গায়েবি মামলায় আর কত দিন আটক

বিদায়ী বছরের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হলেও নতুন বছরেও তার রেশ আছে এবং থাকবে বহুদিন। তবে সেই রেশ চলমান বিভেদাত্মক রাজনীতিতে বৈরিতা আরও বাড়াবে, না একটি সহনীয় পরিবেশ তৈরি করবে, তা নির্ভর করছে ক্ষমতাসীনদের ওপরই। বর্তমানে বিরোধী দল এতটাই দিগ্ভ্রান্ত ও ভঙ্গুর অবস্থায় আছে যে এই মুহূর্তে তাদের বেশি কিছু করার আছে বলে মনে হয় না।

বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ১১টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে। কোনো নির্বাচনই বিতর্ক ছাড়েনি। বিজয়ী পক্ষ সব সময় নির্বাচনকে তাদের পক্ষে বিপুল জনরায় বলে ঘোষণা করেছে, আর বিজিত পক্ষ কখনো সূক্ষ্ম কারচুপি, কখনো স্থূল কারচুপির অভিযোগ এনেছে কিংবা ষড়যন্ত্রের কুশীলবদের খুঁজে বের করার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়েছে।

এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ তথা মহাজোটের ২৮৮ এবং একজন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য বৃহস্পতিবার শপথ নিলেও বিএনপি তথা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের বিজয়ী সাতজন সদস্য শপথ নেননি। তাঁরা বলেছেন, ‘যে নির্বাচন আমরা প্রত্যাখ্যান করেছি, সেই নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদে বসতে পারি না। আমরা শপথ নেব না।’ তবে বিএনপির সমর্থনে জয়ী একজন স্বতন্ত্র সদস্য বৃহস্পতিবার অন্যদের সঙ্গে শপথ নিয়েছেন।

বিরোধী দলের নির্বাচিত সাংসদদের শপথ নেওয়া কিংবা না নেওয়ার ঘটনা বাংলাদেশের গতিপথ বদলে দিতে পারবে তা কেউ বিশ্বাস করেন না। বরং বিজয়ী দল বিজিতের প্রতি কী রকম আচরণ করে, কতটা সহনশীলতা দেখায়, তার ওপরই নির্ভর করবে রাজনীতির গতিবিধি।

এই মুহূর্তে বিএনপির সামনে নির্বাচনে পরাজয়ের চেয়েও বড় চ্যালেঞ্জ হলো দলীয় নেতা-কর্মীদের মামলা-হামলা ও জেল-জুলুম থেকে রক্ষা করা। ২০১৩-১৪ সালে এবং ২০১৫ সালের প্রথম তিন মাস বিএনপি-জামায়াত জোট নির্বাচন ঠেকানো কিংবা অবরোধ কর্মসূচির সময় যে ভয়াবহ সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে, তা মিথ্যা নয়। তবে সে সময় যারা বাসে বোমা কিংবা আগুনসন্ত্রাস চালিয়ে মানুষ হত্যা করেছে, খুব কম ক্ষেত্রে আমাদের করিতকর্মা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের পাকড়াও করতে পেরেছে। তারা ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রে হুকুম পালনকারীকে না ধরে হুকুমদাতাকে নিয়ে টানাটানি করেছে। ফলে নাশকতার মামলাগুলো এখনো ঝুলে আছে। বিচার হয়নি।

