সৈয়দ আশরাফ: যেখানে ব্যতিক্রম তিনি

সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম
সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম

২০১৩ সালের ৫ মে। পুরো ঢাকা শহর হেফাজতে ইসলামের দখলে। মতিঝিলের শাপলা চত্বরে তাদের সমাবেশ থাকলেও দুপুর থেকে তাণ্ডব শুরু হয়ে যায়। হেফাজতের কর্মীরা বায়তুল মোকাররমে বইয়ের দোকান পুড়িয়ে দেন। তাঁরা হুংকার ছাড়েন অপরাজেয় বাংলা গুঁড়িয়ে দেবেন। হাজার হাজার হেফাজত কর্মীর সামনে র‍্যাব-পুলিশ ছিল অসহায়। শুধু বিএনপি নয়, সরকারের সুহৃদ বলে পরিচিত জাতীয় পার্টিও হেফাজতের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল সেদিন। আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রীরাও কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সর্বত্র উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।

এই অবস্থায় হেফাজতের উদ্দেশে যেই মানুষটি বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমাদের সরলতাকে দুর্বলতা ভাববেন না, রাতের মধ্যেই আপনারা ঘরে ফিরে যাবেন এবং ভবিষ্যতে আপনাদের আর ঘর থেকে বের হতে দেওয়া হবে না’, তিনি সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী। তাঁর কথায় কাজ হয়েছিল। পরদিন হেফাজতের কর্মীরা ঢাকা শহর ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ হেফাজত সম্পর্কে আপসকামী মনোভাব দেখালেও সেদিন সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিলেন সৈয়দ আশরাফ।

২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলসহ অনেক কেন্দ্রীয় নেতাকে জেলে নেওয়া হয়। তখন দলের অন্যতম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দলের হাল ধরেছিলেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। বিদেশি কূটনীতিক ও ক্ষমতার তৎকালীন কুশীলবদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় তিনি মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ার পর বিএনপিতে স্পষ্ট ভাঙন দেখা দিলেও আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক বিপর্যয় এড়াতে সক্ষম হয়েছিল মূলত মো. জিল্লুর রহমান, মতিয়া চৌধুরী, সৈয়দ আশরফসহ কতিপয় নেতার দৃঢ় অবস্থানের কারণে।

আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরও সৈয়দ আশরাফ ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন দলীয় প্রধানের ইচ্ছায়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে তিনি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরপর প্রায় আট বছর এই দায়িত্ব পালন করলেও তিনি কোনো কোটারি গড়ে তোলেননি; উপদলীয় কোন্দলকে কখনো প্রশ্রয় দেননি।

মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সন্তান সৈয়দ আশরাফ ব্যক্তি ও রাজনৈতিক জীবনে বাবার মতোই সুনাম রক্ষা করে গেছেন। তিনি ১৯৯৬ সালে প্রথমে প্রতিমন্ত্রী হিসেবে সরকারে যোগ দেন, পরবর্তীকালে দুটি বড় মন্ত্রণালয়ে পূর্ণ মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সৈয়দ আশরাফ ছিলেন জনপ্রশাসনমন্ত্রীর দায়িত্বে। এই দীর্ঘ সময়ে সৈয়দ আশরাফ পদ-পদবি ব্যবহার করে ব্যক্তিগত সুবিধা নিয়েছেন বা জ্ঞাতসারে কাউকে অন্যায় সুবিধা দিয়েছেন, এ রকম অভিযোগ কেউ করতে পারবেন না। কয়েক মাস ধরে দুরারোগ্য ক্যানসারে ভুগছিলেন তিনি। তাঁর স্ত্রীও এক বছর আগে ক্যানসারে মারা যান।

সৈয়দ আশরাফের রাজনীতি শুরু ছাত্রজীবন থেকে। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর কারাগারে পিতা সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ জাতীয় চার নেতার হত্যার পর সৈয়দ আশরাফ যুক্তরাজ্য চলে যান এবং সেখানে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করতে সক্রিয় ভূমিকা নেন। বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনেও তিনি ছিলেন সক্রিয়।

