বাণিজ্যনীতি সংশোধন করতে হবে

নতুন বছর। সঙ্গে নতুন মেয়াদে ধারাবাহিকতার সরকার। এ দুইয়ের সমন্বয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য স্বাভাবিকভাবেই কিছু প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে আছে কিছু প্রতিকূলতা ও কিছু সুযোগ। উচ্চহারে প্রবৃদ্ধি, নিম্নহারের মূল্যস্ফীতি, জোরালো আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, ভালো কৃষি ও শিল্প উৎপাদন ইত্যাদি ইতিবাচক অনেকগুলো সূচক নিয়ে নতুন বছরের যাত্রা শুরু হয়েছে। যেহেতু সরকারের ধারাবাহিকতা বজায় থাকছে, সেহেতু বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডেও কোনো ছেদ পড়বে না বলে প্রত্যাশা করা যায়। ব্যবসা-বাণিজ্যের স্থিতিশীল পরিবেশও বজায় থাকবে। সব মিলিয়ে অর্থনীতিতে এক অনুকূল পরিস্থিতি বিরাজ করছে, যা সামনের দিনগুলোতেও অটুট থাকবে বলে মনে হয়।

পাশাপাশি নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে খেলাপি ঋণসহ আর্থিক খাত, বিশেষ করে ব্যাংক খাতের নাজুক হয়ে পড়া, কিছু কিছু উন্নয়ন প্রকল্পে অযৌক্তিক, অতিরিক্ত ব্যয়ের চাপ ও শোভন কর্মসংস্থানের অভাব সার্বিক অর্থনীতির তিনটি বড় নেতিবাচক দিক হিসেবে দেখা দিয়েছে।

এ রকম একটা অবস্থায় নতুন বছরটিতে অর্থনীতি-সংশ্লিষ্ট যেসব নীতি ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে, তার ওপর আগামী পাঁচ বছরের দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের ভবিষ্যৎ বহুলাংশে নির্ভর করবে। শিগগিরই বাংলাদেশ ব্যাংককে ষাণ্মাসিক মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে হবে। আবার ছয় মাসের মধ্যেই ঘোষিত হবে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট, যেখানে রাজস্বনীতি, বিনিয়োগনীতি ও শুল্কনীতি তথা বাণিজ্যনীতির প্রতিফলন ঘটবে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের বাণিজ্যনীতি অনেকাংশেই প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও সংশোধনের মধ্য দিয়ে যায়নি; বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাময়িক কিছু পদক্ষেপ ও পক্ষপাতমূলক নীতি-প্রণোদনা কোনো কোনো খাতের জন্য বাড়তি সুবিধা বয়ে আনলেও সার্বিকভাবে তার ইতিবাচক ফল ছিল সীমিত।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের হিস্যা এখন ৪০ শতাংশ। শুধু আমদানি নীতি ও রপ্তানি নীতিকে কিছুটা অদল-বদল করা হলেই বাণিজ্যনীতির পুনর্বিন্যাস হয় না। বাংলাদেশে তিন বছরমেয়াদি রপ্তানি নীতি ইতিমধ্যে হালনাগাদ করা হয়েছে আগামী তিন বছরের (২০১৮-২১) জন্য। আমদানি নীতি আদেশের মেয়াদ শেষ হলেও এখনো হালনাগাদের ঘোষণা আসেনি। অন্যদিকে বাণিজ্যনীতির সবচেয়ে বড় হাতিয়ার আমদানি শুল্ককাঠামো এখনো একধরনের রক্ষণশীলতার চক্করে ঘুরপাক খাচ্ছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) হিসাব অনুসারে বাংলাদেশের গড় আমদানি শুল্ক ১৪ শতাংশ, যেখানে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সবগুলো দেশের ক্ষেত্রে এই হার ৭ শতাংশ। আবার ডব্লিউটিওতে বাংলাদেশের ঘোষিত সর্বোচ্চ গড় শুল্কহার হলো ১৫৫ শতাংশ, যেখানে এই অঞ্চলের গড় হার প্রায় ২৭ শতাংশ। বলা হয়ে থাকে, উচ্চ শুল্কহারের দিক থেকে বাংলাদেশ পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম। মূল শুল্কের সঙ্গে নিয়ন্ত্রণমূলক ও সম্পূরক শুল্ক আরোপ করে বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে কার্যকর শুল্কহার ১০০ শতাংশের ওপর চলে যায়। এতে করে আমদানির ব্যয় বাড়ে ও ভোক্তাদের বাড়তি দামে বিভিন্ন পণ্য কিনতে হয়।

উচ্চ শুল্কহারের সমর্থনে প্রধান যুক্তি হলো, স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা দেওয়া। কাজটি প্রয়োজনীয় হলেও জটিল। কত বছর ধরে কোন কোন শিল্পকে এই সুরক্ষা দেওয়া হবে, তা নির্ণয় করা সব সময় সহজসাধ্য নয়। সাধারণভাবে স্থানীয় যেকোনো শিল্পই সব সময় সুরক্ষা পেতে চায় আর তা হলো প্রতিযোগী সমমানের পণ্য আমদানিতে উচ্চহারে শুল্কারোপের মাধ্যমে। এটিই বহুল চর্চিত ও সহজ পথ। এতে করে একই ধরনের দেশি ও বিদেশি পণ্যের দাম বেড়ে যায়। উচ্চ শুল্কের কারণে বাড়ে বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের দাম, আর সেই দামের কাছাকাছি দরে বিক্রি হয় দেশীয় পণ্য। এতে করে রাষ্ট্রের কোষাগারে কিছু অর্থ যোগ হয় আর স্থানীয় উৎপাদকও বাড়তি মুনাফা করতে পারে। কিন্তু ভোক্তাসাধারণকে বেশি দামে পণ্য কিনতে হয়।

উচ্চ ও জটিল শুল্ককাঠামোর কারণে বাংলাদেশ নানা প্রয়াস নিয়েও এখন পর্যন্ত কোনো দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করতে পারেনি। এ ধরনের চুক্তিতে দুই পক্ষকেই ছাড় দিতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশি ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা অন্য দেশের বাজারে পণ্য রপ্তানিতে সুবিধা নিতে চাইলেও নিজ দেশের বাজারে সহজে ছাড় দিতে রাজি নন। সরকারও এ নিয়ে একটা পর্যায়ের পর আর অগ্রসর হতে উৎসাহী হয় না।

আবার বিদ্যমান বাণিজ্যনীতিতে রপ্তানিকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। মনে করা হয় যে রপ্তানি বাড়ানো গেলেই তা অর্থনীতির জন্য ভালো। কিন্তু দেশের রপ্তানিমুখী শিল্পগুলো কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্যের জন্য অনেকাংশে আমদানিনির্ভর। সুতরাং আমদানি ব্যয়-সাশ্রয়ী না হলে উৎপাদন ব্যয় বাড়ে, তা আবার রপ্তানির ব্যয়ও বাড়ায়। তাতে প্রকৃত রপ্তানি আয় কমে যায়।

সর্বোপরি বাংলাদেশের বাণিজ্যনীতি এখনো স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) আলোকে পরিচালিত হচ্ছে। অথচ এক দশকের মধ্যে বাংলাদেশ এলডিসির কাতার থেকে বেরিয়ে আসবে। তখন এলডিসি হিসেবে পাওয়া বাণিজ্য–সুবিধাগুলো আর বহাল থাকবে না; বরং ভারতের মতো উদীয়মান উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করতে হবে শুল্ক দিয়ে। এ বছরের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহেডব্লিউটিওতেবাংলাদেশের বাণিজ্যনীতি পর্যালোচনা করা হবে। সেখানে  বাণিজ্য অংশীদার ও প্রতিযোগী দেশগুলোর বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসা থাকবে। এলডিসি হিসেবে এটাই হবে ডব্লিউটিওতেবাংলাদেশের বাণিজ্যনীতির শেষ পর্যালোচনা। তাই এলডিসি-পরবর্তী সময়ে কীভাবে বাংলাদেশের শুল্ক ও বাণিজ্যনীতি পরিচালিত হবে, সে আভাসও খোঁজা হবে এই বৈশ্বিক পর্যালোচনায়। 

সব মিলিয়ে এসব বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে বাণিজ্যনীতি সংশোধন ও পরিবর্তন করার কোনো বিকল্প বোধ হয় নেই। নতুন বছরে সেই সংশোধন ও পরিবর্তন কীভাবে ও কোন পথে হয়, তা জানতে কিছুটা অপেক্ষা করতে হবে।

আসজাদুল কিবরিয়া, সাংবাদিক
[email protected]