কিন্তু ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে সারা দেশে পুলিশ যেসব নাশকতা, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও ভাঙচুরের মামলা দিয়ে বিএনপির নেতা-কর্মীদের পাইকারিভাবে গ্রেপ্তার-হয়রানি করেছে, সেসবের অস্তিত্বই ছিল না। নির্বাচনের আগে প্রথম আলোয় ‘এক ভয়ংকর সেপ্টেম্বর’ শিরোনামে ঢাকা শহরের নাশকতার মামলা নিয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ পায়। এতে বলা হয়, ওই মাসে ঢাকায় নাশকতার মামলা হয়েছে ৫৭৮টি, যার মধ্যে পুলিশের ওপর হামলার কথা বলা হয়েছে ৯০ বার। আর পেট্রলবোমা ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনার কথা বলা হয়েছে ১ হাজার ১৮৬টি। অথচ রাজধানীর দেড় কোটি মানুষ কিছুই টের পেল না। শুধু ঢাকা শহরে নয়, প্রতিটি জেলা ও উপজেলাতেই এ ধরনের হাজার হাজার মামলা হয়েছে। বিএনপির বহু নেতা–কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নির্বাচনের আগে কয়েকটি জেলা শহরে গিয়েছিলাম ‘ভোটচিত্র’ দেখতে। প্রায় সবখানে ভোটের আওয়াজ চাপা পড়ে গিয়েছিল মামলা–গ্রেপ্তার আতঙ্কে। সাংবাদিক বন্ধুরা জানিয়েছেন, সারা দেশেই এ ধরনের গায়েবি মামলা হয়েছে।

২০১৮ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকার অধিকতর সতর্ক ছিল, যাতে বিরোধী পক্ষ ২০১৩ ও ২০১৪-এর মতো নাশকতার ঘটনা না ঘটাতে পারে। এটি দোষের কিছু নয়। কিন্তু যেখানে বিএনপিসহ সব দল নির্বাচনে অংশ নিয়েছে, কেউ বানচাল করার কথা বলেনি, সেখানে ষড়যন্ত্র বা নাশকতার ভূরি ভূরি মামলা হলো কেন? আওয়ামী লীগের নেতারা মুখে যতই বিএনপিকে নির্বাচনে আসার আহ্বান জানিয়ে থাকুন না কেন, হাবভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন, তারা না এলেই ভালো। নির্বাচনের দিনও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা কর্মীদের এই বলে সতর্ক করে দিলেন যে বিএনপি শেষ মুহূর্তে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়ে গোলযোগ বাধাতে পারে।

কিন্তু বিএনপি সে রকম কোনো ঘোষণা দেয়নি। দলের ১১ জন প্রার্থীসহ অসংখ্য নেতা–কর্মীকে জেলে রেখে এবং ১৭ জন প্রার্থী আক্রান্ত হওয়ার পরও তারা শেষ পর্যন্ত নির্বাচনী লড়াইয়ে ছিল। কোথাও নাশকতার ঘটনা ঘটলে আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে, অপরাধীর বিচার হবে এ বিষয়ে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। নয়াপল্টনে বিএনপির অফিসের সামনে গাড়ি পোড়ানো ও ভাঙচুরের ঘটনা মনে রেখেই কথাটি বলছি। কিন্তু যেসব ক্ষেত্রে ঘটনাই ঘটেনি, ঘটনার বিন্দুমাত্র আলামতও ছিল না, সেখানে কেন গ্রেপ্তার ও মামলা দিয়ে নেতা-কর্মীদের হয়রানি করা হলো সেই প্রশ্নের উত্তর কেবল নির্বাচন কমিশন ও ‘নির্বাচনকালীন সরকারই’ দিতে পারে।

গায়েবি মামলার একটি ছোট্ট উদাহরণ দিই। খবরে বলা হয়, বিএনপির সমাবেশে যাওয়ার পথে সিঙ্গাইর থানার গোবিন্দ নতুন বাজার মোড়ে বাসসহ আটক শিবালয় উপজেলার ৩৪ জন নেতা-কর্মীর জামিন হয়েছে। গতকাল (বৃহস্পতিবার) মানিকগঞ্জ জেলা দায়রা জজ তাঁদের জামিন মঞ্জুর করেন। ৬ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপির সমাবেশে যাওয়ার পথে তাঁদের আটক করা হয়েছিল। এরপর ১১ নভেম্বর তাঁদের দুদিনের জন্য রিমান্ডে নেওয়া হয়। (ইত্তেফাক, ৪ জানুয়ারি ২০১৯)

একটি উপজেলা থেকে যদি বিএনপির ৩৪ জন নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হয়ে থাকেন, সারা দেশে কত নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন, তা সহজে অনুমান করা যায়। এর আগে ১২ ডিসেম্বর প্রথম আলোর খবরে ছিল: নাশকতার পুরোনো মামলায় ঢাকায় বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার অব্যাহত রয়েছে। এর মধ্যে গত দুদিনে গ্রেপ্তার ১১২ জনকে আদালতে হাজির করা হয়েছে। গ্রেপ্তার লোকজনকে ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানায় হওয়া নাশকতার মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। গ্রেপ্তার বিএনপির ১১২ জন নেতা-কর্মীর মধ্যে আজ বুধবার ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালতে হাজির করা হয় ৫১ জনকে।

নির্বাচনের এক দিন আগে ২৯ ডিসেম্বর যুগান্তর-এর খবর: গাইবান্ধায় বিএনপি-জামায়াতের ৩৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এর মধ্যে বিএনপির ১২, জামায়াতের ১৯ এবং শিবিরের ৭ জন নেতা-কর্মী রয়েছেন। বগুড়ার শেরপুরে নাশকতা পরিকল্পনার অভিযোগে উপজেলা চেয়ারম্যানসহ জামায়াত-বিএনপির ৮ নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। চাঁদপুর -৪ ফরিদগঞ্জ আসনে বিএনপির প্রার্থী লায়ন হারুনুর রশিদের বাড়িতে শুক্রবার হামলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ সময় বিএনপির কর্মীরা প্রতিরোধ করলে উভয় পক্ষের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হয়। পরে পুলিশ বিএনপির নেতা-কর্মীসহ ১৩ জনকে আটক করেছে। বরিশালের গৌরনদীতে বিএনপির প্রার্থী এম জহিরউদ্দিন স্বপনের বাড়ি থেকে বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের ১৯ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। পাবনার সাঁথিয়া উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আশরাফ আলীসহ বিএনপি-জামায়াতের ১৪ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে থানা-পুলিশ।

এর আগে নির্বাচন কমিশনের হস্তক্ষেপ চেয়ে বিএনপি চিঠি দিয়েও কোনো প্রতিকার পায়নি। চিঠিতে বলা হয়েছিল, গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে একের পর এক রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মিথ্যা ও গায়েবি মামলা দিয়ে বিএনপির নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার ও হয়রানি করা হচ্ছে। ৮ নভেম্বর তফসিল ঘোষণার পর থেকে দেশব্যাপী বিএনপির নেতা-কর্মীদের মিথ্যা মামলা দেওয়া হচ্ছে এবং শত শত নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।

নির্বাচনের পর বিএনপি ফলাফল প্রত্যাখ্যান করলেও কোনো ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি নেয়নি। তারা নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রতিবাদ করছে, নির্বাচন কমিশনে স্মারকলিপি দিয়েছে, নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারপরও বিভিন্ন স্থানে বিএনপির প্রার্থী ও নেতা-কর্মীদের বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটেছে। ঢাকা-১০-এ বিএনপির প্রার্থী আবদুল মান্নানের বাড়িতে হামলার ঘটনা তিনি থানায় মামলা দিতে গেলে থানা তা নেয়নি। এটি কী ধরনের আইনের শাসন?

নির্বাচনের আগে বিএনপির নেতা-কর্মীদের নামে যত নাশকতার মামলা দেওয়া হয়েছে, সেগুলো সত্যি সত্যি ঘটলে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে লিবিয়া-ইরাক-আফগানিস্তান হয়ে যাওয়ার কথা। নির্বাচনের আগে দেশে একটি অস্বাভাবিক অবস্থা চলছিল। সেটি স্বাভাবিক করতে এখনই এসব গায়েবি মামলা তুলে নেওয়া প্রয়োজন। এসব গয়রহ মামলায় যাঁরা আসামি, তাঁদের অবিলম্বে মুক্তি দেওয়া হোক। এবং এটাই হতে পারে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি নতুন বছরে নতুন সরকারের কিঞ্চিৎ সদিচ্ছার প্রকাশ।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]