আফ্রিকা কেন গান্ধীর বিরুদ্ধে

ঘানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গান্ধীর ভাস্কর্য অপসারণ
ঘানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গান্ধীর ভাস্কর্য অপসারণ

গত ১২ ডিসেম্বর ঘানায় গান্ধীর ভাস্কর্য ভাঙার ঘটনা ‘সংবাদ’ হিসেবে পুরোনো হয়ে গেছে। তবে এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। গড়ার সময় থেকে এই ভাস্কর্য নিয়ে প্রতিবাদ চলছিল। ঘানার ঘটনার দুই মাস আগে মালাউইয়েও গান্ধীর ভাস্কর্য নির্মাণের একটি প্রকল্প বিক্ষোভের মুখে স্থগিত করেন আদালত। গান্ধীর অনেক জীবনীকারই বলেন, ভারত আফ্রিকাকে একজন মোহনদাস দিয়েছিল আর আফ্রিকা ফিরিয়ে দিয়েছে একজন ‘মহাত্মা’কে। কিন্তু এ মুহূর্তে পরিস্থিতি ভিন্ন। ২০১৬ থেকে আফ্রিকাজুড়ে গান্ধীকে নিয়ে বিতর্ক চলছে।

চীনকে মোকাবিলায় ভারত যখন গান্ধীর ইমেজ সামনে রেখে আফ্রিকায় ব্যাপক কূটনৈতিক আয়োজনে লিপ্ত, তার মধ্যেই শুরু ভাস্কর্যবিরোধী এই সামাজিক আন্দোলন। এই বছরই ভারতে উদ্যাপিত হচ্ছে গান্ধীর জন্মের দেড় শ বছর পূর্তি। ঠিক এই সময় গান্ধীবিরোধী মনোভাবের ঢেউ ভারতের জন্য অস্বস্তির।

একটি বই পরিস্থিতি বদলে দিল
গান্ধী আফ্রিকায় ২১ বছর কাটিয়েছিলেন। ২৩ বছর বয়সে তিনি সেখানে যান। ১৮৯৩ থেকে ১৯১৪ পর্যন্ত তাঁর আফ্রিকার দিনগুলো নিয়ে সম্প্রতি সাড়াজাগানো এক গবেষণা করেছেন অশিন দেশাই ও গোলাম ভাহেদ। তাঁরা উভয়েই আফ্রিকার সমাজ ও ইতিহাস বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। দেশাই জোহানেসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিদ্যা পড়ান এবং ভাহেদ খাওজুলু নাটাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক। ২০১৬ সালে প্রকাশিত ‘সাউথ আফ্রিকান গান্ধী: স্ট্রেচার বেয়ারার অব এম্পায়ার’ নামের তাঁদের গবেষণা নিয়ে দুই বছর ধরে ব্যাপক বিতর্ক চলছে। আফ্রিকায় ভারতীয়দের উপস্থিতির পুরোনো সব বয়ানকে চ্যালেঞ্জ করেছেন তাঁরা। গান্ধী সাদাদের বিরুদ্ধে কালোদের মুক্তির সংগ্রাম থেকে স্থানীয় ভারতীয়দের অধিকারের লড়াইকে পৃথকভাবে দেখতেন। এতে কীভাবে সাদারা লাভবান হচ্ছিল, সেটাই বইটির মুখ্য বিষয়।

আফ্রিকায় ভারতীয় নাগরিকদের অধিকার নিয়ে লড়াই করলেও গান্ধী মনে করতেন, ক্ষমতায় সাদাদেরই থাকা সংগত। দেশাই ও ভাহেদ দেখান, আফ্রিকায় তাঁর তৎপরতার সঙ্গে পরবর্তীকালে লেখা গান্ধীর আত্মজীবনীর মিল নেই। দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধী কালোদের নিয়ে এমন কিছু মন্তব্য করেছিলেন, যা বর্ণবাদী। ১৮৯৩ সালে নাটাল পার্লামেন্টকে লেখা এক চিঠিতে দেখা যায়, গান্ধী মনে করছেন, কালোদের চেয়ে আফ্রিকার ভারতীয়রা ‘উন্নত’। কালোদের তিনি ‘কাফির’ বলেছিলেন, এমনও প্রমাণ মেলে ১৯০৪-এর এক স্মারকলিপিতে। ১৯০৫-এ ডারবানে যখন প্লেগ লাগে, গান্ধী তার জন্য দায়ী করেন ‘নোংরা’ আফ্রিকানদের। ‘নেটিভ’ কালোদের থেকে ভারতীয়দের পৃথকভাবে বাস করার সুপারিশ ছিল তাঁর।

এসব ইতিহাসের ওপর দাঁড়িয়ে তরুণেরা এখন বলছে, গান্ধীকে আদর্শ হিসেবে আফ্রিকায় মানায় না আর। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভাস্কর্য আফ্রিকার নায়কদেরই গড়া উচিত, কোনো বর্ণবাদীর নয়। ক্রোধের ভাবাবেগে এ–ও বলা হচ্ছে, আফ্রিকায় গান্ধীর ভাস্কর্য থাকলে ভারতে ১৯১৯-এ জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা ব্রিটিশ সামরিক কর্মকর্তা কর্নেল ডায়ারের মূর্তি স্থাপনেও আপত্তি ওঠা উচিত হবে না!

তবে আফ্রিকায় সবাই গান্ধীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেছে, এমন নয়। দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধীর ভাস্কর্য প্রথম গড়েছিলেন খোদ নেলসন ম্যান্ডেলা ১৯৯৩ সালে। এখনো আফ্রিকাজুড়ে গান্ধীর অহিংসার দর্শনের প্রচুর অনুরাগী। তাঁদের মতে, জীবনের শুরুতে করা কালোদের বিরুদ্ধে কিছু মন্তব্য দিয়ে গান্ধীর পুরো জীবন ও অবদানকে বিচার করা সংকীর্ণতা হবে। অন্তত ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার মতো নজির স্থাপন অপ্রয়োজনীয়। গান্ধীর এই মন্তব্যগুলো হয়তো কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতাড়িত ছিল, যা ক্ষমার যোগ্য এবং বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে বিচারযোগ্য নয়। এসব মন্তব্য এড়িয়েও গান্ধীর মূল্য আছে। গান্ধী নিজেও সাদাদের বর্ণবাদী সামাজিক নীতির দ্বারা বহু সময় নির্যাতিত হয়েছেন।

আফ্রিকায় চীন-ভারত ‘যুদ্ধ’ ও গান্ধী
২০১৬ সালের ১৬ জুন ঘানায় গান্ধীর ভাস্কর্যটি উন্মুক্ত করেছিলেন তখনকার ভারতীয় রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি। ভারতীয় অনুদানে এটি নির্মিত। এ সময় ঘানা থেকে বহুদূরের মালাউইয়েও গান্ধীর ভাস্কর্য তৈরি হচ্ছিল ভারতের সহায়তায়। বহুকাল ধরে আফ্রিকার দক্ষিণে গান্ধীকে সামনে রেখে ভারত প্রভাব বাড়াতে তত্পর। আফ্রিকার অনেক দেশেই দুই-তিন প্রজন্ম ধরে ব্যবসায় ভারতীয়রা প্রভাবশালী। এই প্রভাবকে ভূরাজনৈতিকভাবে আরেক ধাপ এগিয়ে নিতে দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসে গান্ধীর উপস্থিতিকে ভারত ব্র্যান্ডিং করতে চাইছে মহাদেশজুড়ে। ওই অঞ্চলের অনেক শহরে গান্ধীর ভাস্কর্য নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ভারত ২০১৮-এর জুলাইয়ে জানিয়েছে, আফ্রিকায় তাদের দূতাবাসের সংখ্যা ২০২১ সালের মধ্যে ১৮টি বাড়িয়ে ৪৭-এ উন্নীত করা হবে। চীন ইতিমধ্যে যা ৫০ করেছে।

আফ্রিকার ৫৪ দেশে চীনের বাণিজ্যের আকার ভারতের চেয়ে তিন গুণ বড়। তবে নয়াদিল্লি এই অবস্থা বদলাতে তত্পর। ২০১৬ সালে প্রণব মুখার্জির ঘানা সফর ছিল সেই লক্ষ্যে নতুন অভিযানের শুরু। কিন্তু আক্রায় গান্ধীর ভাস্কর্য উদ্বোধনের কিছুদিন পরই তার খানিকটা ভেঙে দেয় শিক্ষার্থীরা। পরে স্থানীয় শিক্ষকেরাও এর অপসারণের আন্দোলনে যুক্ত হন। অনলাইনে শুরু হয় হ্যাশট্যাগযুক্ত ‘গান্ধী মাস্ট ফল’ প্রচারণা। শেষ পর্যন্ত ভাস্কর্যটি ভাঙতেই হয়।

মালাউই ও ঘানার সরকার এবং আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমগুলো এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য লুকাচ্ছে। মালাউইয়ের আন্দোলনকারীরা জানিয়েছেন, গান্ধী কোনো দিন সেখানে যাননি, কেবল ভারতের প্রভাব দৃষ্টিগ্রাহ্য করতে তাঁদের রাজধানীতে ভাস্কর্য তৈরি হচ্ছিল। ভাস্কর্য প্রকল্পটি ছিল বিশাল আকারের এক বাণিজ্যিক চুক্তির প্রচ্ছদ মাত্র, জনদাবি সত্ত্বেও যে চুক্তির বিস্তারিত প্রকাশ করেনি সরকার।