আমাদের রাজনীতি যখন তীব্র হিংসা-বিদ্বেষে আকীর্ণ এবং ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থের যূপকাষ্ঠে বন্দী, তখন সৈয়দ আশরাফ ছিলেন ব্যতিক্রম ও স্ব–স্বভাবে উজ্জ্বল। তিনি আওয়ামী লীগের মতো দলের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি ছিলেন, মন্ত্রী ছিলেন, কিন্তু পদের গরিমা তাঁকে আচ্ছন্ন করেনি। তাঁর ব্যক্তিত্ব পদের চেয়ে বড় ছিল। যেখানে আমাদের রাজনীতিকদের বেশির ভাগ আত্মপ্রচারে উন্মুখ, সেখানেও সৈয়দ আশরাফের প্রচারবিমুখতা লক্ষণীয়। তিনি কখনো কারণে-অকারণে সংবাদ সম্মেলন করে নিজেকে বড় নেতা হিসেবে তুলে ধরেননি।

সৈয়দ আশরাফ তাঁর সহকর্মী ও সহযোদ্ধাদের যে কথাটি জোর দিয়ে বলতেন, তা হলো রাজনীতি করতে চাইলে দুর্নীতি ছাড়তে হবে। আর দুর্নীতি করলে রাজনীতি ছাড়তে হবে। মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগের যেসব নেতা তাঁকে অত্যন্ত সৎ, নির্লোভ চরিত্রের রাজনীতিক হিসেবে অভিহিত করেছেন, তাঁদের কজন সৈয়দ আশরাফের নীতি ও আদর্শ অনুসরণ করবেন, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে।

মনে আছে, ২০১৬ সালে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে তিনি যখন মঞ্চে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, তখন নেতা–কর্মীরা অনেকক্ষণ ধরে উল্লাস প্রকাশ করেন। সভানেত্রী ছাড়া আর কারও বক্তৃতায় এতটা উদ্বেলিত হননি তঁারা। বিদায়ী সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্টে তিনি ‘অশুভ শক্তির চর, সন্ত্রাসী, মাদকসেবী, অসৎ ও বিতর্কিত ব্যক্তির’ যাতে দলে অনুপ্রবেশ না ঘটে, সে ব্যাপারে নেতা-কর্মীদের সতর্ক থাকতে বলেছিলেন।

আমাদের রাজনীতিকেরা দলীয় বৃত্তের বাইরের সম্পর্ককে আড়াল করতে পছন্দ করেন। কিন্তু সৈয়দ আশরাফ ব্যক্তিগত সম্পর্ককে বেশি মূল্য দিতেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে জাতিসংঘ মহাসচিব ফার্নান্দো তারানকোর মধ্যস্থতায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের মধ্যে বৈঠক হয়েছিল। সেই বৈঠকের ফাঁকে একসময় সৈয়দ আশরাফ মির্জা ফখরুলের উদ্দেশে বলেন, ‘স্যার, আপনি কি জানেন, আমি আপনার ছাত্র ছিলাম?’

মির্জা ফখরুল মনে করতে না পেরে তাঁর দিকে বিস্ময়ের চোখে তাকান। তখন সৈয়দ আশরাফ কিছুটা রহস্য করে বললেন, ‘ছাত্রের কথা শিক্ষক মনে না রাখলেও শিক্ষকের কথা ছাত্রকে মনে রাখতে হয়।’ মির্জা ফখরুল যখন ঢাকা কলেজের শিক্ষক, তখন সৈয়দ আশরাফ তাঁর ছাত্র ছিলেন।

সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের প্রতি দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে যেমন আস্থা ও বিশ্বাস ছিল, তেমনি ছিল গণমাধ্যমসহ সব শ্রেণি ও পেশার মানুষেরও। আবার তাঁর নিস্পৃহতায় তাঁদের মধ্যে হতাশাও কম ছিল না। পেশাগত কারণে ও সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে যখনই সৈয়দ আশরাফের সঙ্গে দেখা হয়েছে, তিনি হাসিমুখে কথা বলেছেন। পত্রিকায় কোনো লেখায় তাঁর সমালোচনা থাকলেও বিরূপ মন্তব্য করেননি। বরং রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি তেমন উৎসাহ দেখাতেন না। বলতেন ‘আসুন, গল্প করি, আড্ডা দিই। রাজনীতি নিয়ে কথা বলে আড্ডার সময়টা নষ্ট করেন কেন?’

তিনি এমনিতেই গণমাধ্যমের সঙ্গে বেশি কথা বলতেন না। শেষ দিকে একেবারেই না। তাহলে কি রাজনীতি সম্পর্কে তিনি অনীহ হয়ে পড়েছিলেন?

আজ যাঁরা ক্ষমতার রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, তাঁরা আয়নায় নিজের মুখ দেখলে বুঝতে পারবেন সৈয়দ আশরাফের সঙ্গে তাঁদের পার্থক্যটা কত বেশি ছিল।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি