শেখ হাসিনার ব্যাখ্যা ও তিন সম্ভাবনা

নরেন্দ্র মোদি, রাহুল গান্ধী
নরেন্দ্র মোদি, রাহুল গান্ধী

আরও পাঁচ বছরের জন্য দেশ শাসনের ছাড়পত্র আদায়ের পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হাসিকেও কানছোঁয়া করে দিলেন। দলের জয় ও বিরোধীপক্ষের শোচনীয় হারের পেছনে যে যুক্তি তিনি দিয়েছেন, আর চার মাসের মধ্যে ভারতের লোকসভা ভোটে সেই কারণ যে বড় হয়ে উঠবে না, কে বলতে পারে?

বিজয় নিয়ে শেখ হাসিনার ব্যাখ্যায় উঠে এসেছিল ভারতীয় রাজনীতির প্রসঙ্গ। খবরের কাগজে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী সেই ব্যাখ্যায় তিনি ইন্দিরা হত্যার পর রাজীব গান্ধীর বিপুল জয়ের উল্লেখ করে বলেছিলেন, সেই ভোটে বিজেপি পেয়েছিল মাত্র দুটি আসন। কেউ তখনো ভাবেনি, একদিন সেই বিজেপি ভারত শাসন করবে। দেশজ বিরোধীদের প্রতি তাঁর বাণী, অতএব আশা হারানোর কিছু নেই। ঠিকমতো কাজ করে গেলে মানুষ তাঁদেরও কাছে টেনে নেবে। সেই বিজেপি গত ভোটে কী করে একার ক্ষমতায় দেশ শাসনের অধিকার পেল? কেন শতাব্দীপ্রাচীন কংগ্রেস ওইভাবে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল? গণভবনে বসে হাসিনা সেই ব্যাখ্যা শুনিয়ে বলেছেন, নেতৃত্বের প্রশ্নটি কংগ্রেস ঊহ্য রেখেছিল। দেশবাসীকে তারা জানাতে পারেনি, ভোটে জিতলে ওদের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন। মানুষ তাই ওদের ভোট দেয়নি।

হাসিনার এই যুক্তি ও ব্যাখ্যা আজ অনেক দিন ধরেই বিজেপির মোক্ষম হাতিয়ার। পাঁচ বছরে তাদের চাকচিক্য ও জৌলুশ ফিকে হয়েছে। মোদি-ম্যাজিকও অনেকটাই ভ্যানিশ। এসব মেনে নিয়েও পুনরুজ্জীবিত কংগ্রেস ও তাদের সম্ভাব্য জোটসঙ্গীদের মোকাবিলায় বিজেপির তুরুপের তাস ওই নেতৃত্ব। অগোছালো বিরোধীদের সামনে নরেন্দ্র মোদিকে দাঁড় করিয়ে তারা বুক ফুলিয়ে বলতে পারছে, আমাদের প্রধানমন্ত্রী ইনিই, কিন্তু তোমাদের কে? সন্দেহ নেই, ভোটের দিন বহু মানুষের মনে এই প্রশ্ন বড় হয়ে উঠতে পারে। তা যাতে হয়, বিজেপির চেষ্টার অন্ত নেই।