একইভাবে আক্রার কালো তরুণেরাও শুধু ব্যক্তি গান্ধীর বিরুদ্ধে আন্দোলন করছিল না, নিজ দেশ থেকে ইউরো-এশিয়ান ভাবাদর্শের অবসান চাইছিল। এই তরুণেরা আফ্রিকায় ইউরোপীয় ও ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে বলছে। এই আধিপত্যের রেশ ইতিহাসের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে সমাজে ব্যাপকভাবে আছে এখনো। ব্রিটিশ ও ফরাসি অধীনতার সময় আফ্রিকায় শিল্প স্থাপনের নামে বিপুল জমি ভারতীয়দের দখলে যায়। তার অনেকাংশই এখনো বহাল তবিয়তে ভারতীয়দের হাতে আছে। এই বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়েই মূর্তি ভাঙার ক্ষোভটি বোঝা দরকার।

আফ্রিকায় উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামে নির্যাতিতরা তাদের পাশে দেখেনি ভারতীয়দের। আফ্রিকার আজকের তরুণেরা তাদের নতুন জানাশোনা নিয়েই গান্ধীকে সহ্য করতে পারছে না। তারা বলছে, রাজনৈতিক চিন্তা ও আদর্শে যদি সংশোধন ও প্রত্যাখ্যান থাকতে পারে, তাহলে সাহিত্য-গান-ভাস্কর্যের মতো প্রতীককে ঘিরেও তা থাকতে হবে। এ রকম যুক্তিতর্কের মধ্যেই দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধীর একটি ভাস্কর্য সাদা রঙে মুড়ে দেওয়া হয় ২০১৫ সালে। স্পষ্টত বিনিয়োগ ও বর্ণবাদকে একসঙ্গে আর নিতে চাইছে না আফ্রিকা।

কালোদের এই ক্ষোভ গত বছর অন্য গোলার্ধেও আঘাত হানে। কানাডায় জুলাইয়ে আফ্রিকান স্টাডিজ স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন বিক্ষোভ করেছে কার্লেটন ক্যাম্পাস থেকে গান্ধীর ভাস্কর্য সরানোর জন্য। ঘানার ঘটনায় অনুপ্রাণিত অটোয়ার আফ্রিকান শিক্ষার্থীদের এক নেতা বলেন, ইতিহাসের পুনঃপাঠ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই শুরু হওয়া উচিত। ২০১৬-এর অক্টোবরে ক্যালিফোর্নিয়াতেও গান্ধীর ভাস্কর্য স্থাপনের বিরুদ্ধে অনুরূপ গণবিক্ষোভ হয়।

প্রতিবাদের নৈতিক শক্তি নেই ভারতের
ভারতে ক্ষমতাসীন বিজেপি গান্ধীপন্থী দল না হলেও ঘানা, মালাউই ও অটোয়ার ঘটনা দেশটির অনেকের জন্যই বিব্রতকর। আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত না হলেও ভারতে মোহনদাস করমচাদ গান্ধী জাতির পিতৃতুল্য। কিন্তু ভারতের তরফ থেকে এই ঘটনায় প্রতিবাদ জানানোর নৈতিক শক্তিতে টান পড়েছে। কিছুদিন আগে ত্রিপুরার বিলোনিয়া কলেজ স্কয়ার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে লেনিনের ভাস্কর্য নামানো হয়েছে। দক্ষিণ ভারতে দ্রাবিড় জাতীয়তাবাদী রামস্বামী পেরিয়ার এবং উত্তর ভারতে বি আর আম্বেদকরের ভাস্কর্যও দেশটিতে বহুবার আক্রান্ত হয়েছে গত বছর।

গান্ধীর বিরুদ্ধে আফ্রিকায় বর্ণবাদী মন্তব্যের অভিযোগ থাকলেও লেনিন-আম্বেদকর-পেরিয়ারের বিরুদ্ধে হাতুড়ি হাতে নেওয়া হিন্দুত্ববাদীরা তেমন কোনো অভিযোগ তোলেনি। এই অন্ধ জাতীয়তাবাদী জিঘাংসা আফ্রিকায় পাথুরে ভাস্কর্য ভাঙার বহু আগে খোদ গান্ধীকেই একদা হত্যা করেছিল ভারতে। আফ্রিকায় গান্ধীর দ্বিতীয় মৃত্যুযাত্রায় ভারত তাই শোকও প্রকাশ করতে পারছে না।

আলতাফ পারভেজ: ইতিহাস গবেষক