহায়তা করছিলেন ইকোনমিক ক্যাডারের কর্মকর্তারা। এ ছাড়া কমিশনে এসডিজি, এমডিজি, প্রেক্ষিত পরিকল্পনা আর পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাও চূড়ান্ত করা হয়। এরই অংশ হিসেবে তৈরি হয় বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা। ইকোনমিক ক্যাডারের কর্মকর্তারা তাঁদের বিশেষায়িত জ্ঞান দিয়েই প্রকল্প দলিল চুলচেরা বিশ্লেষণ করে সদস্যের কাছে উপস্থাপন করতেন। তারপর হয় প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভা। সে পর্যায়ে সবার মতামত নিয়ে প্রয়োজনীয় সংশোধনীসহ দলিলটি চূড়ান্ত করে পরিকল্পনামন্ত্রীর কাছে পেশ করা হয়। তাঁর আওতায় যেটুকু থাকে তাতে তিনি অনুমোদন দেন। বাকিগুলো পাঠান একনেকে। এই যাচাই-বাছাইয়ের কাজগুলো এখন আর বিশেষায়িত জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তিদের হাতে থাকছে না। এমনকি মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পের খসড়া তৈরির কাজেও থাকবেন সাধারণ ক্যাডারের সদস্যরাই। তা ছাড়া, এ ধরনের বিশেষায়িত জ্ঞানের কিছু কর্মকর্তা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন, পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) কাজের জন্যও আবশ্যক ছিল। ক্যাডারটি প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে একীভূত না করেও সুযোগ-সুবিধার কোনো অসমতা থাকলে তা দূর করা সম্ভব ছিল। যখন অনেক বড় বড় প্রকল্প আমাদের সামনে আসছে, তখন প্রয়োজন ছিল এ ক্যাডারটির আরও দক্ষতা বৃদ্ধি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ঘটল বিপরীতটা।

 বিসিএস ট্রেড ক্যাডারের মঞ্জুরীকৃত পদসংখ্যা এখন সাকল্যে ২৮, কর্মরত আছেন ১৫ জন। বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক যুগে বাণিজ্য একটি বিশেষায়িত বিষয়। এ বিষয়ে ধারাবাহিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তা অনেক প্রয়োজন। তাঁরা কাজ করতে পারেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, আমদানি ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোসহ নবগঠিত বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটিতে (বিডা)। এগুলোর হিসাব-নিকাশ করা না হলে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ব্যাহত হতে পারে।

ইকোনমিক ক্যাডার প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে একীভূতকরণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়েছে। এ পর্যায়ে হয়তো কিছু করার নেই। তবে বিকল্প খুঁজতে হবে। পদ-পদবি পরিবর্তিত হয়ে গেছে, সেটা যাক। প্রথম নিয়োগের পর মাঠ প্রশাসনের কাজ শেষ করে সচিবালয়ে নিয়োগ দেওয়ার সময় একটি অংশকে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়ন-সংক্রান্ত কাজের জন্য পৃথক করা চলে। তাঁরা পরিকল্পনা কমিশনসহ এ ধরনের কাজই করবেন। এতে কারও চাকরিতে পদোন্নতির সুযোগ হ্রাস পাওয়ার কথা নয়। বিশেষায়িত জ্ঞানসম্পন্ন কর্মকর্তাও কিছু থাকবেন।

মন্ত্রণালয়গুলো কয়েকটি গুচ্ছে বিভক্ত করার প্রস্তাবটিতে কোনো রাজনৈতিক বাধা থাকার কথা নয়। এতে কারও চাকরির সুযোগ-সুবিধাও হ্রাস পাবে না। ভারতের আইএএসদেরও এখন গুচ্ছের ভিত্তিতে পদায়ন করা হয়। প্রশাসন ক্যাডার সদস্যদের সব বিষয়ে কিছু কিছু ধারণা থাকতে হবে। তবে একটি বা দুটি বিষয়ে তাঁদের বিশেষ জ্ঞান বা অভিজ্ঞতার অধিকারী হতেই হবে। নইলে একপর্যায়ে তাঁদের প্রাসঙ্গিকতাই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে পারে।

আলী ইমাম মজুমদার, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
[email protected]