সেই দিক থেকে দেখলে শেখ হাসিনার ওই ব্যাখ্যা কংগ্রেসের জন্যও একটা বার্তা। দলের সভাপতি হওয়ার পর এক বছরে রাহুল গান্ধী কতখানি বদলে গেছেন, দেশের মানুষ তা দেখছে। বিজেপিও ঠারেঠোরে স্বীকার করছে, আজকের রাহুল ও বছর কয়েক আগের ‘পাপ্পু’ এক নন। বৃষ্টির ঝাপটা খাওয়া মাচানের লাউডগার মতো কংগ্রেসও লকলকিয়ে উঠেছে। গুজরাটে শাসক দলকে নাকানিচুবানি খাইয়েছে। কর্ণাটক হাতছাড়া হতে দেয়নি। ছিনিয়ে নিয়েছে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়। কড়া মোকাবিলার মুখে বিজেপিকে রাহুলের কংগ্রেস দাঁড় করিয়েছে আর্যাবর্তে। কিন্তু তা সত্ত্বেও হাসিনার বার্তা মেনে কংগ্রেসের কেউ প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রশ্নের হেঁয়ালির চাদরটা সরানো প্রয়োজন মনে করছে না। বিষয়টিকে ঊহ্য রেখেই বরং তারা মোদির মোকাবিলায় নামার সিদ্ধান্তে অটল। তারা মনে করছে, আজকের ভারতে এই রণনীতিই শ্রেষ্ঠ। কংগ্রেসের এই মনোভাবের পেছনে যুক্তি যে একেবারেই নেই, তা নয়। তারা জানে, এখনো বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক দলের নেতারা রাহুলের নেতৃত্ব মানতে রাজি নন; যেমন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যেমন মায়াবতী। কিছুটা শারদ পাওয়ারও। কিছুটা অনীহা রয়েছে চন্দ্রবাবু নাইডুরও। চন্দ্রশেখর রাও বা নবীন পট্টনায়ক ভোটের পর বিজেপির দিকে ঝুঁকবেন—এমন একটা ধারণাও কংগ্রেসের মনে গেড়ে বসছে। এই অবস্থায় আগেভাগে প্রধানমন্ত্রিত্বের দান খেললে হিতে বিপরীত হতেই পারে। তাই চুপ থাকাই সেরা উপায়। কংগ্রেস মহলে এই মুহূর্তের বিশ্বাস, বিজেপি যদি ২০০ আসনের কাছেপিঠে ঘোরাফেরা করে, তাহলে নরেন্দ্র মোদিকে প্রধানমন্ত্রী রেখেই তারা সরকার গড়ার জন্য ঝাঁপাবে। কিন্তু সংখ্যাটা ১৭০-এ নেমে গেলে শরিক ও সম্ভাব্য জোটসঙ্গীদের কাছে মোদির গ্রহণযোগ্যতা কমে যাবে। সে ক্ষেত্রে সংঘ-ঘনিষ্ঠ নাগপুরের নিতিন গড়কড়ি কিংবা উত্তর প্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী রাজনাথ সিং প্রাধান্য পেতে পারেন। কংগ্রেসের ধারণা, ওই অবস্থায় সরকার গড়লেও তা স্থিতিশীল হতে পারবে না।

আগের ভোটে সারা দেশে কংগ্রেসের সমর্থন তলানিতে পৌঁছেছিল। জুটেছিল মাত্র ৪৪টি আসন। গোটা দেশেই প্রায় ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গিয়েছিল দলটা। এক বছর ধরে রাহুলের তেড়েফুঁড়ে ওঠা এবং বিজেপির কাছ থেকে তিনটি রাজ্য ছিনিয়ে নেওয়া কংগ্রেসের কাছে মৃতসঞ্জীবনী সুধার কাজ করেছে। দলটার বিশ্বাস, যেভাবে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তারা ফিরে এসেছে এবং উত্তর প্রদেশ বাদ দিলে গোবলয়ে যেভাবে তারা বিজেপির বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়েছে, তাতে গতবারের তুলনায় তিন গুণ আসন বেশি পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু ১২০ থেকে ১২৫ আসন পেলেও সরকার গড়ার পক্ষে তা যথেষ্ট নয়। কংগ্রেসের বড় অংশের মনোভাব, ওই পরিস্থিতিতে বিজেপিকে রুখতে তৃতীয় কোনো পক্ষকে বাইরে থেকে সমর্থন দেওয়া উচিত সিদ্ধান্ত হবে। এই মহলের মতে, সময় ও বয়স রাহুলেরই দিকে। অতএব অপেক্ষাই শ্রেয়।

বিজেপির রণনীতি বরং অনেকটাই স্বচ্ছ। তাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র নরেন্দ্র মোদি। দিওয়ার সিনেমার সেই অবিস্মরণীয় ‘মেরে পাস মা হ্যায়’ ডায়ালগের মতো তাদেরও জোরালো দাবি, ‘মেরে পাস মোদি হ্যায়’। এর বাইরে তারা বিশেষ নজর দিয়েছে ছয় রাজ্যের ১৬৪ আসনের দিকে, যেগুলোর মধ্যে আগের ভোটে তারা পেয়েছিল মাত্র আটটি। রাজ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ (৪২-এ ২), তামিলনাড়ু (৩৯-এ ১), কেরালা (২০-তে ০), অন্ধ্র প্রদেশ ও তেলেঙ্গানা (৪২-এ ৪) এবং ওডিশা (২১-এ ১)। ছয়টি রাজ্যই কঠিন ঠাঁই। কিন্তু তবু এই রাজ্যগুলো এবং তার পাশাপাশি দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে মাছের চোখ করেছেন বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ। অবশ্য শুধু এ–ই নয়, ভোটের আগে কেল্লা ফতে করতে তিনটি বিষয়ের ওপর বিজেপি জোর দিচ্ছে।

প্রথমত, দুর্নীতি মামলা। ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলা সরাসরি সোনিয়া ও রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে। এই মামলায় দুজনেই আপাতত জামিনে মুক্ত। মোদিসহ বিজেপির সব নেতা সাম্প্রতিক নির্বাচনী প্রচারে বারবার এই বিষয়ে দুজনকে কটাক্ষ করেছেন। ভোটের আগে এই মামলার রায় মাতা-পুত্রের বিরুদ্ধে গেলে অথবা বিরূপ কোনো মন্তব্য বিজেপির কাছে বড় হাতিয়ার হয়ে উঠবেই। দুর্নীতির মামলা রয়েছে আরও একটা। অগস্তা ওয়েস্টল্যান্ড হেলিকপ্টার চুক্তি। এই চুক্তির ‘মিডলম্যান’ বা দালালির দায়ে অভিযুক্ত ক্রিশ্চিয়ান মিশেলকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। মিশেল যাতে সোনিয়া বা রাহুলের নাম করেন, সে জন্য তদন্তকারী সংস্থাগুলোর চেষ্টায় কোনো খামতি নেই। ভোটের আগে তেমন কিছু প্রকাশ পেলে বিজেপি মনে করছে তাদের জয় মসৃণ হয়ে যাবে। ন্যাশনাল হেরাল্ড ও অগস্তা ওয়েস্টল্যান্ড মামলা শাসক দলের কাছে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ।

দ্বিতীয়ত, বিজয় মালিয়া, নীরব মোদি ও মেহুল চোকসিদের মতো ‘পলাতকদের’ মধ্য থেকে অন্তত একজনকেও দেশে ফেরাতে বিজেপি মরিয়া। যদি সফল হয়, তাহলে সেটা হবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মোদি সরকারের জয়ের নিশান। দলের নেতাদের একটা বড় অংশ মনে করছে, রাফাল নিয়ে কংগ্রেসের যাবতীয় প্রচার তীব্রতা হারাবে আদালতের রায়ে কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব যদি দুর্নীতিগ্রস্তের তকমা পায় এবং ‘পলাতক অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তদের’ মধ্যে কাউকে যদি দেশে ফিরিয়ে আনা যায়।

তৃতীয়ত, অযোধ্যায় রামমন্দিরের শিলান্যাস। সুপ্রিম কোর্ট অবশেষে ১০ জানুয়ারি থেকে অযোধ্যা মামলা শোনার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের নেতৃত্বে তিন বিচারপতির বেঞ্চ মামলাটি শুনবেন। পূর্বতন প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রর সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের যে দুই বিচারপতি এত দিন ধরে এই মামলা শুনে আসছিলেন, সেই বিচারপতি অশোক ভূষণ ও বিচারপতি এস আবদুল নাজিরকে নিয়েই নতুন বেঞ্চ গঠন করা হয়েছে। বিজেপির কট্টরপন্থীরা সুপ্রিম কোর্টের এই সিদ্ধান্তে উৎসাহিত। সর্বোচ্চ আদালতের ওপর নির্ভর না করে অর্ডিন্যান্স জারির জন্য এই মহল ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করে আসছিল। বিজেপির অভ্যন্তরে জনপ্রিয় ধারণা, ভোটের আগেই সুপ্রিম কোর্টের চূড়ান্ত রায় জানা যাবে, যাতে বাবরি মসজিদ-রাম জন্মভূমির গর্ভগৃহে যেখানে ‘রামলালার’ অবস্থান, সেখানেই ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণার আগে রামমন্দিরের শিলান্যাস করা যায়। ওটাই হবে ‘বিরোধীদের কফিনের শেষ পেরেক’।

প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রশ্নটি ঊহ্য রেখেই কংগ্রেস ও অন্য বিরোধীরা ভোটে যাবে। এ ছাড়া তাদের ভিন্ন উপায় নেই। বিজেপির থাকছে ‘মেরে পাস মোদি হ্যায়’ স্লোগান। এর ওপর তিন সম্ভাবনার একটিও খেটে গেলে কে বলতে পারে শেখ হাসিনার ব্যাখ্যা অনুযায়ী শেষ হাসিটা নরেন্দ্র মোদি হাসবেন না?

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি